নীরমহলের আত্মকাহিনী || পাপিয়া দাস

নীরমহলের আত্মকাহিনী || পাপিয়া দাস

নীরমহল আমাদের  শুধু মেলাঘরের নয়  , ত্রিপুরার নয় ,সারা  পূর্ব ভারতের মধ্যে একটি  অসাধারণ জল মহল। নীরমহল জলের মাঝখানে গড়ে উঠা একটি রাজকীয় প্রাসাদ। আগরতলা থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার দূরে মেলাঘরে এই প্রাসাদ।নীরমহলের  সৃষ্টি বা এর পেছনে কি কাহিনী  লুকিয়ে আছে তা জানার আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই।তারপর সুভাগ্যবসত  আমার নীরমহলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমার বিয়ে হ‌ওয়ায় এই নীরমহলের আত্মকথা নিয়ে লেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। লেখালেখির জগতে সকলের সাথে পরিচিতির পর গোবিন্দ ধর স্যার( দাদা) আমায় নীরমহল নিয়ে কিছু  লিখতে বলেন।তখন থেকেই খুঁজতে থাকি আসলে এ লেখা জানতে হলে আমাকে অনেক বয়স হয়েছে এমন লোকের সাথে আমাকে দেখা করতে হবে এবং সব তথ্য জানতে হবে। অনেকদিন ধরে খোঁজাখুঁজির পর আমাদের গ্রামের ছেলে সমীর বলল নির্ধন স্যারের কথা। ভগবানের  চমৎকার বলতে পারেন একবছর খোঁজাখুঁজির পর  ওনার সাথে নামটা বলার সাথেসাথে দুদিন পর একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেল।আমি ওনার ফোন নম্বরটা ওনার সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে  জানতে পারলাম ওনি লেখালেখি করেন।ওনি একজন সাহিত্য প্রেমী্ও বটে। স্কুলে শিক্ষকতায় নিযুক্ত ছিলেন।এখন রিটায়ার্ড, বয়স ৭০ বা ৭৫   হবে।বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি।ওনি না থাকলে হয়তো এ তথ্য আমাকে কেউ দিতে পারত না।আর যাই হোক, ওনার প্রতি আমার  অশেষ কৃতজ্ঞতা রইলো।

১৯৩০ সালে রাজা কিশোর মানিক্য বাহাদুর এই প্রাসাদ  নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা নেন। স্থানীয় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শ্রীযুক্ত নির্ধন দাস স্যার থেকে জানতে পারি নীরমহল যেখানে  গড়ে উঠেছে তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় একটা ইটের ভাটা ছিল সেই ইট দিয়ে এই নীরমহল গড়ে তোলা হয়।রাজা এই কাজের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্থাৎ মার্টিন ও বার্নস  কোম্পানিকে এই কাজের  দায়িত্ব দিয়েছিলেন। স্থানীয় স্যার আরও বলেন যে এখানকার ইটের ভাটার ইটের রঙে ঐ জায়গাটা লাল অর্থাৎ রাঙা হয়ে থাকতো তাই পরবর্তী সময়ে ঐ জায়গাটার নাম দেওয়া হয় রাঙামুড়া। এই নীরমহল তৈরী করতে মোট সময় লাগে আট বছর ।১৯৩৮ সালে এ প্রাসাদের কাজ শেষ হয়।রাজা কিশোর মানিক্য বাহাদুর এখানে মূলতঃ বিনোদনের জন্য এ প্রাসাদটি তৈরী করেন।এখানে মোট চব্বিশটি কক্ষ আছে।রাজা নাটক, গান,আর নাচ দেখে বিনোদন  মূলক পিপাসা মেটাতেন।
নোয়াছড়া  আর কেমতলী ছড়া দিনের পর দিন ধাবিত হয়ে এই রুদিজলা  বা নীরমহলের  কাছাকাছি এসে ক্রমশঃ সংযুক্ত হয়ে পড়ে। এ নীরমহলের বিস্তর জলরাশি ,রাজেন্দ্রনগর,ছন্দনমুড়া ,কেমতলী, বটতলি  ঘ্রাণতলী, রাজঘাট ,প্রভৃতি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। রুদ্র সাগরের মাঝখানে এ বিশাল রাজপ্রাসাদ গড়ে উঠার পর  রাজা এ জলরাশি লীজ  দিতে মানুষের কাছে।তখনকার সময় আনুমানিক ১৯৪০-১৯৪২ থেকে হাবুল ব্যানার্জি রুদ্র সাগরের জলরাশি রাজার কাছ থেকে লীজ নেয়। এই জলরাশিতে প্রচুর পরিমাণে কাতল চিতল ,রুই এসব বড়ো বড়ো মাছ পাওয়া যেত। যা এখনও পাওয়া যায় আবার অনেকে চাষাবাদ‌ও করে থাকেন। মেলাঘরের  বৈরাগীবাজারে ব্যানার্জি বাগান সম্ভবত এটা ওনার নামেই নামকরন হয়েছে। হাবুল ব্যানার্জির সময়ে দুইজন ওয়াচম্যান ছিলেন।যারা নাকি রুদ্রসাগর দেখাশোনা করত। দুজনের মধ্যে  একজনের নাম সতীশ বোস ও অন্যজনের নাম ছিল রঙ্গ বাহাদুর কেশরী।সতীশ বোস বাড়ি পাশেই  মেলাঘরের ঠাকুর পাড়া এলাকায় আর রঙ্গ বাহাদুর কেশরী ছিলেন একজন নেপালী। দেশভাগের পর থেকেই উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটতে থাকে।১৯৫০-৫১ তে প্রচুর  জাতি উপজাতি উদ্বাস্তুর সমাগম ঘটে।তখন হয়তো উদ্বাস্তুদের চাপে হাবুল ব্যানার্জি  রুদ্রসাগরের জলরাশির লীজ ছেড়ে দিয়ে চলে যান। তারপর তিনি অনেক ফলের চারাগাছ লাগিয়ে  বৈরাগীবাজারে ব্যানার্জি বাগানের দেখাশোনা করতে থাকেন। আনুমানিক ১৯৭৮ সালে  সরকার এ ব্যানার্জি বাগান নিজ দখলে নেন।১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এবং রাজার মৃত্যু পর কীরিট বিক্রম অনেক ছোট ছিলেন । পাকিস্তানের রাষ্ট নায়করা রানীকে তাদের সাথে যুক্ত হবার প্রস্তাব দেন। কিন্ত রানী পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হন নি।তিনি  একা এ রাজ্যভার সামলাতে পারবেনা বলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু র সাথে যুক্ত হয়ে যান এবং সব সরকারের হাতে তুলে দেন।

১৯৪৭ সালের  পর থেকে উদ্বাস্তু মৎস্যচাষীরা  পাশাপাশি অঞ্চলে  বসবাস শুরু করেন।  রাত্রিকালীন মৎস্য শিকার,প্রাকৃতিক  দুর্যোগ, ঝড়, বৃষ্টি আর বন্যায় উদ্বাস্তু মৎস্যচাষীদের আশ্রয়স্থল ছিল  এ নীরমহল। 
নীরমহলের এ জায়গাটা রুদ্র সাগর বলেও  আঞ্চলিক খ্যাতি আছে। কারন যেহেতু রুদিজলা অঞ্চলে অবস্থিত বলে এখানকার মানুষেরা তাকে রুদ্র সাগর‌ও বলে থাকেন। রুদ্রসাগর বা রুদিজলাতে আঞ্চলিক মানুষেরা মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। দীর্ঘদিন পর এই জলার মাছ বা নীরমহলকে রক্ষনাবেক্ষণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় কার্যকরী কমিটির রিপোর্টে হিসাব,বাজেট,অডিট রিপোর্ট লেখা প্রকাশ হয়।এই লেখার মাধ্যমে আর‌ও জানতে পারি, সমিতির সম্পাদক ও স্থানীয় লোক শ্রী পরমেশ্বর দাস ওনার রিপোর্টে বলেছেন যে, ১৯৫১ সালে ১২ই নভেম্বর এ কমিটির নিবন্ধীকৃত হয়।রুদিজলার জলাঘাটে একটি বড় গেস্টহাউস তৈরি করা হয়। দূরদূরান্ত থেকে আগত অতিথিদের জন্য।ঐ গেস্টহাউস আচার অনুষ্ঠানে ভাড়াও দেওয়া হয়। দ এই জলাঘাট অঞ্চলের নাম রাজঘাট।সোনামুড়া বিভাগের মেলাঘর অঞ্চলের রাজঘাটে তৎকালীন ভারত সরকারের পূর্নবাসন দপ্তরের উদ্যোগে এই সমিতি গঠিত হয়।প্রথমে ৬০০ জন সদস্য নিয়ে  এ সমিতি গড়ে উঠে। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে বেড়ে বর্তমানে সমিতির সভ্য সংখ্যা দাড়িয়েছে ২০০০জন। তারমধ্যে তপশিল জাতি ভূক্ত সদস্য ১৯৯৯ জন ও সাধারণ ১ জন। এ সভ্য পরিবারের লোকেরা বর্তমানে ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও মেলাঘর পৌর পরিষদ এলাকায় বসবাস করেন।
বর্তমানে রুদিজলা, মেলাঘর, বড়দোয়াল, দুর্লভ নারায়ন, খাসচৌমুহনী, চৌমুহনী, পশ্চিম নলছড়, তেলকাজলা, চন্ডীগড়,-এই ৯টি মৌজার ২০৭১.৭৮এর মালিকানা সমিতির এলটম্যান্ট সূত্রপাত হয়।এই সমূদয় ভূমির মধ্যে ১৪৬৫একর ভূমি প্রথমে পূর্নবাসন প্রাপ্ত ৬০০ জন সভ্যের মধ্যে শুধুমাত্র কৃষিজাত ফসল উৎপাদনের জন্য অনুমতি দখল দেওয়া হয়। বর্তমানে ৯৬৭জন সভ্য উল্লেখিত ভূমিতে চাষাবাদ করছেন।৩৬৪একর হচ্ছে জলাভূমি, ২৪২ একর বাস্তুভূমি, রাস্তা, পুকুর, নাল ইত্যাদি। জলাশয়ের চৌহুদির মধ্যে (সমিতির দখলকৃত) অনেক সরকারী খাস ভূমি আছে।এই খাসভূমিগুলি সমিতির নামে এলটম্যান্ট পাওয়ার জন্য বহু আগেই থেকেই সমিতি সরকারের কাছে আবেদন করে আসছে। এখনও এলটম্যান্ট পাওয়া যায় নি।
সমিতির সরকারী খাস জমিতে এখন আঞ্চলিক মানুষেরা কৃষিকাজ করে তাদের দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে পেরেছে। মৎস্য চাষীদের জন্য তো এ রুদিজলা মায়ের সমান।মায়েরা যেমন সর্বস্ব দিয়ে সন্তান সন্ততির   আদর যত্ন করে তেমনি এ জলাভূমি থেকে মানুষেরা
মাছ ধরে  নিজেদের যেমন পেট চালাতে পারছে তেমনি আবার  এ জলাভূমি জীবিকা নির্বাহের এক বিরাট পন্থা হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা নেয়।এক উত্তরসূরী থেকে বংশানুক্রমিকভাবে  তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য ব্যতিক্রমী চিন্তাধারা করতে হয় না।
প্রতিবছর শীতকালীন সময়ে 
এখানে পর্যটকদের বেপরোয়া লাইন লেগেই থাকে। তাছাড়া ও প্রত্যেকদিন দেশ বিদেশের  প্রচুর লোকের  সমাগম ঘটে এই রুদ্রসাগরে।।প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে নীরমহলে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তিনদিনব্যাপী এখানে লাইটিং শো চলে।আলোর আলোড়নে ঝকঝকে উজ্জ্বল হয়ে থাকে এ নীরমহল।চলে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন  নাচ, গান , নাটক  এবং পদ্ম পুরানের প্রতিযোগিতা। প্রত্যেক বছর সমিতির সকল সদস্যদের মধ্যে দূর্গোৎসবের সময়  কাপড় বিতরন করা হয়। বর্তমানকালে আনন্দবাজার মার্কেট,পাটবাজার,থানা সংলগ্ন মার্কেট, অফিস,গোদাম ঘর, ফিস লেডিং সেন্টার, নৌকা জাল ,স্পীড বোট ,ফিসিং নেট, আসবাবপত্র জীপ গাড়ি ,জেনারেটর ইত্যাদি স্থায়ী সম্পদ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমিতির পরিচালনায় দৈনন্দিন আয় হচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ