কবিতার নানা বাঁক ও বাঁক বদলের কবিতা || তৈমুর খান

কবিতার নানা বাঁক ও বাঁক বদলের কবিতা 
তৈমুর খান 
----------------------------------------------------------------------
 এক.
প্রকৃতি ও প্রেম 
  🍁
বাংলা কবিতা বারবার বাঁক নিয়েছে। ভাবের দিক দিয়ে বাংলা কবিতার মেজাজে ছিল শান্তশ্রী প্রাকৃতিক রূপ লাবণ্যে ভরা এক মায়া মুগ্ধতা। সেখানে ফুল পাখি আকাশ, গ্রামের ছোট নদী, মেঠো পথ, সোনালি ধানের শিষ, আবেগ সিক্ত মন মাতানো শিশির ভেজা নূপুরের গান। কখনো নিসর্গ আকাশ, গোধূলি, সুশীতল ছায়া,জ্যোৎস্না নক্ষত্রের স্বপ্নময় জগৎ। কবিতা যে উজ্জীবনের প্রাচুর্য স্তম্ভ তা বলেই বাহুল্য। সেখানে গ্রাম জীবনেরই ছবি বারবার ভেসে উঠত। ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় আমরা খুঁজে পেতাম। রবীন্দ্রনাথ ‘গীতাঞ্জলি’তে লিখলেন:
“আকাশতলে উঠল ফুটে আলোর শতদল। পাপড়িগুলি থরে থরে ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে, ঢেকে গেলো অন্ধকারের নিবিড় কালো জল। মাঝখানেতে সোনার কোষে আনন্দে, ভাই, আছি বসে— 
আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে আলোর শতদল।”
নিসর্গ চেতনার সঙ্গে আধ্যাত্মিক জীবনের আলো কবিতায় মিশে গেল। উপলব্ধির স্বপ্নময় জগতে বিচরণ করলেন কবি। নিজের মুক্তি রচনা করলেন। মুক্তি তোমার আলোয় আলোয় আমরা অনুভব করলাম।
 যতীন্দ্রমোহন বাগচী ‘অপরাজিতা’য় লিখলেন
“পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে, 
তবু কেন তোর অ-পরাজিতা নাম 
গন্ধ কি তোর বিন্দুমাত্র আছে? 
বর্ণ, সেও তো নয় নয়নাভিরাম!

ক্ষুদ্র শেফালি তারো মধু-সৌরভ, 
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি; 
গরবিনি, তোর কিসে তবে গৌরব— 
রূপ গুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!”
ফুলের শোভা দেখেই ফুলের পরিচয় জানতে চাইলেন। ফুলের গুণ ও রূপে আকৃষ্ট হলেন। 
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’তে লিখলেন:
“আজ আমার মনে ত না মানেরে সোনার চান, বাতাসে পাতিয়া বুকরে শুনি আকাশের গান। আজ নদীতে উঠিয়া ঢেউ আমার কূলে আইসা লাগে, 
রাতের তারার সাথে ঘরের প্রদীপ জাগেরে। চান্দের উপর বসাইয়ারে যেবা গড়ছে চান্দের বাসা, 
আজ দীঘিতে শাপলা ফুটে তারির লয়ে আশারে। 
উড়িয়া যায় হংসরে পঙ্খী, যায়রে বহুত দূর, আজ তরলা বাঁশের বাঁশি টানে সেই সুররে। আজ কাঙ্খের কলসী ধইরারে কান্দে যমুনার জল,
 শিমুলের তুলা লয়ে বাতাস পাগলরে।”
নারী পুরুষের প্রেমের মাধুর্য বিরহ মিলনের পরম্পরায় যে কাহিনি ও রোমান্সের জন্ম দিল তা সেই  হৃদয়ের আবেগ ও আকুতিরই পরিচয়। প্রকৃতির অন্তর্বতী এই কল্পনা ও বিবৃতির মধ্য দিয়েই বাংলা কবিতা তার অবস্থান সূচিত করেছে। কল্পনা ও চিরন্তন আবেগের কাছেই কবিরা দায়বদ্ধ থেকেছেন। এভাবেই কবিতায় বাহিরে জগতকেই কবিরা বেশি দেখেছেন। আবেগের সঙ্গে প্রকৃতির সামঞ্জস্য খুঁজেছেন। সাহিত্য এই কারণেই সহিতের তত্ত্ব অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে হৃদয়ের মিলন। বাহিরের সঙ্গে অন্তরের সংযোগ। 

          দুই. 
        বিশ্বযুদ্ধ 
             🍁
   কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যে অবক্ষয়িত ও মূল্যবোধহারা সমাজ গড়ে উঠেছিল, রণ-রক্ত-রিরংসার উদ্ভব ঘটেছিল তাতে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। স্থির হয়ে প্রকৃতিকে দু’দণ্ড নিরীক্ষণ করার সময় তাদের ছিল না। মৃত্যুর ছায়া যেন মানুষের পেছনে পেছনে অগ্রসর হয়ে আসছিল। বিশ্বাসহীনতা, অস্থিরতা, ক্লান্তি ও বিষণ্নতা এবং হতাশা তাকে গ্রাস করেছিল। সমর সেন তাই লিখেছিলেন:
“হে শহর,বিষণ্ণ শহর!
সূর্য অস্ত গেলে
কোনো কোনো পথে
ছায়া পড়ে মন্থর উটের,
মরুভূমির ক্লান্তি গায়ে লাগে,
হে শহর, বিষণ্ণ শহর!”
(লোকের হাটে:সমর সেনের কবিতা) 
বিমূঢ় সন্ত্রস্ত অসহায় সভ্যতার রূপ কবির চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাত্রির দূষিত রক্তে বিকলাঙ্গ দিনের প্রসব হলো। কাকেরা ধ্বংসের গান গাইল। পৃথিবীর শেষ প্রান্তে করাল শূন্যের বৃত্তে নাভিচ্যুত শূন্য যেন কাঁদল। টি এস এলিয়টের The Waste Land হয়ে গেল মানবসভ্যতা। The hollow men-এ এলিয়ট লিখলেন মানুষের স্বরূপ:
“We are the hollow men
    We are the stuffed men
    Leaning together
    Headpiece filled with straw. Alas!
    Our dried voices, when
    We whisper together
    Are quiet and meaningless
    As wind in dry grass
    Or rats' feet over broken glass
    In our dry cellar
    Shape without form, shade without colour,
    Paralysed force, gesture without motion;”
অর্থাৎ
     আমরা ফাঁপা মানুষ
    আমরা খেলনা মানুষ
    একসাথে হেলান দিয়ে
    শিরস্থান ভরা খড়। হায়রে!
   আমাদের শুকনো কন্ঠস্বর, যখন
   আমরা একসাথে ফিসফিস করি তখন
   শান্ত এবং অর্থহীন হয়
    শুকনো ঘাসে বাতাস
    বা ভাঙা কাচের উপরে ইঁদুরের পায়ের মতো
    আমাদের শুকনো কোষাগার
    আকারহীন আকার, রঙহীন ছায়া,
    পক্ষাঘাতগ্রস্ত শক্তি, গতিহীন অঙ্গভঙ্গি;
মস্তিষ্কের বদলে খড়ের মানুষ হয়ে উঠল সভ্যতার মানুষ। বুদ্ধিহীন, হৃদয়হীন, স্বপ্নহীন খেলনার মতো জেগে থাকল।তার যেন কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কোনো দিশা নেই। জানালায়  উটের গ্রীবার মতো অন্ধকার চেয়ে রইল। অথচ সভ্যতার আয়োজনের খামতি নেই। নারী-পুরুষের প্রেমের গুঞ্জনও শোনা যায়। কিন্তু কোথাও প্রেম নেই। ‘এইখানে সূর্যের’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখলেন:
“রেলের লাইনের মতো পাতা জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্তহীন কার্যকারিতায়— 
সুখ আছে, সৃষ্টি নেই। অনেক প্রসাদ আছে, প্রেম নেই।
অনেক কল্যাণশীল নগর জাগছে;
সেইখানে দিনে সূর্য নিজে,
নিয়ন টিউব গ্যাস রাত্রির; 
উন্মুক্ত বন্দর সব নীল সমুদ্রের পারে-পারে মানুষ ও মেশিনের যৌথ শক্তিবলে
 নীলিমাকে আটকেছে ইঁদুরের কলে।’' 
সৃষ্টিহীন বন্ধ্যা সভ্যতায় অঢেল ভোগের প্রাচুর্য থাকলেও সৃষ্টি নেই। নগর, প্রাসাদ, সূর্য, নিয়ন টিউব, প্রযুক্তিবিদ্যা সবই সভ্যতার আয়োজন। তবু প্রেম নেই। হৃদয় নেই। নাগরিক জীবনের এই যন্ত্রণা, যান্ত্রিকতা, মানুষ আছে, তবুও মানুষ নেই বারবার মনে হয়েছে কবির। নারীর হৃদয়, প্রেম,শিশু,গৃহ, অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা কিছুই তাকে শান্তি দিতে পারেনি। রক্তের ভিতরে এক বিপন্ন বিস্ময় জন্ম নিয়েছে। যা সর্বদা বিচ্ছিন্ন, একাকিত্ব, ক্লান্ত করে চলেছে। প্রকৃতির মহিমা ক্ষুন্ন হয়েছে। জটিল নাগরিক জীবনের ফাঁদে নীল আকাশও খণ্ডিত। ইতিমধ্যে ঘটেছে দেশভাগ। সারা বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে উদ্বাস্তু সমস্যা। গৃহহারা ছন্নছাড়া মানুষ হাহাকার ক্ষুধাজীর্ণ জীবন নিয়ে ছিটকে পড়েছে। কবিতা তখন ফিরে এসেছে বাহিরে জগৎ থেকে ভেতরের জগতে। শুধু বাহিরের অন্ধকার নয়, ব্যক্তিজীবনের ভেতরেও অন্ধকার। শুধু মিছিলের শ্লোগান নয়, ব্যক্তিজীবনের স্বপ্নদের বেঁচে থাকারও শ্লোগান; শুধু দেশ ভাঙার যন্ত্রণা নয়, ব্যক্তিসত্তার ভাঙনও বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। কোন্ সত্য, কোন্ বিশ্বাসকে মানুষ অবলম্বন করতে চায়? তা সে নিজেই জানে না। ঈশ্বরের প্রতিও তার বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্র, বিজ্ঞান, প্রচলিত মানবিকতা বোধ, ধর্ম কোনো কিছুই তাকে আশ্বাস দিতে পারেনি।কোনোকিছুই তার কাছে সমাধান নয়। সুতরাং তার নিজের মধ্যেই দেখা দিয়েছে আত্মনির্বাসন। ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে একা হয়ে উঠেছে।
     কল্লোল যুগের কবিরা যখন রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করে যুক্তি, বিজ্ঞান, মানবিকতাকে পুঁজি করে আধুনিক কবিতার পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন; তখন তাঁদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল এই নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা, বিচ্ছিন্নতা, ছিন্নমূল জীবনের অনিশ্চয়তা এবং এক গভীর বিষাদগ্রস্ততা। তখনও কবিতার বাঁক বদল ঘটেছিল। কবিতার ভাবে, ভাষায়, আঙ্গিকে এসেছিল এক নতুন দিশা। ‘ফেরারী ফৌজ’ কাব্যের ‘কথা’
কবিতায় প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন:
“হাত দিয়ে হাত ছুঁই
কথা দিয়ে মন হাতড়াই,
তবু তারে কতটুকু পাই।”
এখানেই না পাওয়ার যন্ত্রণা, কিংবা পেয়েও হারানোর ব্যথা, কিংবা বিশ্বাসহীনতার দোলাচল প্রতিটি ব্যক্তিকেই গ্রাস করেছিল। তাই প্রেমেও শান্তি ছিল না। বেঁচে থাকার মধ্যেও আনন্দ ছিল না। জীবনের মধ্যেও স্বপ্ন ছিল না। সবাই যুগের দিশেহারা পথিক। যেদিকেই চেয়ে দেখেন চারিদিকেই মরুভূমি। উটপাখির মধ্যে দিয়ে তখন সুধীন্দ্রনাথ দত্তও দেখলেন:
“কোথায় লুকাবে? ধূ-ধূ করে মরুভূমি;
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম, মহাকাশ।
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কি ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।”
নিষ্ফল অবলম্বনহীন জীবনের এই শূন্যের দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকে। যে শূন্য আমাদের অন্তর্গত বিপন্ন বিস্ময়ের ধারক। যে শূন্য আমাদের নিরাময়হীন চেতনার বিশাল ফাঁকা মাঠ। যে শূন্য আমাদের সৃজনহীন বন্ধ্যা জমি। কবিতা এই নাথিংনেস বা এম্পটিনেসের বাজনা হয়ে উঠল। কখনো বিশাল স্পেস নিয়ে কবিতা রহস্যময় জীবনের বহুমুখী জটিল স্বরূপকে তুলে আনার চেষ্টা করল। কখনো প্রেম ও প্রেমহীনতার মাঝে আত্মগত এক বিষণ্ণতার সেতু হয়ে উঠল। তখন এই শূন্যতাতেই ঠিকানা খুঁজে পেলেন কবি শঙ্খ ঘোষও। ‘শূন্যের ভিতরে ঢেউ’ কবিতায় লিখলেন:
“কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?”
জলের কিনারে নিচু জবা শক্তি ও সাধনার প্রতীক কখনো শূন্যতাতে মিলিয়ে যেতে পারে না। সেখানেও ঢেউ ওঠে। সংরাগের  রুপোলি ছাই চিতার শেষেও জেগে থাকে তার রং নিয়ে। পথের শেষ ট্রামও বিশ্রামে যেতে চায়। যে আমাকে কাঁদায় সেকি অমনি ছেড়ে যাবে? শূন্যের ভেতরে ঢেউকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। নিচু জবাকে আমরা তুলে আনতে পারি সামর্থ্য দিয়ে। কবিতা ক্রমশ বাঁক বদলের দিকেই অগ্রসর হতে চাইল। 

        তিন. 
অনন্ত মুক্তির পথ 
    🍁
বাইরের কোলাহল থেকে কবিরা উপলব্ধিকে গুটিয়ে আনলেন নিজের ভিতরে। ভিতরের নিস্তব্ধতা ভাষা হতে চাইল কবিতার। সেখানে বিবৃতি বর্ণনা বাহুল্য মনে হলো। মূলত সাংকেতিক রূপকধর্মী ভাষা বেশি প্রশ্রয় পেল। আবেগ মেধাবী বসতি চাইল। যে তীব্র ঝাঁজালো স্রোত ছিল আবেগের, তা হলো স্তিমিত, সূক্ষ্ম, বুদ্ধিদীপ্ত। তাই প্রথম জীবনে জীবনানন্দ দাশ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কাজী নজরুল ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হলেও সেই আবেগকে পরবর্তীকালে বর্জন করেছিলেন। কবিতায় এনেছিলেন এক মেধাবী উত্তরণ। যদিও সেখানে অবচেতনের প্রভাব বেশি পড়েছিল। নির্জ্ঞান মনের স্বয়ংক্রিয় অভিযাপনে অস্তিত্ব সঞ্চার ঘটেছিল। তখন স্বাভাবিকভাবেই সনাতন পাঠকের কাছে কবিতাকে দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল।
   ভারতচন্দ্র থেকে মধুসূদন দত্ত যেভাবে বাঁক পরিবর্তনের ধারায় কাব্য নির্মাণকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। ভাবে প্রকরণে এক ভিন্নমাত্রার ভিন্ন স্বাদের প্রজ্ঞায় চালিত করেছিলেন। দেবতাকেন্দ্রিকতা থেকে মানবিক চেতনার অফুরন্ত ফোয়ারায় সিক্ত করে তুলেছিলেন তা ছিল যুগসন্ধি থেকে নতুন যুগেরই উত্তরণ। সময় চেতনার সঙ্গে জাতীয় ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে, মেঘনাদকে ও রাবণকে জাতীয় হিরো ও মহানুভবতার প্রতীক করে তুলে এবং পয়ারকে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রূপ দিয়ে সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। প্রবহমান অমিত্রাক্ষর পরবর্তীকালে মুক্তক ছন্দের রূপ পায়। জীবনানন্দ দাশ যুগের সংকট, হতাশা, ক্লান্তি,দৈন্য, বিপন্নতা, নৈরাশ্য প্রভৃতিকে ব্যক্তি হৃদয়ে ধারণ করেও অবদমন ও শূন্যতাকে নগ্ন নির্জন হাতের কাছে এনে দাঁড় করিয়েছেন। কখনো বিড়াল, কখনো সেই সব শেয়ালেরা কিংবা কখনো মহীনের ঘোড়ার রূপকে নিজস্ব স্বরূপকে বোঝাতে চেয়েছেন।সুররিয়ালিজমের প্রভাবে কবিতায় এক মুক্তি এনেছেন। অদ্ভুত আঁধারের পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবার—আর তখনই কবিতার এই বাঁক পরিবর্তন। সুররিয়ালিজমে আছে মুক্তি, পার্থিবতা ও বাস্তবতার বাঁধন সেখানে শিথিল। আছে নিজেকে বিস্তৃত করার ও মহাজীবনে উত্তরণের প্রশস্ত পথ। তাই ‘ধূসর পাণ্ডুলিপির’ ‘অনেক আকাশ’ নামক কবিতায় বলেছেন:
“জোনাকির পথ ধরে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে
দেখিতে চেয়েছি আমি—নিরাশার কোলে বসে একা
চেয়েছি আশারে আমি—বাঁধনের হাতে হেরে হেরে
চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা।”
এই অগাধ ও অনন্ত পথের যাত্রীর কবি আজকে অনেকেই। ব্যক্তি জীবনের অন্তরায়গুলি খণ্ডন করার পথ খুঁজেছেন। 
বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ এই পথেই হেঁটে ছিলেন কবিতায়:
“আমগাছ জামগাছ কাঁঠালগাছের শ্যাম
ক্রমাগত মুছে মুছে উঠে আসছে তরুণ বিল্ডিং,
নিভে যাচ্ছে ঘাস, উবে যাচ্ছে নিবিড় বৃষ্টির দিন;
তবু তোমাকে কেন্দ্র রেখে একদিন ঝরেছে যে-পাতার শিকল
ধরিত্রীরই কোনোখানে যে-সব রয়েছে অবিকল--
অনশ্বর, অবিচ্যুত, স্বপ্নবিদ্ধ, নির্লিপ্ত, সকাম ॥”
                                     (গ্রীন রোড)
অথবা আরেকটি কবিতায় লিখেছিলেন:

“পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো।
এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল।
পদ্মায় গিয়েছে একটি— মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়—
আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ
ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে।
পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে
এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে॥”
                             (পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ)
পবিত্র মুখোপাধ্যায় একটি কবিতায় লিখলেন:
“মুখোশ, মুখোশ শুধু, চারিদিকে মুখোশের ভিড়;
আমাকে অস্থির
ক’রে তোলে, নিরুপায় হয়ে তুলি হাত
আকাশে,…খটখটে মেঘ-রোদ্দুরের অনির্বচনীয়
সুন্দর নির্মাণ করে চিরায়ত আর এক পৃথিবী;
আমি চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।
এখন মুখোশ যুদ্ধে কেউই পরে না ছদ্মবেশ,
স্বাভাবিক দেখে ভাবি—আড়ালে নেকড়ের চোখ জ্বলে;
ধারালো নখের লক্ষ্য ঢেকেছে আস্তিনে।
আমি অক্ষরের যাদুবলে
মুখোশের আড়ালে যে মুখ, তাকে চিনে
নিতে গিয়ে দেখি, তাও
প্লাস্টিক সার্জারী করা, অন্য আগন্তুক।”
                 (মুখোশ,মুখোশ শুধু)

কবিতার ভাষা ও বিন্যাস পাল্টে গেছে। যুক্তি ও বাস্তবতারও উল্লঙ্ঘন ঘটেছে। মুখোশের আড়ালে যেমন মুখ ঢেকে গেছে, তেমনি প্রকৃত সত্যও গোপন থেকে গেছে। অথচ জীবনের দাবি গভীর প্রজ্ঞাপনে তার অন্তর্মুখহীনতাকে খুলে দিয়েছে। এভাবেই কবিতায় বাঁক পরিবর্তনের ক্রিয়া সংযোগ ঘটে চলেছে।সমীর রায়চৌধুরী, রবীন্দ্র গুহ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান,আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ অধিকাংশ কবিই সাহিত্যে পরাবাস্তবকে গ্রহণ করেছেন। ফরাসি কবি জ্যঁ আর্তুর র‌্যাবোঁ প্রথম এই সুররিয়ালিজম বা পরাবস্তকবাদের সূচনা করেছিলেন। স্বেচ্ছাধীন স্বতঃস্ফূর্ততার মাধ্যমে অসীম, অনন্ত ও অচেনা জগতের সন্ধান ছিল তাঁর কবিতায়। যে জগৎকে পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা আবদ্ধ করা যাবে না, অনুভূতির দ্বারাও পাওয়া সম্ভব হবে না, কল্পনাও সেখানে সর্বদা পৌঁছাতে পারবে না। অদ্ভুতুড়ে এক স্বয়ংক্রিয় আত্মযাপনের মাধ্যমে কবির স্ব-অভিযান চলতেই থাকবে। ‘লেজ ইল্ল্যমিনাসিওঁ’ কাব্যের ‘ভোর’ নামের একটি কবিতার সামান্য অংশ :
“জড়িয়ে ধরি গ্রীষ্মের ভোর।

প্রাসাদগুলোয় এখন সারা শব্দ নেই।
মৃত জল। ছায়ারা এখনো অরণ্য পথে
ক্যাম্প করে আছে। হাঁটছি, উষ্ণ নিঃশ্বাস নিচ্ছি;
ঝলমলে রত্ন, শব্দহীন ডানার ঝাপটানো।”
অংশটিতে জড়িয়ে ধরা গ্রীষ্মের ভোরকে যেমন দেখতে পাই, তেমনি চুপচাপ থাকা প্রাসাদগুলোকে, মৃতজলকে, অরণ্যপথে ছায়াদের ক্যাম্পকে এবং শব্দহীন ডানার ঝাপটানোকে। শুধু নিজস্ব উষ্ণ নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্রিয়াটিতে ব্যক্তিক কবিকে বুঝতে পারি। ঝলমলে রত্নের উপস্থিতিও কোনো অনৈসর্গিক বা অপার্থিব প্রাচুর্যের সন্ধান দেয়। তাঁর ‘নরকে একটি ঋতু’ কাব্যটিও এই স্বয়ংক্রিয় অনন্ত দর্শনের অভিরূপ প্রজ্ঞায় সর্বদা স্বতশ্চল । আজকের দিনে যখন বাঁক পরিবর্তনের ধারাকে লক্ষ করি, তখনও উঠে আসেন বহু কবি। মহাজীবনকে ধারণ করেই এই সময়ের কবি 
গোলাম রসুল লেখেন:
“যেন এক পাগলা আয়না আমাকে তাড়া করছে

আয়নাটা আমাকে কামড়াচ্ছে

মানুষ ভর্তি আমি পালাচ্ছি 

আমি পালিয়ে যাচ্ছি
শব্দের সাথে
ঘড়ির সময়ের সাথে 
সূর্য যখন ইতিহাস লিখছে তার সাথে

আমি পালাচ্ছি
একখানা বইয়ের কয়েকটা পৃষ্ঠা যা নিঃশ্বাস নিচ্ছে আয়নার ফুসফুসে 
তার সাথে

এটা তাই 
যা  আমার ভোরবেলায় দেখা দুঃস্বপ্ন

এটা একটা রাজার পোষা আয়না 

এটা একটা পাগল হয়ে যাওয়া আয়না 
যার মুখে ঠাসা পেরেকের হাসি 
এটা ধুমকেতুর সাথে বাঁধা একুশ শতক
ছুটে বেড়াচ্ছে এমাথা ওমাথা” 
                       (একটা পাগলা আয়না) 
 মহাকাল আর মহাসময়ের অপার্থিব এক সংযোগ আমরা দেখতে পাই কবিতাটিতে। আয়নার আচরণ জীবিত আত্মার মতো—তাড়া করা, কামড়ানোতে প্রকাশ পেয়েছে। আবার কবি শুধু ব্যক্তি নন, তিনি মানুষ ভর্তি—পলায়ন ক্রিয়াতে ঘড়ির সময়ের উর্ধ্বে তার বিস্ময়কর অভিমুখ। সূর্যের ইতিহাস লেখাতেও এবং বইয়ের পৃষ্ঠার নিঃশ্বাস নেয়াতেও মেটাফোর অলংকার এর প্রয়োগ উপলব্ধির মাত্রাকে ভিন্নতা এনে দিয়েছে। পাগল হয়ে যাওয়া আয়নার মুখে ঠাসা পেরেকের হাসি, মহাকাশের ধুমকেতুর সাথে বাঁধা একুশ শতকের ছুটে বেড়ানো কল্পনার পক্ষেও সম্ভব নয় তাকে বিবৃত করা।  মেটাফোর এবং মেটাফিজিক্সও বাংলা কবিতায় প্রভাব  ফেলে চলেছে। তাই প্রাণ আর নিষ্প্রাণের তফাত ঘুচে গেছে। বস্তুও হয়েছে প্রাণধর্মে উজ্জীবিত। প্রজ্ঞা ও প্রবৃত্তিতে সম্মোহিত করেছে কবিকে। 

         চার. 
    শিল্পীর জগৎ 
        🍁
     পাশ্চাত্য ভাবনার আরেকটি শিল্প আন্দোলন হল কিউবিজম। কিউবিজম শিল্পীর সৃষ্ট জগৎ ও প্রকৃতিই এর প্রধান লক্ষ্য। শিল্পীই তাঁর বাস্তবতা ও রহস্যের গোলকধাঁধা সৃষ্টি করেন। পাল সেজান এই প্রসঙ্গে বলেছেন : “Art is a harmony parallel with nature."(Paul Cezanne, Cezanne. Mont Sainte Victoire) 
অর্থাৎ শিল্পও প্রকৃতির সমান্তরালভাবে গড়ে উঠবে। এই ধারার কবিতা বাংলা সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। এরকমই একজন কবি নিখিলকুমার সরকার। তিনি কবিতায় আত্মা স্থাপন করেছেন ভেতর থেকে, বাহিরের জৌলুসে তাঁকে স্পর্শ করা যায় না। গদ্য চালে সাংকেতিক ভাষার কথন ভঙ্গিতে এবং কোথাও সংলাপধর্মী আবেদনে কবিতায় অনন্যতা এনেছেন। মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াগুলির দ্বান্দ্বিক পারম্পর্যকেও কথন ভঙ্গির অন্তরালে প্রতিস্থাপন করেছেন। গতিময় রোমান্টিকতার সাথে অন্তর্দ্বন্দ্বের ভাঙনগুলিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আত্মক্ষরণের অমোঘ পর্যটনে মানব প্রবৃত্তির আশ্চর্য ও আদিম চেতনাকে তিনি ভাষা দিতে পেরেছেন। 
প্রচলিত কাব্যরীতির বাইরে সমকালীন ভাষাকল্পকে ভিন্নচিন্তনের আদল দিয়েছেন। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘মারুবেহাগ’ কাব্যে লিখেছেন:
 "আমি যেন-বা সত্তাহীন সত্তা, অন্ধ পিণ্ড এক, পা টেনে টেনে
চলেছি সেই অসম্পূর্ণতায়, যেখানে অপেক্ষা করছে 
আমার অন্তিম শিরোনাম, আত্মজ সাদা ফুলস্কেপ, আর 
আত্মহত্যার আপডেট টেকনোলজি" 
  একদিকে আছে জীবনবীক্ষা, অন্যদিকে অনন্তজীবন অর্থাৎ ব্রহ্মজীবনের দিকে যাত্রা। একদিকে অপূর্ণতা বা অসম্পূর্ণতা, অন্যদিকে পূর্ণতায় পৌঁছানোর প্রয়াস। অনন্ত পয়ারের জাগ্রত শরীরে আত্মরতির সুখের উচ্চারণ। আরও দুটি অংশে লিখেছেন:
"রন্ধনপ্রণালী অপেক্ষা করিতেছে, অথচ মন কোনো উদাসীন ঝুলবারান্দায় মাত্রাবর্জিত অজ্ঞাতবাসে"।
 "যতটা নৃশংস হলে আস্ত পাঁউরুটি অবলীলায় কেটে দু'ভাগ করা
 সম্ভব, ততটাই নির্বিকল্প নৃশংস হওয়া চায়—" 
যেমন ‘রন্ধনপ্রণালী' শব্দটি ব্যবহার করে কাব্যকুশালী কবি কাব্যের অনন্য স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। তেমনি 'নৃশংস' শব্দটির ব্যবহারেও নিজস্ব শৈলীর পরিচয় দিয়েছেন। দুটি ক্ষেত্রেই শব্দের বিনির্মাণ তত্ত্ব প্রযুক্ত হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই ধরা পড়ে Taste of the Arts যাকে ফরাসি লেখক গুস্তাভ ফ্লোব্যের (১৮২১– ১৮৮০)বলেছেন :
"The art of writing is the art of discovering what you believe."
অর্থাৎ লেখার শিল্প হল আপনি যা বিশ্বাস করেন তা আবিষ্কার করার শিল্প। এখানে কবির বিশ্বাসের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করারই মুহূর্তগুলিই ধরা পড়েছে।নিজেকে আবিষ্কার করা, নিজের অস্তিত্বকে অন্বেষণ করা কবিতার এক নতুন বাঁক বৈকি। কিউবিজম যে কবির সৃষ্টি বাস্তবতা বা কবির সৃষ্টি সত্যতা নির্ণয় একথা বলাই বাহুল্য। 

    পাঁচ. 
অস্তিত্ব সন্ধান
🍁
  এই মুহূর্তের আরেক অগ্রগণ্য কবি সৈয়দ কওসর জামাল ‘স্বপ্নের ভিতর বৃষ্টি পড়ে’ নামক একটি কবিতায় লিখেছেন তাঁর সেই আত্মআবিষ্কারকে:
“বিপর্যস্ত প্রবাস উড়ানে ডানা ঝাপ্টায় পাখিরা
জীবনের খানাখন্দ ভরে ওঠে সৌন্দর্যে, বিপুল গরিমায়
যত উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে চোখে, তত ক্ষয় ভিতরে ভিতরে
এই ভয়ে যারা নিজেদের রুদ্ধ করেছিল, বেরিয়ে এসেছে
বাইরে কঠিন ভাবলেশহীন মুখ করে চেয়ে থাকি দূরে
বৃষ্টি যদি প্রণয়দর্শন তবে কে কাকে দেখাবে পাঠ হৃদয়ের
এমন জল্পনা থেকে অধিবিদ্যা, মরমিয়া কাব্যরীতি শিখি
অপার্থিব আলোর প্রতীক হয়ে জ্বলে অঙ্গরাগ
স্বপ্নের ভিতরে দেখি জন্মান্তর, মায়ার প্রলেপ
একহাতে তৃষ্ণা, আর অন্যহাতে সুধাভাণ্ড তুমিও এসেছ                               
স্বপ্নের ভিতরে তুমি চেয়েছিলে প্রিয় যুবকের অভিলাষ
পরিবর্তে এই বিধিলিপি, রাত্রি এসে পরিমাপ করে যায়
          আলো চুঁইয়ে পড়া ছিদ্রগুলো”

জীবনের খানাখন্দ বিপুল ঐশ্বর্যে ভরে উঠলেও, উজ্জ্বলতা প্রখর হলেও ভিতরে ভিতরে অসহায় এক ক্ষয় জীবনের আবিষ্কার করেন। বাইরে কঠিন ভাবলেশহীন চাহনি থাকলেও প্রণয়দর্শন বৃষ্টিকেও দেখানো সম্ভব হয়নি। তাই হৃদয়ের পাঠ অধিবিদ্যা মরমিয়ায় কাব্যরীতির অপার্থিব আলো পেয়েছে। স্বপ্নের ভিতরেই জন্মান্তর ঘটেছে। স্বপ্নচারীর অস্তিত্ব সঞ্চারের এই চেতনাপ্রবাহ যে অন্তর্মুখীন—তা বোঝাই যায়। জাপানি মাল্টিমিডিয়া শিল্পী, গায়ক, গীতিকার এবং শান্তিকর্মী ইয়োকো ওনো(১৯৩৩) তাঁর উদ্ধৃতি কোষে বলেছেন:
“You may think I’m small, but I have a universe inside my mind.”
আপনি ভাবতে পারেন আমি ছোট, কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটি মহাবিশ্ব আছে। এই মহাবিশ্বই হলো অস্তিত্ব। কবিরা এরই সন্ধান করেন। কওসরর জামাল ‘আলোর স্বভাবে’এই গতিকে আরো স্পষ্ট করেছেন:
“যতই স্বপ্নের কথা বলো,
ফ্যাকাসে দৃষ্টির মধ্যে যেকোনো রংরেখা
.                                 নিঃসঙ্গতার কক্ষপথ
বিরোধাভাসের ছায়া আমাকে করেছে স্বপ্নহীন
স্মৃতি, শুধু স্মৃতিই সম্বল করে পথিক চলেছে
আলো নেই পদচিহ্ন নেই
তবুও এগোই আমি স্রোতের ওপরে কোনো
.                                      নৌকার মতন
ছিন্ন পাল, নামহীন, একা”
বিরোধাভাস, স্বপ্নহীনতা, নিঃসঙ্গতা, ক্ষুদ্রতা সবকিছুই তাঁর বিশ্ব। সবকিছু নিয়েই তিনি মহাবিশ্বে পৌঁছাতে চান। ব্যক্তি তখন বিশ্ব, সময় তখন মহাসময়, পৃথিবী তখন মহাপৃথিবী, আকাশও তখন মহাকাশ। এভাবেই অনন্ত সাধনার পথ পরিক্রমায়  কবিরা শামিল হয়েছেন। 
      

     ছয়. 
স্বয়ংক্রিয় জগৎ
🍁
আধুনিকতাবাদকে অস্বীকার করে অর্থাৎ প্রচলিত যুক্তি, বিজ্ঞানকে, মানবতাবাদ ও শৈল্পিক ধ্যানধারণার একমুখীনতাকে পুরোপুরি ত্যাগ করে যাঁরা অধুনান্তিক সাহিত্যের পথে নিজেকে চালিত করতে পারেন তাঁরা সাহিত্যে আরো একটি নতুন বাঁকের জন্ম দিয়েছেন। এঁদেরই সাহিত্য পোস্টমডার্ন বা অধনুাান্তিক বা উত্তর আধুনিক সাহিত্য। মলয় রায়চৌধুরী, প্রভাত চৌধুরী, মুরারি সিংহ, আফজাল আলি, উমাপদ কর, দেবাশিস সাহা, অনুপম মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বহু কবি।
‘হাততালি’ নামক একটি কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন:
“তারপর পলিতকেশ কাশফুলে
পইপই বারণের পুশতুভাষী দুর্যোধন বেরিয়ে পড়েছে
দগদগে রোদে
চন্দনরক্তের পাথর পোশাক রক্ষীদের সরিয়ে
অন্ধকারকে খুঁচিয়ে বের করে এনেছেন সকালের বিকল্প
কাঁচা নরকের উদাত্ত অনুভব
হাহ
রোগা পৃথিবীর শিয়রে রাতজাগা নেশুড়ে
হরতালের দরুন ক্রুশকাট থেকে নামতে পারেনি হাততালি
চোখে জলসুদ্ধ হেসেছে শিশুরা
একথোকা অন্ধকারে জোর-করে দেখানো স্বপ্নে
যাত্রীডুবির খবরে ডুকরে উঠেছেন লালসালু-নৌকার হাততালি
না খেতে পাওয়া হলুদ শীতে
গরম আলকাতরায় ফোটা ফর্সা রজনীগন্ধা
যখন নরুন-খোদাই বাতাসে
নিকেল চকচকে বিচিবীজ
কাঁধে চাঁদ নিয়ে ভররাত শাসিয়েছে শ্যাওলাধরা করোটি
ঘাসফুলে না ফোঁপানো ফড়িংপুরুষ
বারবাডোজ পেশির ব্রোঞ্জপুরুষরা
জ্বরগরম কপাল ছুঁইয়েছে তাঁর”
কবিতাংশটিতে উত্তর-আধুনিক সাহিত্যের যা বৈশিষ্ট্য তা সম্পূর্ণরূপে ফুটে উঠেছে। কবিতাটিতে যুক্তির একমুখীনতাকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলা হয়েছে। আবেগের সমউপস্থিতি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা, বহুরৈখিক বিন্যাস, ক্রমান্বয়হীনতা, হাততালি উল্লেখ থাকলেও বিষয়হীনতা,মুক্ত আঙ্গিক এবং অফুরন্ত মর্মার্থের ফোয়ারা এবং নতুন শব্দবন্ধ কাব্যের বাঁক পরিবর্তনকে ভিন্ন পথে নিয়ে গেছে। পোস্টমডার্ন ভাবনার অন্যতম রূপকার জেমস রবার্ট জারমুশ (১৯৫৩) যিনি একজন আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার, সর্বদা নিজেকে ব্যতিক্রমী জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলেন। শিল্পেও তার প্রকাশ ঘটান। তাঁরই এবিষয়ে একটি স্মরণীয় উক্তি হল:
"কিছুই আসল নয়। অনুপ্রেরণার সাথে অনুরণিত হয় বা আপনার কল্পনাকে জ্বালাতন করে এমন যেকোনো জায়গা থেকে চুরি করুন। পুরানো ফিল্ম, নতুন ফিল্ম, মিউজিক, বই, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফ, কবিতা, স্বপ্ন, এলোমেলো কথোপকথন, স্থাপত্য, সেতু, রাস্তার চিহ্ন, গাছ, মেঘ, জলের দেহ, আলো এবং ছায়া গ্রাস করুন। আপনার আত্মার সাথে সরাসরি কথা বলে চুরি করার জন্য শুধুমাত্র জিনিসগুলি বেছে নিন। আপনি যদি এটি করেন তবে আপনার কাজ (এবং চুরি) খাঁটি হবে। সত্যতা অমূল্য; মৌলিকতা অস্তিত্বহীন। এবং আপনার চুরি গোপন করতে বিরক্ত করবেন না—আপনি যদি এটি পছন্দ করেন তবে এটি উদযাপন করুন। যাই হোক না কেন, জিন-লুক গডার্ড যা বলেছিলেন তা সর্বদা মনে রাখবেন: 'আপনি যেখান থেকে জিনিসগুলি নিয়ে যাচ্ছেন তা নয়—এটিই আসল যেখানে আপনি সেগুলি নিয়ে যাবেন।'" 
[মুভিমেকার ম্যাগাজিন #৫৩—উইন্টার, জানুয়ারি ২২, ২০০৪]
এই লেখা থেকে বোঝা যায় উত্তর আধুনিক সাহিত্যের উৎস কোথায়। 
ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, সাংবাদিক এবং হাংরিয়ালিজম্ ও পোস্টমডার্নিজম্ এর রূপকার মলয় রায়চৌধুরীকে এক বহুমুখী উত্থান ও জীবনপর্যটক বলেই মনে হয়েছে আমাদের। পরিবর্তনশীল জগতের প্রবহমান অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ঝংকৃত ও পরিব্যাপ্ত। শুধু কুশলী শিল্পী হিসেবে নয়, শিল্প ভাঙার শিল্পী হিসেবেও। তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রিত ও সীমায়িত হতে চাননি। সামাজিক হয়েও সমাজমননের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন। শরীরবৃত্তীয় পর্যায়গুলি সক্ষমতার সঙ্গে লালন করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখায় ফিরে আসে মগ্নচৈতন্যের অবধারিত ক্রিয়াকলাপ। প্রজ্ঞানাচারী বৈভাষিক মিথলজি ।  প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শয়তানের মুখ” জলবিভাজিকার ক্রমিক বিন্যস্ত থেকে উঠে আসে সত্তার বহুমুখীন পর্যায়। ঐতিহ্যকে ভেঙে ঐতিহ্য গড়া, আবার তাকে অস্বীকার, ক্রমবর্ধমান এই প্রবাহ থেকেই তাঁর লক্ষ্যহীন লক্ষ্য।  অনুবাদের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন —  উইলিয়াম ব্লেক, জাঁ ককতো, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, ব্লাইজি সঁদরা, ত্রিস্তান জারা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পাবলো নেরুদা এবং ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা। প্রতিটিতেই স্বকীয়তার ছাপ স্পষ্ট। তবু নিজের কাজের জন্য তিনি প্রশংসা, পুরস্কার কিছুই গ্রহণ করেননি। সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জানেন সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। এই মাহাত্ম্য তাঁকে আরও সুউচ্চতা দান করেছে। 
    রুদ্র কিংশুক নামে এই ধরার আরেকজন কবি তাঁর ‘ইশপাদেবতার সূর্যসন্ধান' কাব্যে নতুন চিন্তা-চেতনার টেক্সট নির্মাণে পেইন্টিংয়ের মিউজিকের লোকায়ত সাহিত্য ও দর্শনের বিভিন্ন উপাদানের সম্মিলন ঘটিয়াছেন। তিনি বলেছেন : "মুথাঘাসীয় গঠনের এই টেক্সট কোনো নির্দিষ্ট মেটাফর বা অর্থকেন্দ্রিক নয়। নঞর্থকতার আলোর সন্ধানে ব্রতী এই টেক্সট, যার অবস্থান প্রথাগত ক্যাননের বাইরে।" একথা যে সর্বার্থেই সত্য হয়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। 'মুথাঘাসীয়' ব্যাপারটি হল তলায় তলায় এক শিকড় সংযোগ। কাব্যের বিচ্ছিন্ন দৃশ্য, টুকরো বাক্য, শূন্যতার বিন্যাস, অর্থহীনতার প্রজ্ঞা, নীরবতার স্পেস সবকিছুরই এক সমন্বিত আকর্ষণ যাকে আলাদা করে ভাববার অবকাশ নেই।কাব্যটির একটি অংশ কেটে নিয়ে যদি এভাবে সাজাই:
"রুদ্রাক্ষের গাছের কাছে একদিন দাঁড়াব,
 মাথায় রহুতা দিনের নীল ভরে উঠবে অতর্কিতে,
টিয়া-ঝাঁক ভাষাতীত শূন্যতা,
তার ভেতরে ঘূর্ণমান সেতু,
আমি প্রতিটি পাঠের শেষে উঠে দাঁড়াই…"
 তখন কবিসত্তাকে চিনতে আমাদের ভুল হয় না। মহাবিশ্বের স্থির বস্তুবাদকে উপেক্ষা করে যে সৌন্দর্য নন্দনতত্ত্বকে তিনি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, তা অনাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয়। চক্রহীন উন্মুক্তির নৈরাজ্য। নিস্পন্দন নীরবতার ব্যাখ্যাহীন যুক্তিহীন শৃঙ্খলাহীন পর্যায়। তাই ভাষাতীত শূন্যতা, ঘূর্ণমান সেতু। কাব্যের আরেক জায়গায় লিখেছেন:
"শব্দ গেঁথে গেঁথে, অথবা ভাবনা গেঁথে গেঁথে আমি যে নৈরাজ্য তৈরি করি, তারও নীলিমা আছে, যা নীরবতায় স্পষ্ট হয়, পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে, তার মুথাঘাসের ছেতরানো সবুজ, পরিব্যাপ্ত শিকড়, বিস্তীর্ণতা, বিশৃঙ্খলের শরীরে গভীর এক উড়ান রাখি," তখনই বোঝা যায় যুক্তির শাসনহীনতা কতখানি সক্রিয় হলে এই গতি সঞ্চার হয়। 'উড়ান' শব্দটিতেই কবি স্থিরতাকে ভেঙে দেন। আধুনিকতাবাদকেও পরিহার করে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক দার্শনিক চেতনায় চালিত হন। এখানে বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞানের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়।
মহাবিশ্বের স্থির বস্তুবাদকে উপেক্ষা করে যে সৌন্দর্য নন্দনতত্ত্বকে তিনি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, তা চক্রহীন উন্মুক্তির নৈরাজ্য। নিস্পন্দন নীরবতার ব্যাখ্যাহীন যুক্তিহীন শৃঙ্খলাহীন পর্যায়। তাই ভাষাতীত শূন্যতা, ঘূর্ণমান সেতু এঁদের সৃষ্টিতে বিরাজ করে।

এই সময়ের আর এক কবি গৌতম রায়কে  অধুনান্তিক ভাবনার এক আত্মদর্শী কবি হিসেবে পেয়েছি।  জীবনকে তিনি বহুমুখী প্রজ্ঞার আলোয় আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। বিষয়ের ঊর্ধ্বে, বক্তব্যের বিপরীতে এবং উপলব্ধির স্বয়ংক্রিয় জাগরণে তাঁর কবিতায় এসেছে মুক্তির সোপান। মৃত কল্পনার কাছে স্বাভাবিক দৃশ্যগুলিও অতিচেতনায় অবাস্তব হয়ে উঠেছে। ক্রিয়া ও বিশেষণগুলি কার্যকারণের পথ পরিবর্তন করেছে। শব্দ ব্যবহারের চিরাচরিত রীতিপদ্ধতিও অবলম্বন করেননি। তিনি যেমন মেঘরোদের আত্মমুখী অভিমানকে নিজস্ব অনুজ্ঞায় চালিত করেছেন, তেমনি আলো-আঁধারির মৌনবেদনা বিছিয়ে রাখা গুমোটকে অশ্রুবিহীন তোলপাড় বালাসনের বাঁকে হর্নহীন পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শব্দজোড় সৃষ্টিতে এবং স্বাভাবিক বোধকে ভিন্নমাত্রায় চালিত করতে,চিত্রকল্পের ভিন্নতর প্রয়োগে,এবং বক্তব্যকে বক্তব্যহীন
 তাঁর কাব্যধারা পাঠককে নতুন করে ভাবাবে। 
প্রচলিত সংস্কৃতি,ঐতিহাসিক মিথ এবং নান্দনিক জীবনধারাকে চেতলোকে কিভাবে তুলে আনেন ‘এ আমার প্রথম শ্বাস’ কাব্যে তার একটি দৃষ্টান্ত এরকম: 
"শব্দভেদী বাণ যে ঘর বানায়
বুক দিয়ে স্নায়ু দিয়ে সাধনা দিয়ে নিজের করে নেয় বাউল,
বিচিত্র বর্ণিল আভরণের ভেতর বিরাজমান পূর্ণচন্দ্র কিংবা কার্তিক
তার আনন্দলহরী আঁজলায় আঁজলায় করি পান।
অমরত্ব বলে কিছু নেই।
ইলোরা অজন্তার সুফিয়ানা জন্ম দেয় নতুন বিজ্ঞান-বাউল
উত্তরপুরুষ গোছায় আঁতুড়ঘর।"
সভ্যতার ক্রমদর্শী জীবন প্রজ্ঞায় কবি এই নিবিষ্ঠ আত্মস্ফুরণকে একাসনে বসিয়েছেন। সেখানে বিজ্ঞান-বাউলে,আধ্যাত্মিকে সব ভেদ মুছে গেছে। কবি জানেন "বায়োলজিক্যাল পৃথিবী বিজ্ঞানের পায়ে পা ফেলে পার করে দেয় জন্মতোরণ"। হ্যারল্ট পিটার উত্তর আধুনিকতাবাদ প্রসঙ্গে যে কথাটি বলেছিলেন:
"কোনটি বাস্তব এবং কোনটি অবাস্তব, এবং কোনটি সত্য এবং কোনটি মিথ্যা, তার মধ্যে কোনো কঠিন পার্থক্য নেই। একটি জিনিস অগত্যা সত্য বা মিথ্যা হয় না; এটা সত্য এবং মিথ্যা উভয় হতে পারে।" এই বিস্ময়ই খুঁজে পাওয়া যায় কাব্যের এই ক্রম ভাঙার'ই প্রস্তুতি পর্বে।

  সাত. 
বিমূর্ত চেতনা
🍁
আপাত বিশৃঙ্খলা, যুক্তিহীন, স্বয়ংক্রিয় আত্মগত কোনো উৎস থেকে উপলব্ধির জাগরণ ঘটানো যদি সম্ভব হয়,তাহলেই বিমূর্ত কবিতার জন্ম হতে পারে।এই কবিতায় কবি 
জীবনের সংরাগ আর অভিভব মেশানো এক শূন্যতার দরজায় উপলব্ধির নকশাগুলি মেলে দিতে পারেন । বিমূর্ত চেতনায় চালিত হতে হতেই এক রূপজ অবয়বের কাছে ভাবনা প্রক্রিয়ার নির্মাণও সাধিত হতে থাকে। জার্মানির হামবুর্গে বসবাসকারী ভারতীয় কবি-লেখক সঙ্গীতজ্ঞ ও ধ্যান শিক্ষক অমোঘ স্বামী The Home: A Haiku নামে একটি হাইকুতে লিখেছিলেন:
"From void's womb they bloom,
Cosmic dance of fleeting forms,
Stars return to dusk."
(Amogh Swamy, On My Way To Infinity: A Seeker’s Poetic Pilgrimage)
অর্থাৎ শূন্যের গর্ভ থেকে তারা প্রস্ফুটিত হয়,
ক্ষণস্থায়ী রূপের মহাজাগতিক নৃত্য,
তারারা সন্ধ্যায় ফিরে আসে।
      শূন্যের মহাজাগতিক গর্ভ থেকেই বোধের পর্যাপ্ত উত্থানকে কাব্যের মহিমা দান করেছেন এই সময়ের কবি ব্রতী মুখোপাধ্যায়ও। তিনি লিখেছেন:
"শূন্য
সেই ঠাঁই অনন্ত সারাক্ষণ গর্ভ যন্ত্রণায়,
সেইখানে শতখানেক কুঠুরির মন, 
একান্ত আরশিও, লক্ষরঙা ভুবন ডাঙার ছায়া ধরে, 
ধরে আপ্রাণ প্রাণ পিঞ্জরও নয়দুয়ারির"
এখানেই বাসনাকষ্টগুলি জোনাকি হয়। 
স্বয়ংক্রিয় কবির বিক্ষিপ্ত সঞ্চার ঘটে। যাকে কবি বলেছেন: "শূন্যের ঘরে অবাধ্য পাগলামি/ব্যথাঝলমল"। ব্যথাও রঙিন হয়ে উঠলে কবিতা তখন ভেতর ও বাহিরেও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে। সৌন্দর্যের এপাশ-ওপাশ আলোয় উদ্ভাসিত করতে থাকে। মঙ্গল আরতির আয়োজনে তার আনুষ্ঠানিক জাগরণ ঘটতে পারে। আর সেই কারণেই কবি ভালোবাসার ঘোষণার সঙ্গে কবিতার ঘোষণাকেও মিলিয়ে দেন:
"বুকের ভিতর নিয়ে আমি কবিতা লিখব
বুকের উপর নিয়ে আমি কবিতা লিখব
আকাশ ধুয়ে রোদ নেমেছে কবিতা লিখব
তোমার মুখে রোদ পড়েছে কবিতা লিখব

শাঁখ বাজাও ধূপ জ্বালাও দুয়ারে নেই খিল
তিলের ঠোঁটে একটি-দুটি শব্দ দানের দিন"
কবিতা এভাবেই এসেছে কবির কাছে। 'তুমি' ও 'তোমার' সঙ্গে তুমুল প্রকৃতিও এসে বসতি স্থাপন করেছে। ক্রিয়ার সঙ্গে বিশেষণও জুড়ে গেছে। শরীরের সঙ্গে কোথাও অশরীরী। বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষ্যের মিলনও শব্দের মাপকে দীর্ঘ করেছে। শিসের সঙ্গে নীরবতাও এবং দাহর সঙ্গে ব্যথাও বেজে উঠেছে। তাঁর কবিতায় আমরা প্রেম চিনতে পারি, প্রেমের ভুবন চিনতে পারি, মুক্তকচ্ছ শব্দের কারিগরকেও চিনতে পারি। কাব্যকলার নিয়ম বহির্ভূত চলনে চলার তৌফিকও রপ্ত করতে পারি। গল্প না-গল্পের ঘ্রাণে উজ্জীবিত হতে পারি। চোখ তখন দৃষ্টির প্রলম্বিত আধার হয়ে যায়। সময়ের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না। রহস্য চারিপাশেই সাজাতে থাকে ক্রিয়া। কবি তখন লিখতে পারেন:
'সন্ধেহাওয়ায় উড়ে আসা শিরীষগল্প'
'মধুজোছনায় অশ্রু যেই মিলিয়ে দিলাম কাজল'
'নাভিতলের অফুরান যন্ত্রণারা প্রজাপতিরং'
'মাখনঠোঁটের কামড়' থেকে 'রজনীর গন্ধ ঠোঁট ছুঁয়ে নীল রঙের আগুন' এবং 'তার ভেতর একটুখানি ছাতিমফুলের আর পারি না' নঞর্থক শিস। অথবা 'তার ভেতর একটুখানি ঝালরদোলানো ব্যথা' এভাবেই শিকড় ছড়ানো  অনুভূতির মন্থন আর বিমূর্ত চিত্রকল্পের গভীর অন্বয় । কানাডিয়ান-আমেরিকান জ্ঞানীয় 
মনোবিজ্ঞানী,মনোভাষাবিদ,জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক এবং জনবুদ্ধিজীবী
স্টিভেন আর্থার পিঙ্কার তাঁর গ্রন্থে বলেছেন:
"If we dig even deeper to the roots of words, we unearth physical metaphors for still more abstract concepts."
(Steven Pinker, The Stuff of Thought: Language as a Window into Human Nature)
অর্থাৎ যদি আমরা শব্দের শিকড়ের আরও গভীরে খনন করি, তাহলে আমরা আরও বিমূর্ত ধারণার জন্য শারীরিক রূপক খুঁজে পাই। ব্রতী মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় এই physical metaphors-এরই ছড়াছড়ি বেশি।
তিনটি কাব্য:
 ১) লং লিভ মনখারাপ! লং লিভ!
২) মাটির নিচে জলের বেহালা বাজছে 
৩) দেয়ালদিনের কবিতা 
    সময়ের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলেও, সময়ের উচ্চারণকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেও আত্মস্থিত এক উপলব্ধির প্রজ্ঞায় শারীরিক রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন শব্দে শব্দে প্রায় প্রতিটি কবিতাটিতেই। তাই মাঠ, বাড়িঘর, সন্ধ্যেবেলা, রোদ, মেঘ-বজ্র, হলুদঠোঁট পাখি, ব্যথা, রাষ্ট্র, আগুন, আমলাশোল, চাঁদ, ভারতবর্ষ তাঁর কবিতায় বারবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বিমূর্ত শূন্যতায় মূর্ত হয়েছে উপলব্ধির ক্ষরণ। প্রবহমান এক চক্র নির্বিকল্পবোধের সীমানায় অসীম হয়ে উঠেছে। পড়তে পড়তেই শুনতে পাই মাটির নিচে কেমন করে জলের বেহালা বাজছে।সময়ের পতাকা উড়ছে, বুকের ক্ষতগুলি বড় হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় অন্ধকার মানবিক চৈতন্যের চিতা সাজাচ্ছে। সভ্যতার সিঁড়িগুলি ভেঙে ফেলছে রাষ্ট্র শাসনের নামে। কান্না ও রক্ত একসঙ্গে বয়ে চলেছে আমাদের মানবিক পাহাড়ে। ভালোবাসার ফুল কখন ফুটবে তবে? এক অস্থিরতা যাপনের মধ্যে আমাদের রাস্তাগুলি ক্রমশ বেঁকে যাচ্ছে। অসহনীয় নৈঃশব্দ্যে আমাদের স্পন্দন থেমে আছে। বিপন্নতার বহুমাত্রিক প্রজ্ঞায় উঠে আসা মুহূর্ত গুচ্ছ আলাদা আলাদা নামকরণে খণ্ডিত হলেও উৎসমূলের সামঞ্জস্যে একীভূত চেতনার পরিচয়ে উদ্দীপ্ত। মানবিক অন্বেষণ জারি রেখেই কবির পথে নামা।প্রেমই তাঁর ব্যবসার মূলধন। শব্দই তাঁর ভাষা। উপলব্ধিই তাঁর প্রজ্ঞার নির্মিতি। অন্ধকার অনিশ্চয়তায় ভরা যাত্রাপথ:
"নক্ষত্রের ভরসায় প্রদীপ জ্বলছে না
আগুন পিঠে, বিছানা পুড়বে
অশরীরী উৎসবের রাত"
এই রাত প্রতিকূলতায় ভরা। রক্তের ছিটে লাগে গাছের পাতায় পাতায়। কে কোথায় খুন হয় কেউ জানে না। তবু কবি পাপে অথবা পুণ্যে থাকেন না। ভালোবাসায় থাকেন। এখনো 'তুমি' বলে ডাকেন। মাটির নিচেও জল থাকে না। চোখেও জল থাকে না।তখন নিজের রক্ত নিজেই পান করে অসময়ের দেশে 'জান কাহিল রাত্রির চরে' এসে দাঁড়ান। নিজের ছাল নিজেই ছাড়ান। নুন ছিটিয়ে কেমন কষ্ট!কষ্ট বোঝেন। ছিন্ন সময়, ভাঙা স্বপ্ন, বৃষ্টির রাত সবই শত্রু-শত্রু। কাতর করেছে অকাতরে। অন্ধ চোখে তবুও 'সূর্যপ্রচোদিত' 'জাদুদীপন'। বিদীর্ণ সত্তা সঞ্চয় করে রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ। কবিতাযাপন সময়যাপনের সমান্তরালে এক বিষাদদ্রাঘিমা  টেনে দেয়। আমরা তখন খুঁজে পাই দেয়ালদিন। পাঠকের কাছে বাংলা কবিতার এক নতুন উচ্চারণ, এক নতুন অভিজ্ঞতার পথপরিক্রমায় ব্রতী মুখোপাধ্যায় নিজেকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
    
একই উৎস থেকে উৎসারিত 
🍁
কবিতার বাঁক বদলের ধারায় প্রত্যহই কোনো না কোনো কবির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়। বিমূর্ত কবিতা, স্বয়ংক্রিয় কবিতা, মেটাফিজিক্যাল কবিতা, মেটাফোর কবিতা, অধুনান্তিক কবিতা, ক্লাসিক কবিতা, গীতিকবিতা,সুররিয়ালস্টিক কবিতা ইত্যাদি আরো কত সৃষ্টির পথে কবিরা চলেছেন। কিন্তু সব কবিতা সৃষ্টির মূলেই যে একটা মনুষ্য জীবন আছে, জীবনের যাপন আছে, কে তার ক্রিয়াকে অস্বীকার করবে? নীরবতা বা মুখরতা, বাস্তবতা বা অবাস্তবতা, শূন্যতা বা সংলগ্নতা সবই সেখানে বিরাজ করে। সবকিছুর মূলেই আছে ভাষা। বোধই চালিত করে ভাষাকে। সেই ভাষাই লেখে কবিতা। সুতরাং উৎস একই, লক্ষ্য একই— বিষয়ের মধ্যেও যে মিল থাকবে না — তা হয় না। 
#everyone

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ