ছড়া
প্রবাল বর্মন
ত্রিপুরায় বিভিন্ন জনবসতির নামকরণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ প্রবণতা আছে যার পেছনে কিছুটা ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়। সাধারণত হিন্দুধর্মে বিশেষ বিশেষ পুণ্য দিন বা তিথিতে নদীর জলে অবগাহন স্নান অত্যন্ত পবিত্র কাজ হিসাবে গণ্য হয়। হিন্দুধর্মে অনেক নদীর বিশেষ মাহাত্ম্য স্বীকার করে নেওয়া হয়। ডি ডি কোশাম্বীর মতে নদীকে দেবী হিসাবে কল্পনা করে যেসব ধর্মাচার গড়ে উঠেছিল বর্তমান হিন্দুধর্মের পুণ্যস্নান, বিসর্জন প্রভৃতি তারই অবশেষ মাত্র। কোশাম্বী আরও মনে করেন ভারতে অনার্যদের মধ্যেই প্রথম নদীকে দেবী হিসাবে পূজা করার রীতি প্রচলিত ছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খাসিদের মধ্যে নদীকে দেবী হিসাবে কল্পনা করে মহাসমারোহে পূজা করার রীতির বহুল প্রচলন ছিল। খাসিয়াদের প্রধান নদীদেবী ছিলেন কুপিলি। রাজমালাতেও এই নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নদীদেবী কুপিলির পূজায় নরবলিদানের রীতি ছিল। প্রাচীন বোড়ো ধর্মবিশ্বাসে নদীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করার রীতি ছিল। ত্রিপুরার পার্বত্য জনজাতি বিশেষ করে ত্রিপুরীদের প্রাচীন Animism (সর্বপ্রাণবাদ) ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী প্রবহমান জলধারা বা নদীতে দেবত্ব আরোপ করা হত। ত্রিপুরীরা বিশেষ করে ত্রিপুরার রাজারা প্রাচীন বোড়ো ঐতিহ্য অনুসরণ করে নদীকে দেবতা হিসাবে পূজা করতেন। রাজপরিবারের কুলদেবতা 'চৌদ্দ দেবতা'র অন্যতম দেবী ছিলেন 'তুইমা'। ইনি জলের দেবী। ত্রিপুরা রাজ্যগঠনের প্রাথমিক ও মধ্য পর্যায়ে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী উদয়পুরে ছিল, রাজাদের আরাধ্যা জলদেবী ছিল গোমতী নদী। সংস্কৃতকরণের মাধ্যমে 'তুইমা' দেবী গঙ্গাদেবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর রাজারা গোমতী নদীকেই গঙ্গা হিসাবে পূজা করতেন। শ্রীরাজমালা চতুর্থ লহরের মধ্যমণিতে সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সেন এই পূজাপদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন "সুপ্রাচীন প্রথানুসারে ত্রিপুরেশ্বরগণ প্রতি বৎসর মাঘমাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে গোমতী নদীর ওপর গঙ্গাপূজা করিয়া থাকেন। এ পূজা উপলক্ষ্যে পূজার সাত দিবস পূর্ব্বে মূলী বাঁশের বেতী দ্বারা পাকান রজ্জুর দুই মাথা নদীর দুই পাড়ে বন্ধন করিয়া নদীপথ রুদ্ধ করা হয়। পূজা সমাপ্তির পূর্ব্বে সেই রজ্জু ছিন্ন বা অপসারণ করা নিষিদ্ধ ছিল।"
এই নদীপূজায় অন্যান্য পশুবলির পাশাপাশি নরবলি প্রদানের রীতি ছিল। ত্রিপুরা রাজ্যগঠনের প্রাথমিক পর্বে বিভিন্ন দেবস্থানে ও পূজায় অসংখ্য নরবলি দেওয়া হত। রাজা ধন্যমাণিক্য বিভিন্ন দেবস্থানে নরবলির সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেন।
'তিন বৎসরে এক নর চতুর্দশ দেবে।
কালিকাতে এক নর পাইবেক যবে।। দৌচা পাথরে দুই নর শত্রু পাইলে হয়।
১৭৭
ত্রিপুরার স্থাননাম-১২
[01/10, 18:29] SROT PRAKASHANA: (২)
গোমতীতে দুই বলি ঘটে যে সময়।'
শ্রীরাজমালা ২য় লহর, ধন্যমাণিক্য খণ্ড ত্রিপুরার পার্বত্য জনজাতিগোষ্ঠীগুলির নদীপুজার উল্লেখ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। রাজকুমার সহদেবকিশোর দেববর্মা 'স্বাধীন ত্রিপুরা সেন্সাস রিপোর্ট; ১৩১০ ত্রিপুরাব্দ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ'-এর পুনর্মুদ্রণের ভূমিকায় লিখেছেন, "রিয়াংগণ যে ছড়া বা নদীর পাড়ে বাস করে তাহারা সেই ছড়া বা নদীর পূজা করিয়া থাকে এবং তাহাকেই সাধারণত তুইমা বলে। এক্ষণ গঙ্গাপুজাকেও তুইমা বলিয়া থাকে।” তিনি আরও লিখেছেন যে, "এতদ্ব্যতীত এরাজ্যের রিয়াংগণ সকলে সমবেত হইয়া প্রতিবর্ষে গোমতী, কর্ণফুলী, মোহরী, ফেনী প্রভৃতি নদীর পূজা অতি সমারোহের সঙ্গে সম্পন্ন করে।"
ত্রিপুরার পার্বত্য জনজাতিদের Animism অথবা সর্বপ্রাণবাদ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী প্রবহমান জলধারা বা নদীতে দেবত্ব আরোপ করে নদীকে বলা হয় তীয়মা (তুইমা)। উপনদীকে বলে তীয়সা (তুইছা)। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় উত্তর ত্রিপুরার মনু নদী হল মা নদী, এর উপনদীর (সন্তান বা ছা নদীর) নাম ছা মনু; তার উপনদী নাতিন মনু; তার উপনদীর বা সন্তানের নাম পুতিমনু। নদীর নাম অনুসারে ত্রিপুরার অনেক স্থাননাম আছে। এই নামগুলির মধ্যে মনু, মনুঘাট, মনুবাজার (উত্তর ত্রিপুরা ও দক্ষিণ ত্রিপুরায় দুটি মনুনদী থাকায় মনু নামগুলি উত্তর ও দক্ষিণ ত্রিপুরায় পাওয়া যায়।) এছাড়াও নদীর নামে স্থাননাম হিসাবে মুহরিপুর, চেলাগাঙ, ছনগাঙ, লাউগাঙ, রাইমা, সাইমা (সর্মা), জুরি, পিত্রা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই গ্রাম বা নগরগুলি প্রত্যেকটি ওই নামের নদীর তীরবর্তী স্থান।
ত্রিপুরার পাহাড়গুলিতে ঝরনার জলে যেসব ছোটো ছোটো জলপ্রবাহের সৃষ্টি হয় সেগুলির কয়েকটি একত্রিত হয়ে সমতলভূমিতে প্রবাহিত হয়ে উপনদী (Tributary) হিসাবে বড়ো নদীতে মিলিত হয়। এগুলিকেই বাংলায় বলে ছড়া এবং ককবরকে বলে তীয়সা (তুইসা)। এই ছড়াগুলির ধারে বহুদিন ধরে অসংখ্য জনবসতি গড়ে উঠেছে। পার্বত্য জনবসতিগুলির নামকরণের অন্যতম প্রধান প্রবণতা হল পার্শ্ববর্তী যে ছড়ার জলে গ্রামের মানুষের জীবন নির্ভরশীল সেই ছড়ার নামে বাসস্থানের নাম দেওয়া। এই ছোটো উপনদীগুলিকে বাংলায় বলে ছড়া এবং ককবরকে বলে তীয়সা (তুইসা)। স্বাভাবিকভাবে এই জনবসতিগুলির স্থাননাম দ্বিশাব্দিক হয়েছে এবং এই নামের একটি অংশ তীয়সা (তুইসা) বা ছড়া। ত্রিপুরার পার্বত্য জনজাতিদের বিভিন্ন দফা বা উপদফার মানুষের বসতি হিসাবে প্রথমে তাদের নিজেদের ভাষায় এই গ্রামগুলির নামকরণ হয়েছিল। পরবর্তী কালে এই জনবসতিগুলির জনচরিত্র পরিবর্তিত হয়ে মিশ্র জনবসতিতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক আদি ককবরক নাম ভিন্নভাষী মানুষদের উচ্চারণের ত্রুটির ফলে বর্ণক্ষয়ের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই নামগুলিকে চারভাগে ভাগ করে তালিকা প্রস্তুত করা যায়। (১) আদি ও অপরিবর্তিত ককবরক নাম; (২) ককবরক নামের পরিবর্তিত রূপ; (৩) ককবরক নামের ভাষান্তরিত রূপ এবং (৪) বাংলা নাম।
১৭৮
[01/10, 18:32] SROT PRAKASHANA: (৩)
১. যে ককবরক নামগুলি কোনো পরিবর্তন ছাড়াই এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলিকে প্রথম তালিকায় রাখা হল।
(ক) তুইসা রাঙচাক (তীয়সা রাঙচাক) তুইসা শব্দটির অর্থ উপনদী বা ছড়া। রাঙচাক শব্দটির অর্থ সোনা। সম্ভবত এই ছড়ার জলের রং সোনার মতো উজ্জ্বল তাই এই নাম। অন্যভাবে বলা যায়, এই নদীর অববাহিকার উর্বর মাটিতে প্রচুর ফসল ফলে এবং এই ফসল অর্থাগমের ভালো উৎস। তাই এই নাম।
(খ) তুইসা কুফুর (তীয়সা কীফুর): এই নামটির অর্থ হল সাদা বা পরিষ্কার জলের ছড়া।
(গ) তুই সিন্দ্রাই (তীয় সিনদরাই) সিনদরাই শব্দের বাংলা অর্থ চেলা বা তেঁতুলে বিছা। এই উপনদীর গতিপথ চেলা বা তেঁতুলে বিছার মতো আঁকাবাঁকা।
(ঘ) তুই হরচুঙ (তীয় হরচীঙ) হরচুঙ একটি যুগ্ম শব্দ। হর শব্দটির অর্থ আগুন এবং চাঙ শব্দটির অর্থ প্রজ্জ্বলিত হওয়া। এই নামটি প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। হর শব্দটির আরও একটি ভিন্ন অর্থ হল 'রাত্রি'। এক্ষেত্রে অর্থ দাঁড়ায় রাত্রে প্রজ্জ্বলিত হওয়া। সম্ভবত এই
ছড়াটির জমা জলে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হয়ে আলেয়া দেখা দিতে পারে। (ঙ) তুই কই (তীয় কই) কই শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ বেঁকে যাওয়া বা বক্র হওয়া। সম্ভবত যেখানে এই গ্রামটি অবস্থিত সেখানে এই ছড়াটি তার সরল প্রবাহপথে না চলে
ভিন্নদিকে বেঁকে গেছে।
(চ) তুইসা সিত্রামা (তীয়সা সিতরামা): সিতরামা শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে সিতরা শব্দের সঙ্গে 'মা' প্রত্যয় যুক্ত হয়ে। সিতরামা শব্দের অর্থ নোংরা বা ময়লা। এই স্থাননামটির কারণ ওইখানে এই ছড়াটির জল খুবই অপরিষ্কার।
(ছ) তুইসা কুরান (তীয়সা কীরান): তুইসা এই বিশেষ্য পদটির বিশেষণ কুরান। কুরান
(কারান) শব্দটির অর্থ শুষ্ক বা শুকনা। সম্ভবত বছরের বিশেষ সময়ে এই ছড়ায় জলপ্রবাহ থাকে না।
(জ) রাই তুইসা (রাই তীয়সা): রাই শব্দটির অর্থ একপ্রকার বেত। নামটি বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় বেতছড়া তবে রাই তুইসা ও বেতছড়া দুটি পৃথক স্থাননাম।
(ঝ) তুইসা কতর (তীয়সা কতর): কতর শব্দের অর্থ বড়ো বা শ্রেষ্ঠ। বাংলায় অনুবাদ করলে স্থান নামটি হবে বড়ো-ছড়া।
(ঞ) তুইসা মুঙকুরুই (তীয়সা মুঙকীরীয়): এই স্থাননামটি বেশ কৌতুকপ্রদ। এখানে মুঙ এবং কীরাই শব্দদুটির যোগ ঘটেছে। মুঙ-এর বাংলা অর্থ নাম এবং কীরাই শব্দের অর্থ 'নাই' বা শেষ। সম্পূর্ণ স্থাননামটির অর্থ দাঁড়ায় 'নামহীন ছড়া' বা যে উপনদীর নাম নেই।
১৭৯
[01/10, 18:34] SROT PRAKASHANA: (৪)
(ট) সিকাম তুইসা (সিকাম তীয়সা): ত্রিপুরীরা কুকি জাতির মানুষদের সিকাম বা ছিকাম বলে। কোনো কুকি জাতি অধ্যুষিত অঞ্চল দিয়ে এই উপনদীটি প্রবাহিত তাই এই নাম।
(ঠ) তুইমা (তীয়মা): যে ছড়া বা উপনদীতে দেবত্ব আরোপ করে জলপূজা বা গঙ্গাপুজা করা হয় তাকে তুইমা বলা হয়। সম্ভবত এই কারণে এই ছড়া এবং পাশ্ববর্তী স্থানটির নাম তুইমা (তীয়মা)। ত্রিপুরীদের আদিম ধর্মবিশ্বাসে তুইমা ছিলেন জলের দেবী।
(ড) তুইসামা (তীয়সামা) এইখানে তীয়সা শব্দের সঙ্গে মা প্রত্যয় যোগ করে স্থাননামটি করা হয়েছে।
(5) তুই লাইফাং (তীয় লাইফাং) এই ককবরক নামটি বৃক্ষনামঘটিত। এই ছড়াটির বাংলা নাম কলাছড়া। লাইফাং শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ কলাগাছ।
(৭) সর্বং এই স্থাননামটির সৃষ্টি হয়েছে যেহেতু এই জায়গাটা সর্বং তুইমার ধারে অবস্থিত। এই সর্বংছড়ার জলে ওই অঞ্চলের বৃহৎসংখ্যায় মানুষ উপকৃত হন।
(ত) পিত্রা: পিত্রা নদীর নাম অনুসারে এই স্থাননামটির সৃষ্টি।
(খ) তুই থামপুই (তীয় থামপুই) তেলিয়ামুড়ায় অবস্থিত এই স্থাননামটির পাশ্ববর্তী উপনদীর নাম অনুসারে এই ছড়াতে বা আশেপাশে সম্ভবত মশার উপদ্রব বেশি। থামপুই শব্দটির বাংলা অর্থ মশা বা মাছি।
(দ) তুই সিনদাই: খোয়াই মহকুমার এই স্থাননামটির উৎস সিনদাই উপনদীর নাম অনুসারে। সিনদাই শব্দটির অর্থ ঝিনুক বা শামুক।
(খ) তুইসা কুতাং: কমলপুরের এই স্থাননামটি ককবরক লিপিতে দাঁড়ায় তীয়সা কীতাং। কীতাং (কুতাং) শব্দটির অর্থ জীবন্ত। এই ছড়া সারাবছর ধরে প্রবাহিত থাকে। সম্ভবত
তাই এই নাম।
(ন) তুই কিসিপ: এই নামটি থেকে বোঝা যায় এই ছড়া বা উপনদীটির গতিপ্রবাহ খুব সংকীর্ণ। উপনদীটির নাম তীয় কিসিপ।
(প) তৈদু : এই নামটি একটি যুগ্ম শব্দের নাম। তীয় এবং দু-এই দুটি শব্দের সম্মিলন। তীয়দু নামটির অর্থ নদীর গভীর ও প্রশস্ত অংশ।
(ফ) তৈদুম: এটিও একটি জোড়া শব্দের নাম। তীয় এবং দুম শব্দদুটির মিলন। কেউ কেউ মনে করে জলস্রোতকে বাঁধ দিয়ে রাখার জন্য এই নামটির উৎপত্তি হয়েছিল।
২। নদী বা উপনদীর নাম অনুসারে বিভিন্ন স্থাননামগুলির দ্বিতীয় ভাগে রাখা হল এমন নামগুলি যেগুলি ভিন্নভাষী মানুষের উচ্চারণের ত্রুটির কারণে কিছুটা বিকৃত হয়ে গেছে।
১৮০
[01/10, 18:35] SROT PRAKASHANA: (৫)
(ক) তুই কর্মা: এই স্থাননামটির প্রকৃত ককবরক উচ্চারণ তীয় করম' (ক+অ+র+অ+ম
+অ)। শেষের ম-এর উচ্চারণ 'অ' যুক্ত হয়ে দীর্ঘ। তুই শব্দের অর্থ হল নদী এবং করম' শব্দের অর্থ ইষৎ হলুদ রঙ।
(খ) তুই বাখলাই: এই স্থাননামটির প্রকৃত ককবরক শব্দটি হল তীয় বাখীলাই। বাখীলাই শব্দটির অর্থ উপর থেকে লাফিয়ে পড়া। বাখীলাই ককবরক শব্দটির পরিবর্তিত রূপ বাখলাই। তাই বাখলাই (তীয় বাখীলাই) ছড়াটি সম্ভবত ছোটো ছোটো জলপ্রপাত সৃষ্টি করে প্রবাহিত হয়েছে।
(গ) তুই বান্দাল: এই স্থাননামটির প্রকৃত রূপ হল তাঁয় ডান্দাল। এই নামটি বৃক্ষনামঘটিত। উানদাল শব্দটির অর্থ একপ্রকার বাঁশ। স্থানীয় ভাষায় এই বাঁশকে মিতিঙ্গা বাঁশ বলে। এই জলপ্রবাহটি উয়ান্দাল বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। তাই নামটি দাঁড়ায় তীয় উান্দাল। বাংলায় এই নামটি রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় তুই বান্দাল।
(ঘ) তুই বাকলাই: এটি একটি জমাতিয়া অধ্যুষিত গ্রাম ছিল। তুই বাকলাই জমাতিয়া উপভাষার শব্দ। তুই মানে ছড়া এবং বাকলাই শব্দের অর্থ বিভাজন হওয়া। সম্ভবত এই স্থানটি যেখানে অবস্থিত সেখানে ছড়ার প্রবাহপথ দ্বিমুখী হয়ে দুইদিকে প্রবাহিত হয়েছে। বর্তমানে লোকমুখে এই স্থানটির নাম আরও পরিবর্তিত হয়ে তুই বাগলাই হয়েছে।
(ঙ) ইয়াসিন ছড়া: এই স্থাননামটির আদি ককবরক রূপ হল য়াসিন তীয়সা। য়াসিন শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল নখ বা নখর।
(চ) খাংগ্রাই ছড়া: এ নামটির প্রকৃত ককবরক রূপ হল খাঙরায়। এর বাংলা অর্থ কাঁকড়া। এই নামটি জলজ প্রাণীর নাম অনুসারে হয়েছে।
(ছ) তৈরূপা: এই নামটির প্রকৃত ককবরক রূপ হল তীয় রীফাই (তুই রুফাই)। রুফাই শব্দটির বাংলা অর্থ হল রূপা। তীয় রুফাই নাম উচ্চারণ বিকৃতির ফলে দাঁড়িয়েছে প্রথমে তুই রূপাই এবং পরে তৈরূপা।
(জ) তুই চাকমা: এই স্থাননামটি উচ্চারণত্রুটির ফলে রূপান্তরিত একটি নাম। এর প্রকৃত রূপ হল তীয় চাঙমা। এখানে তীয় (তুই) শব্দের অর্থ জল এবং চাঙমা শব্দের অর্থ হল শীতল বা ঠান্ডা। আরও একটি ভাবে এই নামটি ব্যাখ্যা করা যায় যদি মূল নামটি তীয় কীচাঙমা এইভাবে ধরা হয়। তীয়-এর অর্থ জল এবং কাঁচাঙ শব্দের অর্থ ঠান্ডা করা এবং
এর সঙ্গে 'মা' প্রত্যয় যুক্ত। অর্থাৎ যে জল শীতল করে।
(ঝ) তুই হাচিঙ: এই নামটি মূল ককবরক নামের কিছুটা পরিবর্তিত রূপ। মূল ককবরক নামটি হল তীয় হাই চিঙ। এর অর্থ বালি ছড়া।
(ঞ) হেজা ছড়া: এই নামটি চাকমা নামের অপভ্রংশ। এই ছড়ার মূল নাম ছিল 'আহজা
১৮১
[01/10, 18:37] SROT PRAKASHANA: (৬)
ছড়া'। 'আহজা' চাকমা ভাষার এই শব্দটির বাংলা অর্থ হল লবণাক্ত মাটি। অর্থাৎ যে মাটিতে লবণ মিশ্রিত থাকে। এই মাটি চেটে বনের পশুরা তাদের শরীরের লবণের চাহিদা পূরণ করে থাকে। যেহেতু এই মাটি এবং জলের স্বাদ লবণাক্ত (Saline), স্থানীয় চাকমা অধিবাসীরা তাই ছড়ার এবং বসতির নামকরণ করেছিল 'আহজা ছড়া'। পরবর্তী কালে বাঙালি জনসমাগম হলে 'আহজা' শব্দটি বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় 'হাজা বা হেজা'। ককবরকেও এই ধরনের নাম পাওয়া যায়। 'কীপরাপ'-এই ককবরক শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ লবণাক্ত বা নোনা (Saline)। এই লবণাক্ত মাটির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ার নাম তীয় কীপরাপ। বাংলায় এই ছড়ার নাম হয়েছে নোনাছড়া বা লবণ ছড়া।
তৃতীয় বিভাগে রাখা যায় উপনদীর নামযুক্ত এমন কতকগুলি স্থাননাম যেগুলিকে আবার বিভিন্ন উপবিভাগে ভাগ করে আলোচনা করা উচিত। এই নামগুলির মধ্যে অনেক নাম স্থানীয় জনজাতীয় ভাষায় দেওয়া নামের বাংলা ভাষান্তরিত নাম যেমন ককবরক নাম: তীয় কীরান = শুকনা ছড়া, রাই তীয়সা বেতছড়া; হালাম নাম: তি সেন তে = ইচাই লালছড়া, তেলপেত দুঙ কাছিম ছড়া; চাকমা ভাষায় আহজা ছড়া = হেজা ছড়া ইত্যাদি। আলোচ্য উপনদীগুলি একাধিক মহকুমায় অবস্থিত হওয়ায় পৃথকভাবে মহকুমাগুলির নাম উল্লেখ করা হল না।
(ক) বৃক্ষ বা উদ্ভিদ নামযুক্ত নাম।
১. কলা ছড়া / কলা ছড়ি (Musa acuminata)
২. কাঁঠাল ছড়া (Artocarpus hetero phyllus)
৩. বেল ছড়া (Aquilaria malacensis)
৪. করলা ছড়া (Momordica charantia)
৫. লেম্বু ছড়া (Citrus medica) ৬. জামির ছড়া (Citrus medica)
৭. চাম্পা ছড়া (Michelia champaka)
৮. ধূপ ছড়া (Canarium strictum)
৯. কচু ছড়া (Colocasia esculanta)
১০. জারুল ছড়া (Lagerstroemia speciosa)
১১. গামাই ছড়া (Gmelina arforea)
১২. ডলু ছড়া (Nehuzeaua dulloa)
১৩. কমলা ছড়া (Citrus reticulate)
১৪. করই ছড়া (Albizia procera)
১৮২
[01/10, 18:38] SROT PRAKASHANA: (৭)
১৫. কেরেৎ ছড়া (Calamus viminalis-একপ্রকার বেত)
১৬. নল ছড় / নালছড়া (Phragmites karks)
১৭. চালিতা ছড়া (Dillenia indica)
(খ) দ্বিতীয় বিভাগে রাখা হল সেই নামগুলি যার দ্বারা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
১. সোনা ছড়া / সোনাই ছড়ি
২. রূপা ছড়া / রূপাই ছড়ি
৩. শুকনা ছড়া (বছরের অধিকাংশ সময় জলহীন থাকে), মরা ছড়া
৪. জিওল ছড়া (বছরের কোনো সময়ে যার জলপ্রবাহ বন্ধ হয় না)
৫. রাঙা ছড়া; লাল ছড়া, ইচাই লাল ছড়া (যে ছড়াগুলির জল অববাহিকার মাটির জন্য প্রায় লালচে রঙের)
৬. চিকন ছড়া (ছড়াটির আকৃতি সরু, সংকীর্ণ)
৭. নোনা ছড়া, লবণ ছড়া, হেজা ছড়া (যে ছড়ার জল কিছুটা লবণাক্ত অববাহিকা পথের
মাটির জন্য)
৮. বালু ছড়া / বালি ছড়া (এই ছড়ার জলপ্রবাহ বালিকণা বয়ে আনে)
৯. ঢেপা ছড়া (এই ছড়ার উৎপত্তি আবদ্ধ জল থেকে)
১০. শিলা ছড়ি (এই ছড়ার বুকে শিলাখণ্ড পাওয়া যায়)
১১. করম ছড়া ('করম' শব্দটির অর্থ হলুদ রং, ছড়াটির জলের রং ঈষৎ ঘোলাটে হলুদ।
১২. ফটিক ছড়া (এই ছড়ার জল পরিষ্কার)
১৩. আন্ধার ছড়া (এই ছড়ার গতিপ্রবাহ কোনো সময় ঘন অরণ্যের ছায়াবৃত অন্ধকার স্থানের মধ্য দিয়ে ছিল)
১৪. ধুমা ছড়া: (এটি একটি অনুবাদ নাম) কোনো সময়ে এই ছড়ার জলের বাষ্পীভবন চোখে দেখা যেত।
১৫. দোপাতা ছড়া: (এই নামটি চাকমা স্থাননামের বিকৃত রূপ। চাকমা ভাষায় 'দব' মাছ ধরার ফাঁদ এবং 'পাদা' স্থাপন করা। উভয় মিলে নামটি ছিল দবপাদা ছড়া বর্তমানে নামটির রূপ দোপাতা ছড়া।)
(গ) তৃতীয় বিভাগে রাখা যায় সেই ছড়াগুলির নাম যেগুলি জলজপ্রাণীর নাম থেকে স্থাননাম হিসাবে পরিচিত।
১. উগল ছড়া: চ্যাং মাছের অন্য নাম উগল মাছ। স্থানান্তরে উপল নামটি প্রচলিত। ২. পাবিয়া ছড়া: উত্তর ত্রিপুরায় পাবদা মাছকে পাবিয়া মাছ বলে।
৩. ইচা ছড়া / ইচা ছড়ি: ছোটো চিংড়ি মাছকে পূর্ববাংলায় ইচা মাছ বলে।
৪. মাগুর ছড়া / সিঙ্গি ছড়া: দুই ধরনের জিওল মাছ-এর নাম মাগুর মাছ এবং সিং মাছ।
১৮৩
[01/10, 18:39] SROT PRAKASHANA: (৮)
৫. শামুক ছড়া
৬. কাছিম ছড়া
৭. কাঁকড়া ছড়া
৮. লাটিয়া ছড়া: বেলেমাছ জাতিয় মাছকে কোনো অঞ্চলে লাটিয়া মাছ বলে। উল্লেখ করা যায় হালাম ভাষায় একটি ছড়ার নাম সাওয়ক দুং। লাটিয়া, লেটে বা চ্যাং মাছকে হালামরা জাওয়ক বলে এবং দুং শব্দটিরঅর্থ ছোটো নদী বা ছড়া। মূলত এটি একটি হালাম স্থান নামের বাংলা ভাষান্তরিত রূপ।
(ঘ) চতুর্থ বিভাগে রাখা আছে সেই ছড়াগুলির নাম যেগুলির প্রবাহপথে বিশেষ বিশেষ পশুপাখী বা পতঙ্গের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল।
১. ভোমরা ছড়া (ভ্রমর)
২. তাখুম ছড়া (তাখুম = হাঁস)
৩. তকসা ছড়া (তকসা = মুরগিছানা)
৪. মনাই ছড়া (মনাই = ময়না পাখি)
৫. বাঘ ছড়া / বাঘাই ছড়া
৬. হরিণ ছড়া
৭. ভাল্লুক ছড়া
৮. হাতিমরা ছড়া
৯. গন্ডাছড়া। এখানে গন্ডাছড়া নামটি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বর্তমানে এটি একটি মহকুমার নাম। এই ছড়া বা উপনদীর তীরবর্তী অঞ্চলে একসময় গন্ডার বিচরণ করত বলে অনেকে মনে করেন। ককবরকে গন্ডারকে 'গনতা' বলে। এই কারণে এই ছড়া ও স্থাননামটি হয়েছিল গনতা ছড়া যা পরবর্তী কালে গন্ডা ছড়ায় রূপান্তরিত হয়। এ প্রসঙ্গে ত্রিপুরার রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের শাসনকালে একটি রাজাদেশের উল্লেখ করা যায়। সার্কুলার নং ১৬; ১৩১৫ ত্রিং ২৮শে আশ্বিন (১৯০৫ ইং) বিজ্ঞাপিত এই আদেশনামায় রাজা রাধাকিশোর ত্রিপুরা রাজ্যে গন্ডার শিকার নিষিদ্ধ করেছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যের পর্বতগুলির পাদদেশ অঞ্চলে অতীতে গন্ডারের বিচরণ ছিল।
(ঙ) এই বিভাগে রাখা যায় ত্রিপুর জনজাতিগোষ্ঠীগুলির নামে ছড়া আছে সেইসব যেসব ছড়ার নাম। যে জনজাতিগোষ্ঠীগুলির অধ্যুষিত অঞ্চল দিয়ে ছড়াগুলি প্রবাহিত কয়েকটি ক্ষেত্রে ছড়াগুলি ওই জাতিগোষ্ঠীগুলির নামে নামাঙ্কিত হয়ে গেছে।
১. কুকি ছড়া = সিকাম তুই সা নামটির বঙ্গানুবাদ। সিকাম শব্দটির দ্বারা কুকি জাতিকে
বোঝায়।
২. চাকমা ছড়া
১৮৪
[01/10, 18:40] SROT PRAKASHANA: (৯)
৩. টিপরা ছড়া।
৪. কলই ছড়া
(চ) ষষ্ঠ বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হিন্দু দেবদেবীদের নামে নামাঙ্কিত ছড়াগুলির নাম। অনেক সময় কিংবদন্তি বা লোককাহিনি অবলম্বন করে কোনো বিশেষ স্থানে দৈবী পবিত্রতা আরোপ করা হয়। ধীরে ধীরে সেটা পবিত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়। যেমন গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে গঙ্গার উৎপত্তি। কিংবদন্তি অনুসারে মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গাবতরণ হয়েছে। গঙ্গা নদীর উৎসতে পবিত্রতা আরোপ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ত্রিপুরাতেও কোনো কোনো বিশেষ নদী বা উপনদীর উৎসমুখে দৈবী কাহিনি কিংবদন্তি রূপে প্রচারিত হয়ে জনমনে গভীর বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ঊনকোটি বা ডম্বুর ইত্যাদি। এইসব বিশেষ কিছু ছড়াতে পবিত্রতা আরোপ করা হয়েছে। তাই ছড়াগুলির নাম হয়েছে দেবদেবীর নাম অনুসারে যেমন ব্রহ্মছড়া, লক্ষ্মীছড়া, শনিছড়া, শিবছড়া, দুর্গাছড়া, দেবীছড়া, মাইগঙ্গা প্রভৃতি।
ঠাকুর ছড়া: এই ছড়াটির নামকরণ নিয়ে এক লোককাহিনি প্রচলিত। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বাঙালিরা ঠাকুর বলে থাকেন। একদিন একটি রাখাল গোরু চরাতে গিয়ে গোরু হারিয়ে ফেলে। রাখাল ছেলেটি গোরু খুঁজতে গিয়ে ছড়ার ধার দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করে। গভীর জঙ্গলে সে হঠাৎ দেখে কাঞ্চনকান্তি এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গাছের ডালে বসে আছেন। রাখাল ছেলেটি উপস্থিত হতেই তিনি নাকি নীচে ছড়ার জলে ঝাঁপ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। এই কাহিনি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি বিশ্বাসে পরিণত হয়। এই বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থেকেই ছড়াটির নাম হয়ে যায় ঠাকুর ছড়া। মগদের বিশ্বাস এই যে পিলাক সভ্যতার স্রষ্টা আরাকানের রাজা আনন্দচন্দ্রের তৈরি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সোনার মূর্তি এই ছড়া উৎসমুখের কাছে জলের গভীরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সেইজন্য এই ছড়ার নাম ঠাকুর ছড়া।
0 মন্তব্যসমূহ