আজ মানভূম বাংলা ভাষা আন্দোলন দিবস||মাসুদ করিম
আজ ১ নভেম্বর ‘মানভূমভাষা–আন্দোলন দিবস’। অদ্যাবধি পৃথিবীতে যতগুলো ভাষা–আন্দোলন হয়েছে তন্মধ্যে দীর্ঘতম ভাষা–আন্দোলন হলো মানভূমের ভাষা–আন্দোলন।
মানভূমে বাংলা ভাষা আন্দোলন ১৯১২ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৫৬ সালে অধিকার অর্জনের মাধ্যমে। ১৯০৫ সালে মানভূমকে বিহার-উড়িষ্যাতে সংযুক্ত করা হয়। তৎকালীন বিহার রাজ্যের মানভূম জেলায় বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে জোর করে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে হিন্দি ভাষা। মানভূমের বাংলা ভাষীরা এই রায় মেনে নিতে পারে নি এবং মানভূমকে বাংলার অন্তর্ভুক্তিরদাবি তোলে; আর এখান থেকেই শুরু হয় মানভূমে বাংলা ভাষার আন্দোলন।
একথা অনস্বীকার্য ১৯৫২ এর ভাষা অন্দোলন আর ১৯৬১ সালের আসামের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এক নয়।কেননা আসামে বহুজাতি-উপজাতি ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। এই সকল মানুষের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনৈতিক পটভূমি ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্যও বিদ্ধমান। তবে একথা মানতেই হবে যে, ১৯শে মে আসামের ভাষা আন্দোলনের জন্য যারা শিলচর রেলওয়ে স্টেশানে প্রাণ হারান তারা সবাই বাঙালি ছিলেন। বিষয়টি আরো আলোচিত হয় কমলা ভট্টাচার্যের কারনে। কারণ তিনিই বাংলা ভাষার জন্য প্রথম মহিলা শহিদ। সে আলোকে আসামের ভাষা অন্দোলন একটি মর্যাদাপূর্ণ গুরুত্ব বহন করে। কেননা মাতৃভাষার জন্য একজন মহিলাসহ ১১ জনের প্রাণহানি খুব ছোটো কোন ঘটনা ছিল না। তবে মানভূম এর বাংলা ভাষা-আন্দোলন সঠিকভাবে তুলে ধরার অভাবে অনেকের কাছে অনেকটা অজানাই থেকে যায়।
যেসব দাবিকে ঘিরে মানভূম ভাষা-আন্দোলন দানাবাধে সেগুলো হলো, বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা ভাষায় লেখা, স্কুল-কলেজে হিন্দি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় পড়াশুনার ব্যবস্থা করা। প্রশাসন বাঙালিদের ভাষার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে প্রাথমিক শিক্ষায় হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেয়। জেলা-পর্যায়ের স্কুলগুলোতেও বাংলা ভাষায় পড়াশুনা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। মানভূমের প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে হিন্দি স্থান করে নেয়। লক্ষ লক্ষ বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিকে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করা থেকে বঞ্চিত করা হয়, ভাষার অধিকার হরণ করা হয়। ফলে গর্জে ওঠে বাঙালিরা। শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্তরে তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে স্বীকৃতির জন্য শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের ওপর নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হতে থাকে। অনেককে মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়, অনেককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ভাষা-আন্দোলনে প্রেরণা জোগাতে থাকে দুটো গান। একটি গান হলো টুসু গান-
শোন বিহারি ভাই, তরা রাখতে লাড়বি ডাং দেখাই
এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষায় রাজ্য চাই।
আর অন্য গানটি হলো অরুণ ঘোষের-
আমার বাংলাভাষা প্রাণের ভাষা রে।
এ-আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করতে থাকে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে পুঞ্চার পাকবিড়রা ময়দান থেকে লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বে ১,০২৫ জন সত্যাগ্রহী কলকাতার উদ্দেশো পদযাত্রা করেন। সেই আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর মানভূম জেলার খণ্ডিত অংশ পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গে নবতম জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বাংলা ভাষার রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। তবে এ পরিচিতি অক্ষরের নয়, শব্দের নয়, মায়ের মুখ নিঃসৃত ভাষার প্রতি সন্তানের আবেগের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রক্তাক্ত রাস্তা সে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ১৯৯৯ সালে যে রক্তসরণিকে মনে রেখে এই ২১-কেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব।
কিন্তু ভাষা আন্দোলন বলতেই মানুষ স্মরণ করে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে। অথচ, ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং লড়াই কোনওটাই কিন্তু নতুন নয়। যেমন যবনের ভাষাকে ‘বাংলা’ করতে গিয়ে লড়েছিলেন ভারতচন্দ্র, মধুসূদন লড়েছেন ছন্দ ব্যবহার করতে গিয়ে, টপ্পা গান শিখতে গিয়ে লড়েছিলেন নিধুবাবু আর অস্তিত্ব রাখতে রক্ত ঝরানো আন্দোলন করেছেন অসমের বাঙালিরা। কিন্তু এর পাশাপাশি, মাতৃভাষার জন্য মানভূমের বাঙালিদের দীর্ঘ আন্দোলন নিয়ে যে কোনও রকম আলোচনা থেকে বিরত থাকেন অনেক বাঙালি। অবহেলা না আত্মবিস্মরণ? না হলে উপরোক্ত দৃশ্যপট কেন রাজ্যবাসীর মানসচক্ষে ভেসে ওঠে না! কেন জানতে ইচ্ছে করে না, কেমন ছিল মানভূমবাসীর লড়াইয়ের দীর্ঘতম সময়?
লর্ড কার্জনের বঙ্গবিচ্ছেদের একটা অংশ যত আলোচিত হয়, ততটাই উপেক্ষিত দ্বিতীয় অংশটি। বঙ্গবিচ্ছেদ তো কেবল পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের ভাগ নয়! বঙ্গবিচ্ছেদ আসলে ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গ-উত্তরবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরা নিয়ে একটি ভাগ আর বাংলার বাকি অংশের সঙ্গে বিহার-ওড়িশা মিলিয়ে আর একটি ভাগ। মানভূম বা পুরুলিয়া ছিল দ্বিতীয় অংশে। ১৯০৫-এ না হলেও বাস্তবে বঙ্গবিচ্ছেদ ঘটে গেল ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। বাঙালির মানভূমে তখন থেকেই শুরু হল এক রকম ‘হিন্দি-সাম্রাজ্যবাদ’।
তখন একের পরে এক বাংলা স্কুল পরিণত হল হিন্দি স্কুলে। ডাকঘর-সহ সমস্ত সরকারি দফতরে হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হল। ফরমান আসে, আদালতের সওয়াল-জবাব, চিঠিপত্র, জমির দলিল সব হবে হিন্দিতে। ঠিক যে কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপরে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হিন্দির ‘আগ্রাসন’ মানভূমে যেন ঠিক ততটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল ১৯৪৮ থেকে। এর বিরুদ্ধেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন।
মানভূমে বাংলার উপরে হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা শুরু হয় ১৯১২ থেকে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে। যার আঁচ পড়ে জাতীয় কংগ্রেসের মানভূম শাখার কর্মী নেতাদের উপরে। ১৪ জুন, ১৯৪৮ পুঞ্চা থানার পাকবিড়রায় প্রায় দেড় হাজার কর্মী-সমর্থকের উপস্থিতিতে কংগ্রেস ভেঙে গঠিত হয় ‘লোকসেবক সংঘ’। এর বীজ বপন হয় ৩০ এপ্রিল, বান্দোয়ানের জিতান গ্রামে মানভূম জেলা কংগ্রসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে। সেখানে দীর্ঘ আলোচনার সারমর্ম একটাই, ‘মানভূম বাংলা ভাষাভাষী’।
ভাষার জন্য সত্যাগ্রহকে দমন করার জন্য হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিচিত্র দমনপীড়ণ। গ্রেফতার হয়েছেন সাত নেতা। পুরুলিয়া জুবিলি ময়দান, রাসমেলা ময়দানের সভাতেও লাঠি চালায় পুলিশ। সাঁতুড়ির জনসভায় পুলিশের লাঠির আঘাতে মাথা ফাটে চিত্তভূষণ দাশগুপ্তের। মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করা হয় বহু নেতাকে।
তখন এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানান সর্ব স্তরের বাঙালি। এর পরে মানভূমে বাংলা ভাষার আন্দোলন দৃষ্টি আকর্ষণ করে কলকাতা ও দিল্লির, তবু নিপীড়ণ-অত্যাচার চলছিলই। ফলে, শুরু হল ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। মানভূমের লোকগান ‘টুসু’, সাধারণের স্বতোৎসারিত আবেগ মিশে থাকে। তাতেও ফুটে উঠতে লাগল বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ।
লোকসেবক সংঘের একটি ছোট্ট পুস্তিকা ‘টুসু গানে মানভূম’ ঝড় তুলেছিল এই সময়। টুসু গান আবহমানকালের যূথবদ্ধ সঙ্গীত। অথচ, দল বেঁধে গান গাইতে গেলেই তা অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হল। যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে টুসু গান গেয়ে গ্রেফতার হলেন অসংখ্য মানুষ। কারারুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের স্থানান্তরিত করা হল হাজারিবাগের মতো দূরের কারাগারে। এরই মধ্যে শুরু হয় সীমা কমিশনের কাজ।
সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের তৎকালীন দুই মুখ্যমন্ত্রীর (বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ) তরফে বঙ্গ-বিহার যুক্ত প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব আসে। এ বার কেবল মানভূম নয়, প্রতিবাদ করেন কলকাতার বাঙালি বিদ্বজ্জনেরাও। ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাবেক মানভূমের নানা স্থানে চলেছে বিহার পুলিশের ‘অত্যাচার।’ ঝালদা ও জয়পুরে দোকান লুঠ হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর।
এর পরের ঘটনা ঐতিহাসিক ‘লং মার্চের’ সঙ্গে তুলনীয়। বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণের প্রতিবাদে (নিহিতার্থে মানভূমে বাংলা ভাষার হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার দাবিতে) ১০ জন মহিলা-সহ ১০০৫ জনের সত্যাগ্রহী দল পাকবিড়রা থেকে পদযাত্রা শুরু করে কলকাতার উদ্দেশে। ২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে, টানা ২১ দিন প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। কণ্ঠে ছিল ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি আর ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ ইত্যাদি গান। কলকাতায় পৌঁছলে ৭ মে ডালহৌসি স্কোয়ার থেকে ১৪৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয় ৯৫৬ জনকে। বাকিরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ৯ মে কলকাতায় পৌঁছতেই তাঁদের গ্রেফতার করে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।
পরের ঘটনাক্রম দ্রুততর। বাধ্য হয়ে রদ করা হয় বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব। বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন পাশ হয়। সীমা কমিশনের রিপোর্ট লোকসভা হয়ে ‘সিলেক্ট কমিটি’ ও আরও নানা স্তর পেরিয়ে ১ নভেম্বর, ১৯৫৬ জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া জেলা।
মাসুদ করিম
১ নভেম্বর, ২০২৪
0 মন্তব্যসমূহ