বেহেলাবাড়ির রূপকথা ও অন্যান্য কবিতাগুচ্ছ ২ ||হারাধন বৈরাগী

বেহেলাবাড়ির রূপকথা ও অন্যান্য 
কবিতাগুচ্ছ ২ ||হারাধন বৈরাগী

হারাধন বৈরাগী:একজন জঙ্গল সাধক। ভালোবাসা জঙ্গল, জনজাতি,জুম, জুমজীবন।জঙ্গলের ভিতর‌ই অবিনাশী যাত্রা,মুত্রাপাটির ঘর।

গ্রাম:শ্রীরামপুর, পো: কাঞ্চনপুর, জেলা:উত্তর ত্রিপুরা,পিন:৭৯৯২৭০। 
হাসমতি ত্রিপুরা, হৃদিচস্প্রেং, ঘুমপুইপাড়ায় (কাব্যগ্রন্থ), ঘুমপুই থেকে সিকামনুকতাই (গদ্যগ্রন্থ), হৃদয়ে রাইমা (উপন্যাসধর্মী স্মৃতি-আখ্যান), বুরাসা (গল্পগ্রন্থ।, গোবিন্দ ধরের নদী, নদীর গোবিন্দ (আলোচনা গ্রন্থ), উজানমাংমারা রিজার্ভ ফরেস্ট, কাব্যগ্রন্থ (কবিতা)। যৌথসংকলন- সমকালীন ত্রিপুরার পনেরজন কবির কবিতা, নির্বাচিত ত্রিপুরার তরুণ কবিদের কবিতা, ৫৪জন গল্পকারের ২১৬টি অনুগল্প, ব্যাটিং জোন (অখণ্ড বাংলার নির্বাচিত অনুগল্প, তবু ভালোবেসে যাবো (গল্পসংকলন), হায়াতরু ত্রিপুরার সাম্প্রতিক ছোটগল্প, মধুমঙ্গল বিশ্বাস সম্পাদিত এক লাইনের কবিতা, অষ্টমীর শাড়ির ক্যানভাস (গল্পসংকলন)। নিয়মিত লিখছেন এপার ওপারের সমসাময়িক বিবিধ পত্রসাহিত্য ও লিটলম্যাগে।



ভৌতিক 

মোঙ্গলীয় রাত
মিছিপের মতো নেমে এসেছে 
জঙ্গলের শিখরে
চাঁদনীআলোয় ফুটে উঠেছে তার 
ভৌতিক করোটি!

উন্নয়নের রূপকথা

উন্নয়নের গীত এখনো শুনি,
শুনতাম একসময়ও—
২০০৮-এ রবিঠাকুর দ্বিতল স্কুলটি নির্মিত হয়েছিল বনেদি-টাকায়,
প্রচারের আলোয় বাদ্য নেমেছিল।

২০২৩ এ—টিফিন আওয়ার্সে, হঠাৎ
বারান্দার ছাদের একাংশ ভেঙে পড়ে মাথায়
অল্পের জন্য রক্ষা পায় ছাত্রছাত্রী,
নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন,
চলতে থাকে তদন্ত, রিপোর্ট পেশ,
আসে নতুন বিল্ডিংয়ের স্যাংশন।
আগের বিল্ডিং-এর আয়ু ছিল পনেরো বছর,
এখন জানি না—কত বছর তার আয়ু।
কাজ চলছে, উন্নয়ন চলছে।

ক্লাসঘর তালাবন্দি।
স্থান সংকুলানের অভাবে বাদবাকি ঘরে
সাধ্যমতো চলতে থাকে অল্টারনেটিভ পাঠদান।
মনে সান্ত্বনা: একটা নতুন বিল্ডিং তো অচিরেই হচ্ছে, উন্নয়ন তো চলছে।

শিক্ষক-অশিক্ষক থাকবেন কোথায়?
প্রশ্ন ওঠে পরিচালনা কমিটির মিটিং-এ।
আশ্বস্ত করা হয়—ছাত্রছাত্রীরা পুরোনো বিল্ডিং-এ আর প্রবেশ করবে না,
শিক্ষক-অশিক্ষক, হেডস্যার সহ সকলেই থাকবেন মাথাভাঙা বিল্ডিং-এ।

গাঁয়ের একজন সমাজসেবীর চোখ দিয়ে
গড়িয়ে নামে জল, তিনি ধরাগলায় বললেন
শিশুদের ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে সামনে—
কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে—সব অন্ধকার!
তারা সকলেই বেসরকারি ছেলেমেয়ে,
শিক্ষক-অশিক্ষক মরলেও কিছু নয়,
ওদের তো সরকারি মাগনা টাকা!
কিছু একটা হলে ওদের ছেলেমেয়েরা মরবে না—
পেনশনের মাগনা টাকায় পেট চলে যাবে!
৪০ বছর আগে আমরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছি
একটা গুহাতুল্য লুঙ্গার ভিতর
জায়গাজমির অভাবে।
তারপর সকলে লড়াই করে ১৬ কানি জমি
অধিগ্রহণ করেছি সরকার থেকে।
স্কুল-বাড়ি নির্মাণ করেছি
অনেক ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে,
যে কোনো মূল্যে এটি রক্ষা করবো,
আমরা রক্ত পানি হতে দেবো না।

স্কুলের ১৬ কানি ভূমির ১৫ কানি এখন
জবরদখলকারীর দখলে, ভোটব্যাঙ্কের ঘরদোয়ার।
এই জবরদখল শুরু হয়েছিল একসময়,
সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কিছু সংখ্যক অনুপ্রবেশকারীকে,
এখনও চলছে, কোনো হলদোল নেই কারোরই।
উদ্দেশ্য একটাই: ভোটের সমীকরণ।

বাউন্ডারির ভিতরে স্কুলের জানালার গাঘেঁষে
এখন ভোটব্যাঙ্কের বাঁশঝাড়, সুপারি-বাগানও।
স্কুলের ভিতরে এমন জবরদখলের নমুনা
ভূ-ত্রিপুরায় আর কটি আছে—জানা নেই আমার।

গাছগুলো বেড়ে উঠেছে, সুপারি ধরছে,
বাঁশ বিক্রি হচ্ছে নিয়মিত—
উন্নয়ন তো চলছে!
ফুলেফেঁপে উঠছে জবরদখলদার, 
ভোটব্যাঙ্ক বড়ো হচ্ছে।
স্কুল, জমির মালিক—শিক্ষা—
রুগ্ন হচ্ছে প্রতিদিন।
নতুন বিল্ডিং-এর স্থান সংকুলান হচ্ছে না!
কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের বরাদ্দকৃত ট্যাঙ্কের জল
পাইপ দিয়ে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে ভোটব্যাঙ্ক।
একটা আস্ত রিংওয়েল গিলে খেয়েছে
স্কুলের এক ব-কলম মেম্বার।
নলকূপ বসেছে নতুন করে—
মিড-ডে মিলের জন্য জলের যোগান!
সেটিও এখন ভোটব্যাঙ্কের দখলে।

চাপ নিতে পারে না টিউবওয়েল,
বারংবার বিগড়ে যায়—
কর্তৃপক্ষ ছুটে আসে ঠিক করতে,
ভোটব্যাঙ্কের কোনো মাথাব্যথা নেই।
কারোর মাথাব্যথা নেই।

২০২৩-এ জলচুরির প্রতিবাদ করলে—
রিংওয়েল চুরি করা মেম্বার
মদমত্ত প্রবেশ করে হেডস্যারের রুমে—
জ্ঞান দেয় জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার!

পরিচালনা কমিটির সভায় সেই ব-কলম মেম্বার
মুখখারাপ করে শেখায়—
হেডস্যারের ক্ষমতার এক্তিয়ার ও কর্তব্যবোধ!
পুরো হলঘর নির্বাক—
সমাজসেবীদের মুখে কুলুপ।

পিঠে নিয়ে
সেই মেম্বারের টাডানির দাগ—
বিদায় নিলেন হেডস্যার,
উন্নয়ন কমিটির কেউ এসে জ্বাললো না
একটুখানি সহানুভূতির চেরাগ।

এরা কর্মচারী আর ওরা জনগণ—
একসময় যে বিভাজনের সূতো
ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল
শোষণ ও শাসনের সুবিধার্থে,
এখনও সেই সুবিধাতেই
ঝুলছে সেই সূতোই।
সেই বিষ‌ই এখনও ঝুলানো হচ্ছে 
বাড়ির গেটে।
জনগণের জন্য ভাববে জনগণই—
কোনো ছাপ্পামারা কর্মচারী নয়।
এই একই গীত, একই গায়ক
তখন‌ও ছিল ও এখনও আছে।
বেশ তো—উন্নয়ন চলছে,

উন্নয়নের গীত
সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই চলছে।
চেয়ারম্যান শুধু পাল্টেছে—
চেয়ারটা কিন্তু আগের মতোই রয়েছে।
উন্নয়ন তো চলছে!

অনুপ্রবেশকারী আসুক,
দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হোক,
দেশ জাহান্নামে যায়—যাক!
পুলওয়ামা একটা কেন,
বারংবার ঘটুক!

মাতৃভাষা আক্রান্ত হয়ে গেছে,
এই গো ধরে জনগণকে বোকা বানিয়ে
বিদেশি অনুপ্রবেশ বজায় রাখবো—
পাকিস্তানি হোক কিংবা বাংলাদেশী,
রোহিঙ্গা হলেও অসুবিধার কি!
তাতে আমার কি গেছে,

ভোট ব্যাঙ্ক চাই,
চেয়ারটা ঠিক চাই,
খাবো চর্ব্য-চুষ্য-লেজ্য-পেয়—
অভ্যাস হয়ে গেছে তো!
এখন আর বাংলা ভাল্লাগে না।
এখন আর নীচে নামলে মরে যাবো।
শুধু—পুলওয়ামাটা আমার ঘরে না হলেই হল—
চেয়ারটা যেমন আছে তেমনটাই চাই।
উন্নয়ন তো চলছে—চলুক!

একটা বাংলাদেশের ছায়া
আরেকটা বাংলাদেশ গিলে ফেলুক—
তাতে কি আসে যায়!
আমার তো বাড়ি ঠিক আছে
উন্নয়ন তো চলছে!

উন্নয়নের গীত শোনছি একসময়ও,
শোনছি এখনও,
আশা—আগামীকালও শুনবো।
আর একদিন আমরা ঠিক পৌঁছে যাবো—
জঙ্গল থেকে মঙ্গলে,
সকলকে নিয়ে, সকলের সাথে—--!



বদলি রোগ

এক সময় বদলি ছিল নিশি ডাকের মতো —
এক অদৃশ্য হাত, টেনে নিয়ে যেত
পাহাড়ের নীলাভ নিঃশ্বাসের দিকে।

ত্রিপুরার মানচিত্রে
কিছু গোপন সমন্বয়চিহ্ন ছিল —
গন্ডাছড়া, খেদাছড়া…
যেন কোড,
যেখানে পৌঁছালে শব্দের ভেতর জন্ম নেয়
‘বদলি রোগ’।

কবিদের এক দোষ —
তারা বিরহকে মধু দিয়ে মেখে,
স্মৃতিকে পান্তাভাতের সাথে সেঁকে
কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, কিংবা পোড়া শিঁদল দিয়ে
কচলিয়ে খেতে চায় কবিতার থালায়।

পান্তা ছিল দুঃখিদের খাবার,
শহর ছেড়ে পাহাড়ে — 
এক বিভাজিত সংসার,
যেখানে পান্তা খেয়ে শাস্তি নয়,
এক অন্তর্লীন উপলব্ধি।

পান্তা এখন রোগের উপশম —
সোশ্যাল মিডিয়ার আলোয়
পান্তা হয়ে উঠেছে প্রতিষেধক,
সুগার শুধু শরীরে নয়,
সংসারে, স্মৃতিতে,
ভেতরে জমে থাকা চাপের পাহাড়ে।

বদলি এখন এক যাত্রা —
শহরের সন্তান ভালো স্কুলে পড়ে,
আর পাহাড়ে বাবা কবিতা লেখে,
দুই জায়গায় দুই সংসার,
দুই আকাশ, দুই নদী, দুই নীরবতা।

খেদাছড়া আর গন্ডাছড়া —
পাহাড়ের নীলাভ ঢেউ, নদীর গোপন নাম,
লঙ্গাইমতী, রাইমা-সাইমা, গোমতী —
তারা নারী নয়, নদী নয়,
তারা যেন রহস্যময়ী,
হৃদয় ডুবে যায়,হাবুডুবু খায়,
কবিতা হয়ে ওঠে ‘হৃদি’।

কবিরা হৃদয়সংবেদী —
তারা স্নান শেষে নদী পার হয়,
পাহাড়ে হারিয়ে যায়,
মিশে যায় জঙ্গলের শ্বাসে।
আর ফিরে এলে
চোখে জ্বলে ঈড়াপিঙ্গলার রোদ্দুর।

নৌকা ভরে ওঠে সোনাদানায় —
সাইচাল থেকে চাম্পাই,
খুম্পুই থেকে রইস্যাবাড়ি —
সবই এক স্রোতে মিশে যায়।
প্রেম, পিরিতি, কবিতা —
সব‌ই বদলি-রোগের দাওয়াই।

জলের দরে মাছ-মাংস সহজ,
ফলমূলও হাতের মুঠোয়,
মনের খিদে মেটে না।
অফিস ফাঁকি, স্কুল ফাঁকি —
সবই পালাক্রমে চলে,
বদলি এক ভাইরাস,
সকলকে আলাদা ভাবে স্পর্শ করে।

বদলি —
ধন্বন্তরি নয়,
এক অদৃশ্য ছায়া,
ওৎপেতে বসে থাকে 
পাহাড়ের কোণে নদীর ধারে।
কবিতার ভিতরে,
হৃদয়ের ভিতরে ফিসফিস করে,
এক অনামা হৃদস্পন্দন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ