মায়াবী কবিতার সমাহার
কবি বিকাশ সরকারের ‘হ্যালুসিনেশন সিরিজ’
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
কবিরা সততই আত্মভোলা হন, প্রকৃতিপ্রেমী হন, নদী-পাহাড়ের সাথে তাঁদের নিয়ত সখ্য। এসব বহুপ্রকাশিত সত্য, এসব প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু একজন কবি যে কবিতার মনোময় জগতে বিচরণ করতে গিয়ে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন এক অতীন্দ্রিয় সত্তায়, পৌঁছে যেতে পারেন এক অলীকতম স্তরে, নিজেকে কেটেছেঁড়ে বিনির্মাণ করতে পারেন এক নবতর সত্তায় তা অনুধাবন করা যাবে না এই বইটি না পড়লে।
এই গ্রন্থের নাম - এর থেকে ভালো কিছুই হতে পারে না। বস্তুত অন্য কোনও গ্রন্থনাম গ্রন্থের অন্তর্গত পুরো বিষয়টিকে একত্রে তুলে ধরতে পারত না। এসব কবিতারও হতে পারে না কোনও শিরোনাম। কবি বিকাশ সরকারের কাব্যগ্রন্থ ‘হ্যালুসিনেশন সিরিজ’-এ রয়েছে এমনতরো ৫৫টি শিরোনামবিহীন কবিতা। কবির চিন্তন জুড়ে শুধুই অতীন্দ্রিয় জীবনের হাতছানি -
কোনোকালেই আমার কোনও বাঁশি ছিল না
শুধু সারিবদ্ধ গাছ, গাছে গাছে ঝুলেছিল ফাঁসি
ফাঁসিগাছ ছিল সারিবদ্ধ
আমি একটি আত্মহত্যা করতে-না-করতেই
আরেকটি আত্মহত্যা ডাকত ‘আয়’
আর আমি এভাবেই ঝুলে পড়ি
এক ফাঁসি থেকে আরেক ফাঁসিতে
আজও একটি আত্মহত্যা সম্পূর্ণ হলো না
তার আগেই আরেকটি ফাঁসি ডাকল ‘আয়’। (কবিতা সংখ্যা - বত্রিশ)।
উল্লিখিত কয়েকটি পঙ্ক্তির পাঠোদ্ধার করেই একটি ধারণা করা যায় কবি বিকাশের কাব্যগুণ সম্পর্কে। আলোচ্য গ্রন্থটি কবির সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ নয়। তবু এটাকেই আলোচনায় রাখার মূল কারণ হচ্ছে এই যে এখান থেকেই বলা যায় শুরু হয়েছে তাঁর কাব্যপ্রতিভার স্ফুরণ। পুরোপুরি এক ব্যতিক্রমী কাব্যশৈলীর সঙ্গে এখান থেকেই পরিচিত হতে পেরেছেন এই ঈশান বাংলার কাব্যাবুরাগী পাঠকবৃন্দ। এই শৈলী একেবারেই ভিন্নধর্মী। জাগ্রত মননে এমন সব পঙ্ক্তি কবির কলমে ধরা দেওয়া সম্ভব নয়। এক অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় নিজেকে আসীন করতে পারলেই হয়তো এ সম্ভব। আজকের দিনে অন্ত্যমিল কবিতার একচ্ছত্র রাজা কবি বিকাশ সরকার এক পরিবর্তিত সত্তা। ধরণ পালটেছে যদিও এই অতীন্দ্রিয় মননসঞ্জাত ধাঁচ নিঃশেষ হয়ে যায়নি আজও। অন্ত্যমিলেও তাই বারবার ধরা পড়ছে এই হ্যালুসিনেশন। এই হ্যালুসিনেশনের ইতিহাস নিখাদ হয়ে ধরে রাখা আছে আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। এর পাঠের প্রাসঙ্গিকতা তাই আজও বিদ্যমান সর্বাংশে।
গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট তিনটি গদ্য কবিতা। পড়তে পড়তে কখন যে এসব হয়ে ওঠে পদ্য-কবিতা তা টেরই পাওয়া যায় না। গদ্যের ভিতর যে এমনভাবেও বইয়ে দেওয়া যায় পস্যের চোরাস্রোত সেও এক বিস্ময়। আবার প্রথাগত ছন্দহীন কিছু পদ্য কবিতার অবয়বে যে কবিতাগুলো এখানে সন্নিবিষ্ট হয়ে আছে সেগুলো পাঠ করতে বসে পাঠক খেয়ালই করতে পারেন না যে এখানে পদ্যছন্দের উপস্থিতি নেই। এও এক হ্যালুসিনেশনই বটে। গদ্য কবিতায় যেখানে অনুভূত হয় পদ্য ছন্দের অনুভূতি, সেখানে পদ্যাকারে লেখা কবিতায় ছন্দের অনুপস্থিতি। অথচ কী এক পঠনসুখ জড়িয়ে থাকে মন-মগজ জুড়ে। এমনই যেখানে কবিতার মায়া সেখানে আবার নিজের কবিতা নিয়ে কবির কত না শোকগাথা, কত না অভিমান। এ অভিমানের কিছুটা উল্লিখিত হয়েছে ভূমিকায় - ‘কবিকথা’ শিরোনামে। এখানে আছে এই ‘হ্যালুসিনেশন সিরিজ’-এরও জন্মকথা -
‘১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কবিতাবই ‘কনিষ্কের মাথা’। তারপর একে একে আরও দু’টি - ‘প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য’ এবং ‘ফাঁসিগাছ’। বইগুলো নন্দিত হয়েছিল যৎকিঞ্চিৎ, নিন্দিত হয়েছিল অধিক। বাংলার মূলধারার দাদাকবি ও দাদাবিশেষজ্ঞরা আমার রচনাসমূহকে কবিতা বলে স্বীকার করতেই রাজি ছিলেন না। আজও যে তার ইতরবিশেষ হয়েছে তেমনটি নয়। ফলে কোনও দশকওয়াড়ি আলোচনাতেই আমার নাম নেই। এমনকি বাংলা কবিতার ১০০০ জনের যে সংকলন ঘটা করে প্রকাশিত হয়েছে সেখানে অবধি আমি নেই। এতেই বোঝা যায় আমার এসব লেখালেখি কবিতা পদবাচ্য নয়। ...... পারিবারিক দারিদ্রের কারণে প্রতিদিন একটু একটু করে স্বপ্নভঙ্গের কারণে, ব্যক্তিগত মনোবিকলনের কারণে আমি তীব্র বিষণ্ণতার শিকার হয়েছিলুম। বিষাদ ও ইনসমনিয়া। তখন আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিয়েছিল। এই সময় সবকিছুকেই বিভ্রান্তিকর আর অবিশ্বাস্য বোধ হতো। তার স্পষ্ট ছাপ ছিল সমকালীন লেখায়। একটা সময়ে লেখালেখি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি অশান্ত অসমের রাজধানী গুয়াহাটির অনিশ্চিতে। ...প্রায় ৩৭ বছর পর নানা খুদে পত্রিকা আর পুরনো খুঁজেপেতে ৫৫টি কবিতা নিয়ে এই ‘হ্যালুসিনেশন সিরিজ’ প্রকাশিত হল...।’
ভূমিকাও যে কাব্যিক হতে পারে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে সেসব এখন ইতিহাস।
কবি এখানে নানা কবিতায় ‘আমি’কে করেছেন বিনির্মাণ। এই ‘আমি’ নানান অনুষঙ্গে জাগ্রত হয়েছে নানান সত্তায় - এমনকি সরাসরি কবিনাম ধরে -
সন্ধ্যার তিরষ্কৃত মেঘমালার মতো উড়ে যাচ্ছে তাহার চশমা
আর আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে বিন্দু-বিন্দু দীর্ঘশ্বাসগুলি
কালো শাড়ির নীচে মণ্ড পাকানো আর দুলে ওঠা ম্যাপলিথো
পিচ্ছিল ত্বকের তলায় যেন মণ্ড পাকিয়ে রয়েছে শীতঘুম
শ্মশানতত্বরে শুয়ে এইসব দেখে একা এক বোকা বিকাশ সরকার
চশমা ঝরে পড়ে, সারাটি রাত ঝরে পড়ে নির্ঘুম ঘাম
যেন নাভি থেকে গলা থেকে শিরদাঁড়া থেকে অবৈধ কাম (কবিতা সংখ্যা - ২)।
এমন শন্দ, এমন অনুভূতি, এমন কবিতা প্রসবিত হলে কবির বোকা হতে আপত্তি কীসের ? এমন বহু কবিতায় কবি নিজেকে উন্মোচিত করেছেন ভিন্ন ভিন্ন স্বরূপে। বস্তুত ব্যক্তি বিকাশই হয়ে উঠেছেন কবি বিকাশ। এমন দিশাহীন জীবনকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে কবিতার বৈচিত্র, এক সমান্তরাল অনুষঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে কোনও এক ‘কচি’ চরিত্র। একাধিক কবিতায় তার উপস্থিতি। কচির সঙ্গে যাপিত কিংবা ভাবিত যাপনোন্মুখ সময়ের সে কী নান্দনিক কাব্যিকতা। পর্যায়ক্রমে স্থান থেকে স্থানান্তরে এসেছে কচিকথা -
টেলিফোনে ক্রস কানেকশন হলো বলে কচির কথা শোনা হলো না
আপাতত মেছুয়ার পাড়ে বসে দেখি লিরিকলাঞ্ছিত পাখিদের মেলা
রুকাবট কে লিয়ে খেদ প্রকাশ করছে এই যে আকাশ
তার নীচে শুয়ে থাকি চুপ, আর ঘাসগুলো তেজষ্ক্রিয় হয়
বেতপাতা উড়ে আসে, উড়ে আসে বিবাগি শিমূলের আঁশ
আর আসে কচির চিঠি ‘দেখা হবে
এবার তবে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে’
তারপ যা হয়, যা হতে পারে, যেভাবে হয়
চশমা আমার হাতে দিয়ে কোপাইয়ে নেমে যায় কচি
জলের ঝাপটা দেয় চোখে, তারপর চেয়ে থাকে সোনাঝুরির দিকে
ওদিকে সোনাঝুরির হাটে মাদল বাজছে তখন দ্রিমিদ্রিমি খুব
কচি যে নেমে গেল জলে আর কেন উঠে এলো না।
আমি এই খোলা চশমা নিয়ে সারাটি বসন্ত কী করব এখন ? (কবিতা সংখ্যা ১৮)
তুমি আলো, মহাপৃথিবী আর সবুজসমুদ্রের গান করো
আমি গাই হননের গান, আমি তোমার যোগ্য নই কচি...
বর্ষা শুরু হলে দেখো
আমিও কেমন ঢুকে পড়ি ওই খুনির হৃদয়ে (কবিতা সংখ্যা ২০)
...আমি কচি কচি করে চিৎকার করি গয়েরকাঁটা থেকে শান্তিনিকেতন... কেউ শোনে না সেই ডাক... অহর্নিশ শববাহী অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দে হারিয়ে গেছে খোয়াইয়ের সব বৃষ্টিপাত... (কবিতা সংখ্যা ৪৪)
আবার শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসব এল
আর আমাদের এই শেষ দেখা হলো আজ সন্ধেবেলা
আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে...
শীতঘুমে ঢুকে পড়বে আমারই বুকের ভিতর... (কবিতা সংখ্যা ৫৪)
এভাবেই ৫৫ টি কবিতার মধ্যে আরোপিত শব্দ-চাতুর্য, সরল সংলাপ, আত্মবিমোহন আর আত্মবিস্মরণের এই হ্যালুসিনেশন যাত্রায় অন্যতম এক অনুষঙ্গ হয়ে ‘কচি’ এসে জায়গা করে নিয়েছে বুক (বই)-এর ভিতর - কবিতার ভিতর, অনাবিল মায়া ছড়িয়ে।
অসংখ্য অনাবিল, উল্লেখনীয় শব্দদ্বিত্ব আর অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসা পঙ্ক্তিসজ্জা ছড়িয়ে রয়েছে গ্রন্থ জুড়ে, পরিসর যার পূর্ণ উল্লেখের অনুমতি দেয় না। এ অভিজ্ঞতা, এ বোধ জমা থাকুক পাঠকের জন্য। অসাধারণ প্রচ্ছদের সৌজন্যে দেবাশিস সাহা। ত্রিপুরার স্রোত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ছাপা স্পষ্ট এবং বাঁধাই উন্নত হলেও শব্দ বিন্যাসে কিছু অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় ব্লার্ব এখানেও খালি থেকে গেল। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন অমিতেশ সরকারকে ‘যাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত নতুন করে তৈরি করে হ্যালুসিনেশন’। পঠনশেষে হ্যালুসিনেশন থেকে আশু মুক্তির দায় একান্তই পাঠকের।
স্রোত প্রকাশনা
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৬১৬৭২৩১ (প্রকাশক)
0 মন্তব্যসমূহ