বই সংবাদ :স্রোত প্রকাশনা
রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা ও বিচিত্র প্রসঙ্গ
বিকচ চৌধুরী
প্রচ্ছদ :ধৃতি দেববর্মন
অলংকরণ :প্রশান্ত সরকার
প্রকাশকাল:আগরতলা বইমেলা-২০২১
পরিচয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের কলম সৈনিক বিকচ চৌধুরীর ৭৫তম জন্মদিন আজ। বিকচ চৌধুরী ১৯৭১ সালে আগরতলা থেকে প্রকাশিত উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান বাংলা পত্রিকা দৈনিক সংবাদের ওয়ার করেসপন্ডেট ছিলেন। দীর্ঘ নয় মাস তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ছুটে বেড়িয়েছেন। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত তাঁর রিপোর্টগুলো সেসময় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। তার কয়েকটি রিপোর্ট আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৬ ডিসেম্বর তিনি জেনারেল আরোরার সংগে একই হেলিকপ্টারে ঢাকা আসেন এবং রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ করেন। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডিতে বেগম মুজিবের সংগে জেনারেল আরোরার সাক্ষাতের (ছবিতে দু’জনের মাঝখানে ফ্লোরে বসে তিনি নোট নিচ্ছেন) সংবাদও তিনি পরিবেশন করেন। কিন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য পাশের বাড়ির এই মানুষটিকে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ বন্ধু সম্মাননা প্রদান করেনি। অথচ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যারা সামান্যতম অবদানও রেখেছেন তাদেরকে সম্মানিত করা হয়েছে। এধরনের ৩৩৮ বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে সম্মাননা দেয়া হয়। এব্যাপারে গতকাল আমার এক প্রশ্নের জবাবে বিকচ দা অভিমানের সুরে বলেন “ বাংলাদেশ আমারও জন্মভূমি। তাই জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে ১৯৭১ সালে কলম নিয়ে রণাঙ্গনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটেছি। এ আমার মাতৃৃঋণ পরিশোধের সামান্য প্রয়াস মাত্র। কোন পুরস্কার অথবা সম্মাননার জন্য লালায়িত নই। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত। এক জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি আছে ?” আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিকচ দার অবদান নিয়ে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে আমি বাসস থেকে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ঢাকার বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছিল। সেই সূত্রে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বিকচ চৌধুরীকে সংবর্ধনা দেয়ার ব্যাপারে। কিন্তু সে আলোচনা আর এগোয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালের আজকের এই দিনে বাংলাদেশের সিলেট শহরে বিকচ চৌধুরীর জন্ম। বাংলা সন হিসেবে দিনটি ছিল ২২শে শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথের প্রয়ান দিবস। ১৯৬০ সালে শিলং ও আসামের শিলচর হয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে স্থায়ী হন। ১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবন শেষে তিনি ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগেও কাজ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শিল্প,সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্বের ওপর তার লেখা অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি কলামিস্ট হিসেবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা-লেখি করছেন। ২০১৭ সাল থেকে বিকচ দা কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তবে মাঝে মাঝে সিডনিতে মেয়ের কাছে বেড়াতে যান। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আজীবন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী বিকচ দার সুস্থ জীবন ও শতায়ু কামনা করছি।
ভূমিকা
ত্রিপুরার তিন দশক কালের রবীন্দ্র গবেষণার ক্ষেত্রে বিকচ চৌধুরী একটি বিশিষ্ট্ নাম।
অতলান্ত ভালবাসা ও সুগভীর অন্বেষা নিয়ে "ত্রিপুরা কবি" রবীন্দ্রনাথকে তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনা ও
একাধিক গ্রন্থের মাধ্যমে নানাভাবে পাঠকের কাছে মূর্ত করে তুলে ধরেছেন।
"রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা ও বিচিত্র প্রসঙ্গ " বিকচ চৌধুরীর গভীর অনুভব ও বিচিত্র অনুসন্ধানের একটি অভিনব সংযোজন।ভ্রমণবিলাসী রবীন্দ্রনাথের বিশ্বের নানা প্রান্তে ভ্রমণের বিচিত্র কৌতুকপ্রদ নানা উপাখ্যান লেখক যেমন তুলে ধরেছেন,তেমনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সাধানার ইতিহাসে পুববাংলার সঙ্গীত সাধকদের,বিশেষ করে সুফি বাউল সাধকদের প্রভাবের কথা আলোচনা করতে গিয়ে লেখক দেখিয়েছেন কী করে কবি গভীর ভাবে গ্রাম বাঙলার সুফি বাউলদের জীবন দর্শনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।লেখক বিস্তৃত গবেষণামূলক তথ্যের মাধ্যমে পুববাংলার দুই প্রখ্যাত লোককবি হাছন রাজা ও লালন শা 'র রচিত নানা গানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ বিশেষ গানের সুর ও দার্শনিক ভিত্তির তুলনীয় বৈশিষ্ট্য এর কথাও বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরেছেন।
রাবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়েস থেকে কবি জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজকুলের চার পুরুষ ধরে তাঁর যে আত্মার বন্ধন গড়ে উঠেছিল ছয় দশকব্যাপী বিস্তৃত সেই গৌরবময় অধ্যায়েরও লেখক আলোচনা করেছেন অত্যন্ত শ্রমসাধ্য প্রয়াসের মাধ্যমে।
এই গ্রন্থে আরেকটি দিক আছে যেখানে গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে লেখক ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আবৃত ইতিহাস উন্মোচনে ব্রতী হয়েছেন একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।সেই পর্বেই যুক্ত হয়েছে একটি অনন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল নিবন্ধ যেখানে লেখক ত্রিপুরার সদ্যপ্রয়াতা মহীয়সী রাজকুমারী কামলপ্রভা দেবীর অভূতপূর্ব রোমাঞ্চকর শিল্পকলা সংস্কৃতি ও সাহিত্য চর্চার নিরলস সাধনার সঙ্গে এই প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছেন।এই অসামান্য নারীর সৃষ্টির অবদান সম্পর্কে এর আগে আর কোথাও এমন আলোচনা আমাদের চোখে পড়েনি।
এছাড়াও"ত্রিপুরা ও মুক্তিযুদ্ধ" এই পর্যায়ে একটি সাক্ষাৎকার ও একটি নিবন্ধে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার গৌরবজনক ভূমিকার কথা বিশদ ভাবে আলোচিত হয়েছে।
"কিছু অনুভব"এই পর্যায়ে লেখক জীবনের সরণি বেয়ে চলতে চলতে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা খোলামনে ব্যক্ত করেছেন।এই অধ্যায়টি লেখকের ব্যক্তিগত অনুভবের হলেও সবগুলি লেখার মধ্যে সমকালের জীবন ও সমাজের একটি বার্তাও অবশ্যই রয়েছে।
"পরিশিষ্ট পর্যায়ে" মুক্তিযুদ্ধ কালীন সাংবাদিক বিকচ চৌধুরীর উপর আলোকপাত করেছেন ত্রিপুরার বিশিষ্ট সাংবাদিক মানস পাল ও মুক্তিযুদ্ধ কালে ত্রিপুরায় শরণার্থী জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন বর্তমানে ব্রিটেন প্রবাসী কলামিস্ট ইমরান আহমেদ চৌধুরী।
"স্রোত প্রকাশনা"র এই নতুন সংযোজনটি একটি ভিন্ন ধারার প্রয়াস এবং আশা করি তা পাঠক-নন্দিত হবে।
-পীযূষ রাউত
ধর্মনগর
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০
0 মন্তব্যসমূহ