শতবর্ষে বিমল চৌধুরী: ত্রিপুরায় ছোটোগল্প চর্চায় আদি প্রাণপুরুষ:বিমল চক্রবর্তী
গোড়ার কথা:
(১)
পৃথিবীর ইতিহাস পৃথিবীর মত বিশাল এবং প্রাচীন তবে ঠিক আজকের যুগে পৃথিবীতে আমরা ঠিক যেভাবে বা যে রূপে দেখছি- মহাকাল জন্মলগ্নে পৃথিবীর সেইরূপ সেই প্রকৃতি ছিল না। প্রাকৃতিক নিয়মে সবকিছুর যেমন পরিবর্তন ঘটবে প্রকৃতির রূপেরও তেমন রূপান্তর ঘটছে কোটি কোটি বছরের এক সুদীর্ঘ রূপান্তরের মাধ্যমে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীর বয়স কমপক্ষে ৪৫০ কোটি বৎসর। যদিও একশ কোটি বৎসরের ইতিহাস এখন পর্যন্ত অজানা। প্রকৃত ইতিহাস জানা যায় শুধুমাত্র ৬০ কোটি বৎসরের। কারণ সুদৃঢ় অতীতের আশ্চর্য জন্মদর্শন করার জন্য কোন জীবিত প্রাণী উপস্থিত ছিল না, ছিল কিছু পাথর আর দুর্লভ মৌলিক পদার্থ রেডিয়াম। এই রেডিয়ামের সিসার পরিমাণ দেখে পৃথিবীর গল্প জানা যায়। আর মানুষের বড় হওয়ার কাহিনী জানা যায় লোক কথা, লোক কাহিনী এবং পুরাণ কথায়।
কিন্তু মানুষের গল্প আর ছোটো গল্প এক নয়, গল্প হল- বর্ণিত অখ্যান। কিন্তু ছোটো গল্প অখ্যানাকে বিশেষ রীতি, শৈলী ও রূপে প্রকাশ করা হয়। সাহিত্য শিল্পের মধ্যে ছোটো গল্প হল সর্বাধুনিক। ছোটো গল্পের জন্ম হয়েছে উনিশ শতকে। ছোটো গল্প লেখকের ব্যক্তিত্বমণ্ডিত রচনা। গল্প বলা আর গল্প শোনার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ভারতের প্রাচীন গল্পগুলোর রূপ দেখা যায় জাতকে, পঞ্চতন্ত্রে, কথা সুর সাগরে বৃহৎ কথায়, উদয়ন কথায়, দশ কুমার চরিতে কিংবা হিতোপদেশ। আরবী ভাষায় রয়েছে অলেফ লায়লার কাহিনী। ফার্সীতে পরাশ্য উপন্যাস ও তোতা কাহিনী। ইউরোপে গল্পের উৎস পাওয়া যায় বাইবেলের নানা কাহিনীতে এবং মাইথোলজিতে। চসারের "ক্যান্টার বেরির টেলস্" ইতালিও লেখক বোক্কাচিযোয় ডেকামের-এ। ছোটোগল্পের প্রকৃত শিল্পরূপের প্রকাশ ঘাটে ইউরোপের শিল্প বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের পরে। বাস্তব জীবনের আলেখ্য জন্ম দেওয়ার জন্য ছোটোগল্পের বিকাশ শুরু হয়ে। ছোটোগল্পকে চিরকালিন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেন মৌপাশা প্রতিভাবান ছোটোগল্পকার পুসকিন গোগোল, টলস্টয়, গর্গি প্রমুখ। অন্তব চেকব ছিলে ছোট গল্পের আর এক মহারাজা।
কথামুখ: বাংলা ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই প্রথম শ্রেষ্ঠতম পুরুষ। বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটিয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিনিধিমূলক প্রেরণা থেকে। রবীন্দ্রনাথকে পূবসূরি মেনে বাংলা গল্প বিবর্তিত হয়েছে পশ্চিমবাংলার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুবোধ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, বিমল কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, মণীষ ঘটক, অমিয়ভূষণ মজুমদার, মতি নন্দী, অসীম রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, বরেণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, মধুময় পাল, অভিজিৎ সেন, অমর মিত্র, অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, অসীম ত্রিবেদী, কিন্নর রায়, কামাল হেসেন, নলিনী বেরা, বীরেন শাসমল, ভাগীরত মিশ্র, মানব চক্রবর্তী, মর্শিদ এ. এম, রামকুমার মুখোপাধ্যায়, রবিশঙ্কর বল, সমীর চৌধুরী, সমীর রক্ষিত, মোহবার হোসেন। স্বপন সেন, সৈকত রক্ষিত, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পভুবনের পথরেখার ব্যাসার্ধকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশে বিবর্তিত শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, অখতারজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, বশীর আলহেলাল, সেলিনা হোসেন, হুমায়ন
(২)
আমেদ, রসীদ, হায়দার, সৈয়দ সামসুল হক, রাহাত খান, বারেক আবদুল্লাহ, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, রাজিব নূর, আহমেদ মুস্তাফা কামাল, সাদ কামালী, পাপড়ি রহমান, শাহনাজ মুন্নি, গল্প-জগৎ কেন্দ্র করে।
ত্রিপুরায় বাংলা গল্প বিবর্তিত হয়েছে- অজিতবন্ধু দেববর্মা, রাজ্যেশ্বর মিত্র, হরিদাস চক্রবর্তী, বিধুভূষণ দেব, প্রবোধচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিমল চৌধুরী, কালিপদ চক্রবর্তী, অনিল সরকার, ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক, কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, ক্ষতেন চক্রবর্তী, অপরাজিতা রায়, কমলকুমার সিংহ, সুবিমল রায়, সুখময় ঘোষ, মনী কর, অনাদি ভট্টাচার্য, বিমল সিংহ, মানস দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, অরুণোদয় সাহা, দুলাল ঘোষ, অনুপ ভট্টাচার্য, সমরজিৎ সিংহ, মীনাক্ষী সেন, অসিত দত্ত, শ্যামল ভট্টাচার্য, দীপক দেব, দেবব্রত দেব, কিশোর রঞ্জন দে, নিলিপ পোদ্দার, অশোক চক্রবর্তী, সন্তোষ রায়, সুজয় রায়, সুশীল কুমার দে, মানিক চক্রবর্তী, সদানন্দ সিংহ, শুভাশিষ তলাপাত্র, জয়া গোয়ালা, কল্যাণী ভট্টাচার্য, মাধুরী লোদ, শ্যামাপদ চক্রবর্তী, গৌরী বর্মণ, হরিভূষণ পাল, প্রদীপ সরকারদের গল্পভুবনকে কেন্দ্র করে।
'ত্রিপুরার বাংলা গল্প' বলতে আমরা আলাদাভাবে কী সংজ্ঞায়িত করব? বুঝব ত্রিপুরার ভৌগোলিক পরিবেশ, ভাষা সমাজ-সংস্কৃতির জটিল বৈচিত্র্য এবং তার রূপান্তরের প্রভাবে মানুষের মানসিক জগতে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল, তার আত্মস্থ বর্ণমালার কথকতা। দাদন, তিতুন, জনশিক্ষার জন্য সংগ্রাম, ময়াল শোষণ, ডাইনি প্রথা, গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য সংগ্রাম, জাতিসত্ত্বার বিকাশের সংকট, জনজাতির ভাষা-সংস্কৃতির সংকট এবং শেকড় হারানো বাঙালিদের সংকটময় জীবনের কথামালা।
পৃথিবীর সবদেশেই ছোটোগল্প রচনার বিস্তারের পরিবেশ রচনার অনুঘটক হিসাবে গুরুতর দায়িত্ব পালন
করেছিলেন সাময়িক সাহিত্যপত্রের প্রকাশ। মোপাসাঁ থেকে ও হেনরি, চেকত থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেরই আত্মপ্রকাশের তাগিদ ও অবলম্বন ছিল বিবিধ সাময়িক সাহিত্যপত্র। মৌপাসা তিন শতাধিক ছোটোগল্প প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নানা পত্রিকায়। চেকভ তো সংসারের প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর জন্য ছাত্র অবস্থায় চটজলদি গল্প লিখে পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়ে অর্থ শিকার করতেন। এভাবেই লেখা হয়েছিল প্রচুর শিল্পসফল গল্প। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি যখন আত্মপ্রকাশ করলেন, বাংলা সাহিত্যের ভূখণ্ডে তখন শুরু হয়ে গেছে নানা সাময়িকপত্রের সদর্প পদসঞ্চার। নিজেদের বাড়ির 'ভারতী' ও 'সাধনা'র জন্য প্রচুর গল্প লিখতে হয়েছিল। বিশ্য তার গল্প রচনার প্রবাহের ভাগীরথ হিসাবে দেখা দিয়েছিল। 'হিতবাদী'। তারপর নানাধর্মী পত্রিকায় আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁকে সারাজীবন লিখতে হয়েছে ক্রমাগত। তার ফলে তাঁর গল্পের বিষয় ও তাল্লিকে এসেছে অভিনব বৈচিত্র্য; যার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ ঘটেছে ১৯১৪ খ্রীষ্মব্দের 'সবুজপত্র' পত্রিকার আবির্ভাবে। এ পরম্পরাকে মেনেই যেন গত একশো বছর ধরে যে সকল সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়ে এসেছে। তাদের সারস্বত সাধনার অন্যতম উপকরণ হিসাবে দেকা দিয়েছে ছোটোগল্প রচনা সমারোহ। সাহিত্য, নারায়ণী, মানসী ও মমবাণী, বিচিত্রা, কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি প্রতিটি পত্রিকায় ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছোটোগল্পের সমারোহপূর্ণ বিচিত্র ভাণ্ডার।
কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), কালিকলম (১৯২৬), বিচিত্রা (১৯২৭), পরিচয় (১৯৩১),
বঙ্গশ্রী (১৯৩২), দেশ (১৯৩৩), চতুরঙ্গ (১৯৩৮)-এই সাময়িকপত্রগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব
ছিল। যাদের বাংলা সাহিত্যকে, বিশেষ কার ছোটোগল্পকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।
ত্রিপুরাও এই পরম্পরার বাইরে নয়। ত্রিপুরাও প্রথম ছোটোগল্পের চর্চা শুরু হয় সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র
করেই।
(৩)
আমেদ, রসীদ, হায়দার, সৈয়দ সামসুল হক, রাহাত খান, বারেক আবদুল্লাহ, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, রাজিব নূর, আহমেদ মুস্তাফা কামাল, সাদ কামালী, পাপড়ি রহমান, শাহনাজ মুন্নি, গল্প-জগৎ কেন্দ্র করে।
ত্রিপুরায় বাংলা গল্প বিবর্তিত হয়েছে- অজিতবন্ধু দেববর্মা, রাজ্যেশ্বর মিত্র, হরিদাস চক্রবর্তী, বিধুভূষণ দেব, প্রবোধচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিমল চৌধুরী, কালিপদ চক্রবর্তী, অনিল সরকার, ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক, কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, ক্ষতেন চক্রবর্তী, অপরাজিতা রায়, কমলকুমার সিংহ, সুবিমল রায়, সুখময় ঘোষ, মনী কর, অনাদি ভট্টাচার্য, বিমল সিংহ, মানস দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, অরুণোদয় সাহা, দুলাল ঘোষ, অনুপ ভট্টাচার্য, সমরজিৎ সিংহ, মীনাক্ষী সেন, অসিত দত্ত, শ্যামল ভট্টাচার্য, দীপক দেব, দেবব্রত দেব, কিশোর রঞ্জন দে, নিলিপ পোদ্দার, অশোক চক্রবর্তী, সন্তোষ রায়, সুজয় রায়, সুশীল কুমার দে, মানিক চক্রবর্তী, সদানন্দ সিংহ, শুভাশিষ তলাপাত্র, জয়া গোয়ালা, কল্যাণী ভট্টাচার্য, মাধুরী লোদ, শ্যামাপদ চক্রবর্তী, গৌরী বর্মণ, হরিভূষণ পাল, প্রদীপ সরকারদের গল্পভুবনকে কেন্দ্র করে।
'ত্রিপুরার বাংলা গল্প' বলতে আমরা আলাদাভাবে কী সংজ্ঞায়িত করব? বুঝব ত্রিপুরার ভৌগোলিক পরিবেশ, ভাষা সমাজ-সংস্কৃতির জটিল বৈচিত্র্য এবং তার রূপান্তরের প্রভাবে মানুষের মানসিক জগতে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল, তার আত্মস্থ বর্ণমালার কথকতা। দাদন, তিতুন, জনশিক্ষার জন্য সংগ্রাম, ময়াল শোষণ, ডাইনি প্রথা, গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য সংগ্রাম, জাতিসত্ত্বার বিকাশের সংকট, জনজাতির ভাষা-সংস্কৃতির সংকট এবং শেকড় হারানো বাঙালিদের সংকটময় জীবনের কথামালা।
পৃথিবীর সবদেশেই ছোটোগল্প রচনার বিস্তারের পরিবেশ রচনার অনুঘটক হিসাবে গুরুতর দায়িত্ব পালন
করেছিলেন সাময়িক সাহিত্যপত্রের প্রকাশ। মোপাসাঁ থেকে ও হেনরি, চেকত থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেরই আত্মপ্রকাশের তাগিদ ও অবলম্বন ছিল বিবিধ সাময়িক সাহিত্যপত্র। মৌপাসা তিন শতাধিক ছোটোগল্প প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নানা পত্রিকায়। চেকভ তো সংসারের প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর জন্য ছাত্র অবস্থায় চটজলদি গল্প লিখে পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়ে অর্থ শিকার করতেন। এভাবেই লেখা হয়েছিল প্রচুর শিল্পসফল গল্প। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি যখন আত্মপ্রকাশ করলেন, বাংলা সাহিত্যের ভূখণ্ডে তখন শুরু হয়ে গেছে নানা সাময়িকপত্রের সদর্প পদসঞ্চার। নিজেদের বাড়ির 'ভারতী' ও 'সাধনা'র জন্য প্রচুর গল্প লিখতে হয়েছিল। বিশ্য তার গল্প রচনার প্রবাহের ভাগীরথ হিসাবে দেখা দিয়েছিল। 'হিতবাদী'। তারপর নানাধর্মী পত্রিকায় আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁকে সারাজীবন লিখতে হয়েছে ক্রমাগত। তার ফলে তাঁর গল্পের বিষয় ও তাল্লিকে এসেছে অভিনব বৈচিত্র্য; যার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ ঘটেছে ১৯১৪ খ্রীষ্মব্দের 'সবুজপত্র' পত্রিকার আবির্ভাবে। এ পরম্পরাকে মেনেই যেন গত একশো বছর ধরে যে সকল সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়ে এসেছে। তাদের সারস্বত সাধনার অন্যতম উপকরণ হিসাবে দেকা দিয়েছে ছোটোগল্প রচনা সমারোহ। সাহিত্য, নারায়ণী, মানসী ও মমবাণী, বিচিত্রা, কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি প্রতিটি পত্রিকায় ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছোটোগল্পের সমারোহপূর্ণ বিচিত্র ভাণ্ডার।
কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), কালিকলম (১৯২৬), বিচিত্রা (১৯২৭), পরিচয় (১৯৩১),
বঙ্গশ্রী (১৯৩২), দেশ (১৯৩৩), চতুরঙ্গ (১৯৩৮)-এই সাময়িকপত্রগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব
ছিল। যাদের বাংলা সাহিত্যকে, বিশেষ কার ছোটোগল্পকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।
ত্রিপুরাও এই পরম্পরার বাইরে নয়। ত্রিপুরাও প্রথম ছোটোগল্পের চর্চা শুরু হয় সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র
করেই।
(৪)
আমেদ, রসীদ, হায়দার, সৈয়দ সামসুল হক, রাহাত খান, বারেক আবদুল্লাহ, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, রাজিব নূর, আহমেদ মুস্তাফা কামাল, সাদ কামালী, পাপড়ি রহমান, শাহনাজ মুন্নি, গল্প-জগৎ কেন্দ্র করে।
ত্রিপুরায় বাংলা গল্প বিবর্তিত হয়েছে- অজিতবন্ধু দেববর্মা, রাজ্যেশ্বর মিত্র, হরিদাস চক্রবর্তী, বিধুভূষণ দেব, প্রবোধচন্দ্র রায়চৌধুরী, বিমল চৌধুরী, কালিপদ চক্রবর্তী, অনিল সরকার, ভূপেন্দ্র দত্ত ভৌমিক, কল্যাণব্রত চক্রবর্তী, ক্ষতেন চক্রবর্তী, অপরাজিতা রায়, কমলকুমার সিংহ, সুবিমল রায়, সুখময় ঘোষ, মনী কর, অনাদি ভট্টাচার্য, বিমল সিংহ, মানস দেববর্মণ, খগেশ দেববর্মণ, অরুণোদয় সাহা, দুলাল ঘোষ, অনুপ ভট্টাচার্য, সমরজিৎ সিংহ, মীনাক্ষী সেন, অসিত দত্ত, শ্যামল ভট্টাচার্য, দীপক দেব, দেবব্রত দেব, কিশোর রঞ্জন দে, নিলিপ পোদ্দার, অশোক চক্রবর্তী, সন্তোষ রায়, সুজয় রায়, সুশীল কুমার দে, মানিক চক্রবর্তী, সদানন্দ সিংহ, শুভাশিষ তলাপাত্র, জয়া গোয়ালা, কল্যাণী ভট্টাচার্য, মাধুরী লোদ, শ্যামাপদ চক্রবর্তী, গৌরী বর্মণ, হরিভূষণ পাল, প্রদীপ সরকারদের গল্পভুবনকে কেন্দ্র করে।
'ত্রিপুরার বাংলা গল্প' বলতে আমরা আলাদাভাবে কী সংজ্ঞায়িত করব? বুঝব ত্রিপুরার ভৌগোলিক পরিবেশ, ভাষা সমাজ-সংস্কৃতির জটিল বৈচিত্র্য এবং তার রূপান্তরের প্রভাবে মানুষের মানসিক জগতে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল, তার আত্মস্থ বর্ণমালার কথকতা। দাদন, তিতুন, জনশিক্ষার জন্য সংগ্রাম, ময়াল শোষণ, ডাইনি প্রথা, গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য সংগ্রাম, জাতিসত্ত্বার বিকাশের সংকট, জনজাতির ভাষা-সংস্কৃতির সংকট এবং শেকড় হারানো বাঙালিদের সংকটময় জীবনের কথামালা।
পৃথিবীর সবদেশেই ছোটোগল্প রচনার বিস্তারের পরিবেশ রচনার অনুঘটক হিসাবে গুরুতর দায়িত্ব পালন
করেছিলেন সাময়িক সাহিত্যপত্রের প্রকাশ। মোপাসাঁ থেকে ও হেনরি, চেকত থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেরই আত্মপ্রকাশের তাগিদ ও অবলম্বন ছিল বিবিধ সাময়িক সাহিত্যপত্র। মৌপাসা তিন শতাধিক ছোটোগল্প প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল নানা পত্রিকায়। চেকভ তো সংসারের প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর জন্য ছাত্র অবস্থায় চটজলদি গল্প লিখে পত্রিকা দপ্তরে পাঠিয়ে অর্থ শিকার করতেন। এভাবেই লেখা হয়েছিল প্রচুর শিল্পসফল গল্প। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি যখন আত্মপ্রকাশ করলেন, বাংলা সাহিত্যের ভূখণ্ডে তখন শুরু হয়ে গেছে নানা সাময়িকপত্রের সদর্প পদসঞ্চার। নিজেদের বাড়ির 'ভারতী' ও 'সাধনা'র জন্য প্রচুর গল্প লিখতে হয়েছিল। বিশ্য তার গল্প রচনার প্রবাহের ভাগীরথ হিসাবে দেখা দিয়েছিল। 'হিতবাদী'। তারপর নানাধর্মী পত্রিকায় আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁকে সারাজীবন লিখতে হয়েছে ক্রমাগত। তার ফলে তাঁর গল্পের বিষয় ও তাল্লিকে এসেছে অভিনব বৈচিত্র্য; যার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ ঘটেছে ১৯১৪ খ্রীষ্মব্দের 'সবুজপত্র' পত্রিকার আবির্ভাবে। এ পরম্পরাকে মেনেই যেন গত একশো বছর ধরে যে সকল সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়ে এসেছে। তাদের সারস্বত সাধনার অন্যতম উপকরণ হিসাবে দেকা দিয়েছে ছোটোগল্প রচনা সমারোহ। সাহিত্য, নারায়ণী, মানসী ও মমবাণী, বিচিত্রা, কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি প্রতিটি পত্রিকায় ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছোটোগল্পের সমারোহপূর্ণ বিচিত্র ভাণ্ডার।
কল্লোল (১৯২৩), শনিবারের চিঠি (১৯২৪), কালিকলম (১৯২৬), বিচিত্রা (১৯২৭), পরিচয় (১৯৩১),
বঙ্গশ্রী (১৯৩২), দেশ (১৯৩৩), চতুরঙ্গ (১৯৩৮)-এই সাময়িকপত্রগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব
ছিল। যাদের বাংলা সাহিত্যকে, বিশেষ কার ছোটোগল্পকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।
ত্রিপুরাও এই পরম্পরার বাইরে নয়। ত্রিপুরাও প্রথম ছোটোগল্পের চর্চা শুরু হয় সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র
করেই।
(৫)
পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন-শঙ্করমোহন চট্টোপাধ্যায় এবং অমরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ত্রিপুরা সাময়িকপত্রে যাঁরা গল্পচর্চা করেছিলেন তাঁরা হলেন মুরারি ঘোষ, বিনোদ লাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যেশ্বর মিত্র এবং শৈলেশ চন্দ্র চক্রবর্তী। 'ত্রিপুরা' সাহিত্য পত্রিকাটি প্রায় চার বছর ধরে ত্রিপুরার বাংলা ছোটগল্প চর্চাকে কিছুটা হলেও সম্প্রসারিত করেছিল, যদি কোন নিজস্ব মাত্রা যোগ করতে পারেনি। ছোট গল্প চর্চার ইতিহাসে।
'ত্রিপুরা' সাহিত্য সাময়িকীর পর যে পত্রিকা ত্রিপুরার ছোটগল্প চর্চার ইতিহাসকে প্রশস্ত করে সেটি হল 'নবজাগরণ'। নবজাগরণই প্রথম 'রবি' পত্রিকার পর সাহিত্য গোষ্ঠী তৈরি করেছিল। 'নবজাগরণ'কে কেন্দ্র করে তৈরি সাহিত্যগোষ্ঠী ছিল অন্যরকম। 'নবজাগরণ' গোষ্ঠী এলিট সোসাইটির বাইরে সাহিত্যচর্চাকে কিছুটা নিয়ে যেতে পেরেছিল প্রাথমিক প্রকাশ হিসাবে। 'নবজাগরণ' পত্রিকায় যারা নিয়মিত গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন, তাঁরা হলেন, হরিদাস চক্রবর্তী, বিমল চৌধুরী, সৈয়দ নরুল হুদা, পৃথ্বিশ ভট্টাচার্য, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য এবং অনিল চন্দ্র ভট্টাচার্য। অথচ ইতিহাসের বিশ্লেষণ রেখার আলোকে বলা যায়, ত্রিপুরার ঐ সময় গল্পচর্চার স্রোত অন্যখাতে প্রবাহিত হতে পারত। কারণ ত্রিপুরার তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ছিল
অনেকটাই সম্প্রসারিত।
১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরায় অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল, ১৯২২ সালে চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের সম্মেলনের প্রভাব ত্রিপুরায় পড়েছিল- এসব রাজনৈতিক চেতনার প্রভাব হিসাবে ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- ছাত্রসংঘ। ১৯২৮ সালে স্থাপিত হয়েছিল ভ্রাতৃসংঘ। ভ্রাতৃসংঘ ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারী স্বাধীনতা দিবসও পালন করল। অথচ স্বতঃস্ফূর্ত প্রজা বিদ্রোহের ধারা, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী ধারা, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ধারা, বামপন্থী প্রগতিশীল আন্দোলনের ধারা- এসব কোনও ধারাই ত্রিপুরার ছোটোগল্পের চর্চাকে সম্প্রসারিত করতে পারেনি। ১৯৩৮ সালে গঠিত জনমঙ্গল সমিতির নেতৃবৃন্দ বীরেন্দ্র দত্ত, বংশীঠাকুর, প্রভাত রায়, সুকুমার ভৌমিক এবং কীর্তি সিংহরা ত্রিপুরার সাহিত্য আন্দোলনকে সরাসরি তাঁদের চেতনার আলোকে সম্প্রসারিত করতে পারেননি। কিন্তু রাজনৈতিক চেতনা-বিন্দুই নবজাগরণের জন্ম দিয়েছিল। যে নবজাগরণের ফসল 'মানুষের চন্দ্রবিজয় ও তারানাথ' গ্রন্থটির আত্মপ্রকাশ ১৯৭৩ সালে ঘটলেও এই সংকল্পের গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল এর বহু পূর্বে, বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকায়। যেমন 'জাগরণ' ১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দে।
বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাস ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আনক চিরায়ত ছোটোগল্প সৃষ্টি হয়ে গেছে। 'দেনাপাওনা', 'একরাত্রি', 'কাবুলিওয়ালা', 'ছুটি', 'শাস্তি', 'নিশীথে', 'অতিথি',- রবিঠাকুরের এসব ক্লাসিক গল্প লেখা হয়ে গেল, পদ্মার বুকে দরিদ্র গ্রামীণ মানবজীবন রবি ঠাকুরের কলমে চিত্রায়িত হল। মানুষের সুখ দুঃ খ, সমস্যা, সৌন্দর্য, দরিদ্র ভারতের মুখচ্ছবি বাংলা ছোটোগল্প এতদিনে দেখে ফেলেছে। অথচ ত্রিপুরার ছোটোগল্পের কোনও ইতিহাস বিন্দু তৈরি হল না ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে। রাজন্যযুগের কোনও গণআন্দোলনকেই তুলে আনতে পারলেন না কোনও ছোটো গল্পকার। অথচ স্বাধীনতা আন্দোলন ত্রিপুরার বুকে সরাসরি না থাকলেও, তার দারুণ প্রভাব ছিল। অনুশীলন সমিতি বেশ কিছু নেতা ত্রিপুরার জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অনুশীলন সমিতির জন্ম হয়েছিল ১৯০২ সালে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শকে ভিত্তি করে। ত্রিপুরার পলিটিক্যাল রাজধানী কুমিল্লা ছিল সমাজ পরিবর্তনের জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। এসব আন্দোলনের সরাসরি প্রভাব পড়েছিল ত্রিপুরার জনগণের মধ্যে। অথচ এসব বিষয় ত্রিপুরার ছোটোগল্পের ইতিহাস তৈরিতে কোন সাহায্য করতে পারল না।
(৬)
ত্রিপুরার স্বতঃস্ফূর্ত প্রজা বিদ্রোহের ধারায় ছোটোগল্পের যে ধারার তৈরি কথা ছিল, তা করতে পারল না। সমশের গাজীর বিদ্রোহ, কুকি বিদ্রোহ (১৮৬০-৬১), ত্রিপুরী বিদ্রোহ ১৮৫০, জমাতিয়া বিদ্রোহ ১৮৫৩, রিয়াং বিদ্রোহ, গোলাঘাটি কৃষক বিদ্রোহ, পদ্মবিলের নারী বিদ্রোহ, ত্রিপুরা সাহিত্যের মধ্যে সমাজ বাস্তবতার আলোকে কোনও ধারা তৈরি করতে সাহায্য করল না।
ত্রিপুরার ছোটোগল্পের প্রাণপুরুষ বিমল চৌধুরী। বিমল চৌধুরীর জন্ম ১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে। ১৯২২এর সময় রেখা ঐতিহাসিক ভাবে নানাহ ভাবে তাৎপর্যমন্ডিত। আমরা জানি, ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি কাজি নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' কবিতা রচনা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম তরঙ্গরেখায় দাড়িয়ে অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলন সমস্ত ভারতবর্ষকে আন্দোলিত করে তুলেছিল। নজরুল প্রকাশ করলেন 'ধূমকেতু' পত্রিতাক। বোম্বাই থেকে প্রকাশিত হয় অমৃত ডাঙ্গের 'দ্য সোসাইলিস্ট' পত্রিকা ইত্যাদি। আমরা জানি গেন্ডারিয়া বর্তমানে ঢাকা জেলা বা বিভাগের একটি থানা, একসময় এই স্থানে প্রচুর গ্যান্ডারি বা সুগার ক্যান চার্য হত। এক সময় এই অঞ্চলটির দুলাইগঞ্জ হিসাবে পরিচিত ছিল। তাঁর পিতা ছিলেন পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত কবিরাজ যামিনী ভূষণ চৌধুরী। তিনি পড়াশুনা করেছেন ঢাকার জুবিলি স্কুলে। আমরা জানি এই জুবেলি স্কুল বর্তমানে স্কুল এবং কলেজের যৌথ সম্বন্বয়। এর পুরো নাম কিশোরী লাল জুবেলি স্কুল এবং কলেজ। ঢাকার বিখ্যাত জমিদার কিশোরী লাল রায়চৌধুরী ১৮৬৭ খ্রীষ্টাব্দে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই স্কুলের বিখ্যাত ছাত্র পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা, এবং বিখ্যাত বাঙালী শরীর চর্চাবিদ মনোহর আইচ। এই কিশোরী লাল জুবেলি স্কুলের সঙ্গে বিমল চৌধুরীর স্বনামধন্য পিতা যামিনী ভূষণ যুক্ত ছিলেন। এই কলেজটি এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্ট্রাইট আয়ুবেদ কলেজ এবং হাসপাতাল। ১৯৪০ সালে নবজাগরণ পত্রিকায় একটি কাহিনী বের হয়: এই 'নবজাগরণ' পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় বিমল চৌধুরীর একটি প্রতিবাদী গল্প প্রকাশের জন্য। ১৯৪৯ সালে উমাকান্ত স্কুলে খাদ্য আন্দোলনের জনসভায় পুলিশের গুলির প্রতিবাদে গল্পটি লেখা হয়েছিল। গল্পের নাম ছিল- 'তোরে নাহি করি ভয়।'
আমরা জানি নবজাগরণ ত্রিপুরার সংবাদপত্রে ইতিহাসে নানাহভাবে নবজাগরণ তৈরি করেছিল। নবজাগরণের শিরোনামের নিচে লেখা থাকত "ত্রিপুরার রাজ্যের একমাত্র নিরপেক্ষ সাপ্তাহিক।" পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা ও নরুল হুদা। সংবাদ সাহিত্য পত্রটি প্রতি বধুবার প্রকাশিত হত। প্রকাশনার স্থান ছিল মোটর স্ট্যান্ডের সাফিয়া প্রেস, সাফিয়া প্রেস প্রথমে সেন্টাল রোডে ছিল এই প্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ত্রিপুরার বিতর্কিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব আবদুল বারিক খান ঔরফে গেঁদু মিয়া। আমরা জানি নবজাগরণ পত্রিকার নিয়মাবলীতে ছিল- রাজ্যের তরুণ সাহিত্য মোদিদের উৎসাহ দান সেই কারণে তাদের রচনা বিশেষ বিবেচনার সঙ্গে প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বৎসরের প্রাক্কালে সম্পাদক হিসাবে নরুল হুদার পরিবর্তে গোলাম নবী নিয়োজিত হয়েছিলেন। নরুল হুদা এবং গোলাম নবী দুজনেই সাহিত্যের ভক্ত ছিলেন। নবজাগরণ পত্রিকার লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন- বিমল চৌধুরী, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, হরিদাস চক্রবর্তী, পৃথিশ ভট্টাচার্য, সলিল কৃষ্ণ দেববর্মণ, মহেন্দ্র দেববর্মণ প্রমুখ। এই নবজাগরণ পত্রিকায়ই বিমল চৌধুরীকে লেখক হিসাবে প্রথম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। একটি সংবাদ পত্রের ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা ইতিহাসে খুব বিরল।
(৭)
আমরা জানি তোরে নাহি করি ভয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের ৩৭ নং কবিতার একটি জনপ্রিয় লাইনকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায় বলেছিলেন- "দূর হতে কি গুনিস মৃত্যুর গর্জন, /ওরে দীন/ওর উদাসিন/দুঃখের দেখেছি নিত্য/পাপেরে দেখেছি নানাছলে/অশান্তির ঘূর্ণ দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে: আজ দেখ তাহাদের অভ্রভেদী বিরাট স্বরূপ তারপরে দাঁড়াও সম্মুখে বল অকম্পিত বুকে।"তোরে নাহি কবি ভয়।/এ সংসারে তোরে প্রতিদিন করিয়াছি জয়।'- এই ভয়কে জয় করার গল্পই ছিল। 'তোরে নাহি করি ভয়' গল্পটি। এই গল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়নি বলে বহু আড্ডায় বিমল চৌধুরী তার অনুশোচনা প্রকাশ করতেন। আমরা জানি ১৯৪৯ সাল ত্রিপুরার ইতিহাসের সময়রেখায় বিষণভাবে ঝড়ঝঞ্জার সময়। ঐতিহাসিক রূপান্তরের সময়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী যখন অখণ্ড ভারতবর্ষকে ভেঙ্গে দু-টুকরো করে দেয় তখন এ অঞ্চলের শাসনতন্ত্র এবং গণমানস উভয়ের প্ল্যাটফর্মে দুলন এবং কম্পন তৈরি হয়। ১৯৪৯ সালেই রাজতন্ত্রের ত্রিপুরা গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের কাটামোর সঙ্গে যুক্ত হয়। সংবিধান অনুসারে ত্রিপুরা 'গ'-শ্রেণী রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ণ রাজ্য না হওয়ায় আইনসভা, বিচার বিভাগ এবং গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো কিছুই তার ভাগ্যে জুটেনি। একটি উপনিবেশিক পদ- "চিপ কমিশনার" ত্রিপুরার জন্য বরাদ্ধ করা হয়। ফলে গণতন্ত্রের বদলে নিপীড়নের নতুন যাত্রাপথ তৈরি হয়। এরই বিরুদ্ধ গণআন্দোলনের ফসল- 'তোরে নাহি করি ভয়'। অন্যক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা গল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। কারণ পত্রিকাটি রাষ্ট্রতন্ত্র কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়ার পর সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে গিয়েছিল।
১৯২২ এর সময়রেখা ঐতিহাসিকভাবে নানাহভাবে তাৎপর্যখণ্ডিত। আমরা জানি, ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারী কাজী নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' কবিতা রচনা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম তরঙ্গ রেখায় দাঁড়িয়ে। অসহযোগ আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলন সমস্ত ভারতবর্ষকে আন্দোলিত করে তুলেছিল। নজরুল প্রকাশ করলেন 'ধুমকেতু' পত্রিকা। বোম্বাই থেকে প্রকাশিত হয়। মৃত ভঙ্গের The Socielist পত্রিকা ইত্যাদি। বিমল চৌধুরীর প্রথম গল্প সংকলট প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৪৪ সালে তাঁর গল্প লেখা শুরু হয়েছিল। লেখা শুরু করার প্রায় ত্রিশ বছর পর বিমল চৌধুরীর প্রথম গল্প সংকলন 'মানুষের চন্দ্রবিজয় ও তারানাথ' প্রকাশিত হয়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'ভাগীরথের তালা'। তৃতীয় গল্প গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে। নাম 'নায়কের জন্ম'। দেশভাগের যন্ত্রণা, খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলনের চিত্রকল্প তাঁর গল্পে মানবিক চিত্রকল্পসহ উঠে এসেছে। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলো হল- 'পিপীলিকা উপখ্যান', 'অনুভব', হিজল খালের কান্না', 'জাগরণ', 'সোয়াদ', 'মানুষের চন্দ্রবিজয় ও তারকনাথ', 'গাছের সংসার', 'মিনার কাঁপছে' ইত্যাদি। প্রথম সংকলনে লেখক বলছেন- "গল্প মূলত প্রতীতির সমগ্রতা ও লেখকের ব্যক্তিমানসের তাৎপর্যময় শিল্প বলেই জীবনের চলস্রোতে একই প্রসঙ্গ নানাভাবে প্রতীকীগত হয়ে চলছে। শুধুমাত্র পরিবর্তনশীল সমাজজীবনের কথা ও বৃত্তান্তই শেষ কথা নয়, গল্প সাহিত্য লেখকের অন্তর্নিহিত কল্পনাশ্রিত মানসিকতারও শিল্প বিন্যাস। এই বিন্যাসকে কোনও সংজ্ঞা দিয়ে বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয় বলে গল্পের রসাস্বাদন পাঠকের রুচির ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু চারপাশের প্রকৃতি, মানুষ ও তার অন্তর বা বহিঃসংঘাত বহমান জীবনের খণ্ডচিত্র সমূহ গল্পের উপকরণ, তাই সমস্ত গল্পই সময়ও মানসিকতার ধারাবাহী।"
১৯৪৯ সালে লেখা তার বিখ্যাত গল্প এবং ত্রিপুরার আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের আলোকে খুবই বিখ্যাত অখ্যান 'জাগরণ' তার উপরোক্ত কথারই প্রতিফলন।
(৮)
ত্রিপুরা রাজ্যে জনশিক্ষা সমিতি গঠিত হয় ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে। জনশিক্ষা সমিতির উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে সমিতির ইস্তেহারে বলা হয়েছিল- "ত্রিপুরা জাতির নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য আজ আমরা সমগ্র ত্রিপুরা একতাবদ্ধ হইতেছি। আমাদের এই উদ্দেশ্যকে জয়যুক্ত করিবার জন্য আজ আমাদিগকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিতে হইবে। কত বাধা বিঘ্নকে অগ্রাহ্য করিয়া দৃঢ় সংকল্প লইয়া গন্তব্যস্থলে স্থির লক্ষ রাখিয়া আমাদিগকে চলিতে হইবে।'
এই জনশিক্ষা সমিতির ইস্তেহারের যে চেতনা এবং এই চেতনা সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে যে 'গণজাগরণ', এই গণজাগরণই গল্প বিমল চৌধুরীর 'জাগরণ'। নাগুরাই জনশিক্ষা আন্দোলনের ফসল। নগুরাই যখন শপথ নেয়- আমরা সব পাহাড়িয়া এক মৃত পিতার মুখের দিকে এক পলক তাকায় নগুরাই। ওর চিবুক শক্ত হয়ে ওঠে। আমরা সব পাহাড়িয়া এক। মুখ বুঝে আর তিলে তিলে ক্ষয় হওয়া নয়। আমাদের বাঁচতে হবে।"
তখন আমরা বুঝি কোন চেতনার সম্প্রসারিত বৃত্তে দাঁড়িয়ে কথা বলছে নগুরাই। লেখক গল্প শেষও করেন এই চেতনার আলোকে "মাচাংয়ের নিচে এখন মানুষের পায়ের শব্দ বেড়ার গায়ে ভেতরের আলোর কারুকার্য। মৃত পিতার প্রশান্ত মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নাগুরাই ঝাঁপ খুলে মাটিতে নামে। সম্মুখে রুপুতি দাঁড়িয়ে। নতুন সূর্যের আলোকচ্ছটায় রুপুতির মুখ ঝলমল করছে। নণ্ডরাই দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গিয়ে রুশুতির হাত তুলে নিল নিজের শক্ত মুঠিতে।" এখানে বিমল চৌধুরীর কথা ও কাজে কোন ফারাক নেই। শিল্পী সত্তার জয় হয়।
"বৃষ্টি, বৃষ্টি একটানা বৃষ্টি ঝড়ে পড়েছে। কখনও মুষলধারে, কখনও বা টিপটিপ। কালো আকাশ ঝাপসা পৃথিবী। এই বৃষ্টির মধ্যেই ঢাকা নারায়ণগঞ্জ একটা দশ-এর প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি, বাদলা দিনের জড়তা কাটিয়ে যেন অনিচ্ছা সত্তেও নড়েচড়ে উঠল। বৃষ্টির ঝিমঝিম শব্দের বুক চিরে চিরে শেষ হইশলটা একটা দীর্ঘ বিলম্বিত করুণ আর্তনাদের মতো নারায়ণগঞ্জ স্টেশনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল।"-বিমল চৌধুরীর দ্বিতীয় গল্প "অনুভাব' এর শুরু এরকম। 'অনুভাব' গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। গল্পের নায়ক মকবুল।
এ গল্পটি সাম্প্রদায়িকতা কত ঠুনকো বিষয়, তা প্রমাণ করে এক বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের আলোকে। এ গল্প পড়লে বার বার মনে হয়, ভারত বিভাজন ছিল এক নিষ্ঠুর ঐতিহাসিক খেলা। ১৯৪৬ সালের ১৬ থেকে ১৮ আগস্ট ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পিতর বিষবাষ্পের ইঞ্জিন। নতুবা ১৯৪৮ সালে ৩০ জানুয়ারী মহাত্মা গান্ধী আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতেন না। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট এর 'ডিরেক্ট অ্যাকশান ডে'-ই যদি শেষ সত্য হত, তাহলে তো ঐতিহাসিক ১৯৫২ সালের জন্ম হত না। সমস্ত মুসলমান সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় তত্ত্বের আলোকে নজিমুদ্দিনের ঘোষণাই মেনে নিতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি তৈরি হত না। মকবুল-মুইন্যাদের ছুরি নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটন না দ্বিতীয়বার।
বাংলাদেশের প্রকৃতি যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলে, এই বিষয়টির এ গল্পের বহু জায়গায় লেখক বিভিন্ন অনুপন্থ চিত্রকল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
"মাঠময় বর্ষার জলে অসংখ্যা লাল সাদা শালুক কলমী কচুরীপানার ফুল ফুটে রয়েছে। মকবুলের দৃষ্টি ব্যথিত হয়ে উঠল। ছোটবেলায় এক বর্ষায় আম্মার সঙ্গে এরকম ফুলভরা বিলে নৌকায় যাচ্ছিল সে নৌকার ধারে ঝুকে বার বার সে শাপলা আর কুচরিপানার ফুল টেনে টেনে তুলছিল, আম্মা কিছুতেই ওকে নিবৃত্ত করতে পারছিল না।। অবশেষে আমরা মমতাময় অভয় হাত দুটো দিয়ে মকবুলকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল-পাছে সে পড়ে যায়।.... আজ এই চরম বিপদে আম্মা তুমি কই গো.... অবাধ্য অশ্রু মকবুলের চোখ বাঁধভাঙা বন্যার মতো
(৯)
নেমে আসে।"
বাংলাদেশের প্রকৃতি বলে দেয়- মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়। চেতনার পরিমাপ নেয় মানুষ।।
সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় দ্বেষ। সৃষ্টির মনের কথা আমাদেরই আন্তরিক তাতে আমাদের সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা খুঁজে আনা। এরকম ব্যথা আমরা অনুভব গল্পে খুঁজে পাই। খুঁজে পাই একথা: "ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম করে চেতনার/বলয়ের নিজ গুণ রয়ে গেছে বলে মনে হয়।"
নতুবা এরকম গল্প আমরা পেতুম না বিমল চৌধুরীর চিত্রকল্প:
"ঠিক সময় ভিড় টেলে সামনে এগিয়ে এল মইন্যা। মকবুলের ভিজে পায়জামাটা এক নজর দেখেই বাজগাই
গলায় হেঁকে উঠল সে...অ্যাঁ, তুমিই তো সেই' কথা শেষ না করেই সে দ্রুত জামার নিচে কোমর থেকে একটা ধারালো ছোরা বের করে আনল। প্রশান্তির প্রসন্নতায় মকবুল তখন মগ্ন। ছোরাটা ছুঁড়ে ফেলে ভারমুক্ত হয়ে মইন্যা ততক্ষণে দুহাতে মকবুলকে নিজের বুকে টেনে নিয়েছে।"
১৯৫৪ সালে লেখা এই গল্প সময়ের কোলাজ। চেতনার কোলাজ। আবহমানে মানবীয় কোষের বিন্যাশ সজ্জা। বিমল চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বিচ্ছিন্ন লেখালেখি হয়েছে।
তার গল্প নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা আমরা করিনি। একারণে তার সঠিক মূল্যায়ন আজও হল না। তাঁর গল্প মানবতার আলেদা ওজন ও প্রাণের আলেদা 'স্পন্দন জানতে পেরেছিল। তাঁর গল্পে একটি কবিতা থাকে। সমাজ ইতিহাস সময় সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব যে উপলব্ধি তাকে প্রায় সন্দর্ভর মতো মতো তিনি প্রকাশ করেছেন না চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রচলিত গল্প, অথচ নানা উক্তির ঘাত-প্রতিঘাতে, এক অনন্য ধারা তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন।
এই গল্পে লেখক যখন তুলে ধরেন এরকম চিত্রকল্প "কত ঘুম অইব কও দেহি। ছুটি লইয়া বাড়ি আইয়া কী বিপদেই না পড়লাম, সাতদিনের ছুটিতে আইলাম, দুইদিন যাইতে না যাইতে এই যে রায়ট লাগল, কয়দিন থাকব কে জানে?
তখন আমরা বুঝি সময়ের সংকট হিসাবে নায়ক চিহ্নিত করেছেন রায়টের মুখ এবং মুখোশকে। একারণেই "আর এক বলে উটল, আর কন্ ক্যান মশায়। দুইদিন পর পর এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না হালায়। ব্যবসা-বাণিজ্য হগল পটল উঠল, নিত্য ভিক্ষা তণু রক্ষা আমাগো, ডাক্তার বদলে দেহি না খাইয়া মরতে অইব গুষ্টি সুদ্ধা। মুসলমানগোও তো একই অবস্থা...ক্যান যে তবে লাগে বুঝি না।" মুখোশ দাঙ্গার আর্থ-সামাজিক চিত্রকল্প এভাবেই ফুটিয়ে তোলেন লেখক।
"না আর কোন আশা নেই। কিন্তু বড়ো অদ্ভুত এই ব্যক্তিম। বিছানাই স্পর্শেই যার চোখ জড়িয়ে আসে, পগাঢ় ঘুমে বিবশ হয়ে পড়ে দেহ মন, আজ কোথায় সেই ঘুম! বিছানার অস্তিত্ব কার গাছ্যোজ মনে হচ্ছে অসহ্য এক যন্ত্রণার মতো। মধ্যযুগের সবদেশেই অপরাধীদের জন্যে হরেক রকম শাস্তির ব্যবস্থা ছিল এবং মোটা মাসোহারায় কর্মচারী পোষা হত নূতন নূতন মৌলিক শাস্তি উদ্ভাবনের জন্য। সুবীর জোর করে চোখ বন্ধ করে গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করল, এমন কোনও ধারা ছিল কিনা: অপরাধীকে রাত্রিতে চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পষ বেশ করে পেট ভরে খাইয়া, উত্তমরূপে সজ্জিত করে দুগ্ধ ফেনিল শয্যায় শুধুমাত্র গড়াগড়ি করিবার অধিকার দেওয়া, কিন্তু নিডা নিষিদ্ধ।।"
(১০)
বিমল চৌধুরীর ১৯৬৩ সালে লেখা গল্প। গল্পের নাম উত্তরঙ্গ প্রেম, প্রেমহীনতা, অবসাদ এবং এসকল বিষয় থেকে অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে যে সর্বব্যাপী এক শূন্যতা তৈরি হয়, সেই কেন্দ্রবিন্দুর সন্ধান আমরা পাই 'উত্তরবঙ্গ' গল্পের নায়ক সুবীর এবং নায়িকা সুনন্দার অস্তিত্বের শেকড়ে। অস্তিত্বের ভিতরকার অন্তবিবোধ এ গল্পকে ক্লাসিক গল্পে পরিণত করেছে। কোনকিছুর অভাব এবং স্তন্যতা যে লোভ, বিদ্বেষ এবং আত্মপ্রতারণার জন্ম দেয় এবং আত্মপ্রতারণা যে বিচ্ছিন্নতাবাধের জন্ম দেয়, সেই বোধ খুঁজে পাওয়া যায় বিমল চৌধুরীর গল্পে। বিমল চৌধুরীর এই গল্পে কিছু শিথিলতা, ফাঁকফোকর ও উচ্ছ্বাস প্রবণতা থাকলেও পরচালাকি এবং অস্বচ্ছতা নেই। কাহিনীর বুনোট খুব ঘন বা সংহত। এ গল্পকে প্রথমে গল্পই মনে হয় না। কিন্তু ধীরে ধীরে পড়লে এবং শেষ পর্যন্ত পড়বার পর আবার গোড়া থেকে পড়লে তার নক্সা কাটার সূক্ষ্মতা ও বিন্যাস আমাদের চমৎকৃত করে। এক লাইনের ভিতর অনেক লাইন লুকিয়ে রাখতেন লেখক। গড়পড়তা স্ত্রী-পুরুষের গল্প হলেও এক অন্তদৃষ্টি দ্বারা লেখক গল্পটিকে অন্য পান্তরে নিয়ে দাড় করিয়েছেন। বিমল চৌধুরীর সব গল্পেরই মজা হল- আমাদের প্রত্যক্ষ আচার আচরণ এবং ব্যক্ত ভাবনাচিন্তার আড়ালে দেহমনের যেসব জটিল কার্যকলাপ প্রতিটি অনুমুহূর্তে চলতে থাকে তাদের নিবিড় অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও উদ্ঘাটন। মানুষের ভয়হীনতা, ঈর্ষা, নির্বেদের সঙ্গে মমতা, বিবেক, দায়িত্ববোধ এগুলোর খুব ভালোভাবে চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিমল চৌধুরী তুলে আনতে পারতেন।
তিনি মানুষকে এত বেশ ভালোবাসতেন যে, মানুষের শুভ চেতনগুলো তাঁর গল্পে বেশি করে ফুটে ওঠে। মাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন- "মানুষ জগতের অক্ষদণ্ডা প্রশ্ন হতে পারে তার খুঁত, তার দোষত্রুটি? আমরা সকলে মানুষকে ভালোবাসার জন্য উন্মুখ, ক্ষুধার্ত, আর খিদের মুখে রুটি ভালো সেঁকা না হলেও তার স্বাদ মিষ্টি।" একথা বিমল চৌধুরী গল্পের নায়ক-নায়িকাদের জীবন দর্শনের ক্ষেত্রেও সত্য। প্রিয় গদ্যকার তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর এক লেখায় লিখেছেন- "ত্রিপুরার গল্প বিশ্বে নতুন পথ খোঁজার প্রক্রিয়া অব্যাহত। নতুন প্রজন্মের পথিকরা সংহত হচ্ছেন ক্রমশ। নান্দনিক পরিসর উৎসারিত হয় যে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে, তাও বিবর্তিত হয়ে চলছে। "সবই ঠিক আছে কিন্তু অনেক সময়ই আমরা দেখি, মানুষ জগতের অক্ষদণ্ড একথা লেখকরা ভুলে যান, গল্পের আঙ্গিকের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে। "মাথা দপদপ করতে লাগল সুবীরের। সমস্ত বিরক্তি ও ক্ষোভ নিঃশেষে মিলিয়ে গিয়ে নিশ্চল এবং দুঃখবোধ ওকে সুবির করে দিল। ওর সমস্ত চেতনা যেন স্পষ্প হয়ে গেল। আচ্ছনের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সে। ক্ষীণ চাঁদের রেখাটির আর কোনও চিহ্ন নেই। এতক্ষণে কোন আকাশে তার অভ্যুদয় ঘটেছে, কোথায় আঁধারের মুখে আলোর হাসি ফুটিয়ে তুলেছে, জানে না সুবীর।
জানতেও চায় না। ওর চোখের সম্মুখে নিবিড় ঘন আঁধার। ধাপে ধাপে চাপ বেঁধে রয়েছে অরণ্যানীর মাথায়। সেই গহন অন্ধকার থেকে বেসে আসছে বনপোকার ঐক্যতান, সুধীরের কানে বেজে উঠেছে বাংলার এক গাঁ থেকে ভেসে আসা মায়ের করুণ আহ্বান... খোকা তোকে দেখবার জন্য কেন জানি বড়ো উতলা হয়েছে...একবারটি তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে হচ্চে, দ্যাক না কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে আসতে পারিস কিনা।"
দেশভাগ, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শেকড় বিচ্যুত হয়ে শহরে গিয়ে কাজের সন্ধান করা এবং শেষ পর্যন্ত ওখানে থেকে যাওয়া, মা-বাবাকে মনে না রাখা- এসব বিষয়বস্তুর উৎস থেকে ব্যক্তিসত্তার অন্তরে যে অন্তর্গত সংকট তৈরি হয় তা ফুটিয়ে তুলেছেন বিমল চৌধুরী সুবীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে 'উত্তরঙ্গ' গল্পে। শেকড় থেকে বিচ্যুতি মানুষের মনে কী রকম সংকট তৈরি করে- তা লেখক অনুভ করেছেন, সত্ত্বা দিয়ে।
(১১)
গল্পের নায়ক গল্পটির টেক্সট তৈরি করেছেন একটি আপন জগৎ গড়ে নিয়ে- কিন্তু প্রায়ই তিনি আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াচ্ছেন। এই গল্পে লেখকের কাঙ্খিত মানসভ্রমণ আমাদের মৃদ্ধ করে। দিবাকরের আত্মিক সংকট, বোধের দংশন, মানসিক নিঃসঙ্গতা, আত্মঘাতী ক্লান্তি এসবগুণে বিষয় ইতিহাস যানেই চলে বেড়াচ্ছে 'বনস্পতির মৃত্যু' গল্পে। বনস্পতির মৃত্যুর আর দিবাকরের বোধ প্রায় সমার্থক হয়ে জেগে ওঠে এ গল্পে। গল্পটির একটা ভিন্ন স্বর আছে। স্বর ও স্ববান্তরের দ্বিরালাপর আলোকে অপরতার আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের ভিত্তিভূমি খুঁজে পাওয়া যায়। গল্পের বয়ানে, বোধের অন্তর্বয়ন কতখানি সুক্ষ্ম ও ব্যাপক হতে পারে বনস্পতির মৃত্যু সে কথা বলে। বাক্যের মধ্যে শব্দের নিগূঢ় ও নিবিড় উপস্থিতি গল্পটিকে সম্প্রসারিত করেনি। কিন্তু সম্প্রসারিত না হলেও এ গল্পের বাচনের একটা গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্য আছে। গল্পকার জানতেন, সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্যক্তির সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বাচনকেই পাল্টে দেয়।
"...বাঃ গাছটা দেখছি পড়ে গেছে... মাঠ চাষীদের এই হালকা মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হলেন দিবাকরবাবু। আকাশের
দিকে চোখ তুললেন। মেঘের ভরে কেটে গিয়েছে। সকালের নরম রোদ শেষবারের মতো অপার ক্ষমতায়
গাছটির সর্ব অঙ্গে লুটিয়ে পড়েছে। ভূ-লুষ্ঠিত বটগাছটির প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় মাথা নত করে দিবাকরবাবু ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে লাগলেন",
বিমল চৌধুরীর গল্পের পাঠের পদ্ধতি, কাঠামো অনুসন্ধান করার জন্য ১৯৬৫ সালে লেখা গল্প 'আলোর পরে' খুব গুরুত্বপূর্ণ'।
"চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালে। এদিক সেদিক তাকিয়ে তোমার কাঁধ দুটোয় ঝাকুনি দিয়ে কিছুটা
বিস্ময়, কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করলে, ছোটবেলাকার সেই খেলাটার কথা এই মুহূর্তে তোমার মনে পড়ল। ঐ খেলা তোমার প্রিয় ছিল। বটতলার মাঠে মাঝে মাঝেই তোমরা ঐ খেলায় মেতে উঠতে। খেলার নিয়মকানুন, উপকরণ বাহুল্য বিশেষ কিছুই ছিল না, যতজন খুশি মাঠে নেমে গেলেই হল। প্রত্যেকর একটা রুমাল বা ঐ জাতীয় একটা কিছু হলেই চলত। খেলার মধ্যমণি ছিল বটগাছটি। আঁটসাঁট করে, ফাঁকফোকর না রেখে রুমাল বা একখণ্ড কাপড়ের টুকরো দিয়ে খেলোয়াড়দের চোখ বেঁধে গাছটি থেকে বেশ কিছু দূরে এঁকেবেঁকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। কে কত আগে বটগাছ ছুঁতে পারে। এই কানামাছি খেলার দর্শক ও খেলোয়াড় দুতরফই মজায় মেতে উঠত। অনেক চেষ্টায় কেউ কেউ গাছ ছুঁতে পারত, অনেকে আবার বেঘোরে ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে রণে ভঙ্গ দিত।
কোনদিন তুমি অন্ধের মতো হোথা ঘুরেই সারা হতে, কোনদিন আবার গাছটি ছুঁয়ে চরম প্রাপ্তির উল্লাসে চিৎকার করে উঠতে। কিন্তু অবশেষে তোমার কাছে খেলাটা অত্যন্ত সহজ হয়েগিয়েছিল। তোমার পা দুটো অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দুরত্ব, কোণ, মাটির প্রকৃতি, গন্ধ সর্বোপরি একটা অব্যক্ত অনুভূতি অতি সহজেই তোমাকে বটগাছটির কাছে নিয়ে যেত। সকলকে বিস্মথ করে তুমি অতি অল্প সময়ে লক্ষে পৌঁছে যেতে। এমনকি তোমার এই সহজ বিজয়ে সহ খেলোয়াড়েরা তোমার ঈর্ষা করত। তোমার চোখ বেঁধে নানা জটিল পথে, গাছটি থেকে দুরূহ কোণে তোমাকে নিয়ে যেত কিন্তু অল্প সময়েই তুমি জয়ী হয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত এই খেলার আকর্ষণ তোমার কাছে কমে গিয়েছিল। তুমি স্পষ্টত বিরক্ত হয়ে এই খেলা ছেড়ে দিয়েছিলেন।" আস্তিত্বের খেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই গল্পের বুনন রসায়ন আমাদের প্রাণ সঞ্চার করে। ত্রিপুরার কথা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ বিমল চৌধুরীর কথাসাহিত্য নিয়ে অনুপগ্ধ বিশ্লেষণ এবং নির্মাণ-বিনির্মাণ খুবই জরুরি।
(১২)
দেশভাগ এবং বিমল চৌধুরী ছোটোগল্প:
১৯৫২ সাল আমাদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহললাল নেহেরু ত্রিপুরায় এসেছিলেন। জিরানিয়ার এক সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। নেহেরু বলেছিলেন, আমি উদ্বাস্তুদের কলোনী ও গ্রাম পরিদর্শন করেছি। আমার মনে হয়েছে এ রাজ্যে যন্ত্রণার ভেতর ও মানবিকার ঐক্য অটুট রাখার সুগন্ধী ফুল ফুটে আছে। নেহেরু ত্রিপুরাকে একটি ব্যতিক্রমী রাজ্যশাসিত রাজ্য হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। ত্রিপুরা থেকে হাতি উপহার হিসাবে নিয়ে গিয়েছিল সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসাবে হাতিটি চিন দেশকে উপহার পাঠিয়েছিলেন। ত্রিপুরাকে তিনি শান্তির প্রতীক হিসাবে ভেবেছিলেন। এই রাজ্যের রাজারা, দেশভাগ, দাঙ্গা ও হিন্দু-মুসলমানের মানবিক সম্পর্কে সার্বিকভাবে বুঝতে পেরে বিপন্নকালে বিপন্ন মানুষদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। নোটিফিকেশন করে উদ্বাস্তুদের জমি দিয়েছিলেন। ভারত সরকারের সরকারি সাহায্যের উপর প্রথমদিকে ত্রিপুরায় রাজন্ত্র নির্ভর করেনি উদ্বাস্ত পুনর্বাসনের খরচ মেটাবার জন্য। ওই সময় 'সমীক্ষা' পত্রিকায় নেহেরু ভাষণ প্রকাশিত হয়েছিল। সমীক্ষা পত্রিকার প্রতিবেদক লিখেছিলেন, উদ্বাস্তুদের স্মৃতি ও স্তব্ধতার ভাষণকে ছুঁয়ে দেখলেন এ যুগের অনন্য সাধারণ রাষ্ট্রনেতা। নেহেরু সেদিন উদ্বাস্তুদের মাথায় সকল সক্ষম দেশপ্রেমী মানুষদের ছাতা ধরার আহ্বান রেখেছিলেন।
এই ছাতা ধরার কাহিনীই বর্ণিত হয়েছিল বিমল চৌধুরীর 'বেড়ার' ভেতর থেকে' গল্পে। কী করে বেড়ার ভেতর দিয়ে এক প্রতিবেশী মহিলা তার পরিবারকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পুটলি বেঁধে খাবার সরবরাহ করেছিল উপোষি শিশুদের জন্য সেই বর্ণনার চিত্রকল্পই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল নেহেরুর মুখে। সংকটের সময়ও কীভাবে মানবিকতার ফুল ফুটে থাকে, তার দৃশ্যকাব্য দেশভাগের পরবর্তী সময় তুলে এনেছিলেন বিধুভূষণ দেব। তিনি তার 'কয়লার মেয়ে' গল্পে দেশভাগ পরবর্তী লংতরাইভ্যালীর শেষপ্রান্তের এক স্টেশনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভেতর মানবিকার ফুল ফুটে থাকার চিত্রকল্প তুলে এনেছিলেন।
ত্রিপুরার ছোটগল্পের প্রাণপুরুষ বিমল চৌধুরী 'একটি কাহিনী' গল্পের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথর শুনিয়েছিলেন। ঐ ঐক্যের রসায়ন দেশভাগের পিলারকে ভেঙ্গে দিয়ে মানবিকতার পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। দেশভাগ পরবর্তী মানবিক উৎসমুখ ও তার সঙ্কটকে চিহ্নিত করার জন্য বিমল চৌধুরী লিখেছিলেন, 'চিঠি', 'লালবাগ', 'ভিনি-ভিডি-ভিসি', 'মনোবিহ্বল', চর আর আমি, 'মিত্যা আশ্বাস', রক্তবমি এবং 'তোরে নাহি করি ভয়'। চিঠি গল্পে নায়িকা দেশ ত্যাগের দুঃখ যেভাবে পোষ্টকার্ড লিখেছিলেন, তার ছিন্ন হৃদয়ের টুকরো ব্যাথা বিরুদ্ধ স্বদেশের ইতিবৃত্ত। 'চর আর আমি' গল্পে দেশভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পাবার বিষয়ে
অব্যক্ত বিষাদের চিত্রকল্প আছে। 'রক্তবমি' গল্পে আছে স্বদেশ হারিয়ে বিপন্ন অস্তত্বির কথা। বিমল চৌধুরী ১৯৫২ সালে দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, জাতি দাঙ্গা এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে, মানব প্রেমকে কেন্দ্রীয় ভাবনায় রেখে উদ্ভূত রসায়নের অখ্যান তুলে এনেছিলেন।
পারিজাত, জীবনবীমা, তীর ও তরঙ্গ ইত্যাদি গল্পে। ১৯৫৪ সালে 'মানুষ' পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় বিমল চৌধুরী লিখেছিলেন, 'অনুভাব' ছোটোগল্পটি। 'অনুভাব' গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অধ্যাপিকা সঞ্চারী চৌধুরী লিখেছেন, "স্বাধীনতা যে সমস্ত অনিবার্য অভিশাপ সঙ্গে করে এনেছিল, দেশভাগ করেও সেসবের মূলোচ্ছেদ করা যায়নি। "তাদের অন্যতম হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। গল্পের নায়ক মুকবুল দুবছর পর পশ্চিম থেকে
(১৩)
বিমল চৌধুরীর ১৯৬৩ সালে লেখা গল্প। গল্পের নাম উত্তরঙ্গ প্রেম, প্রেমহীনতা, অবসাদ এবং এসকল বিষয় থেকে অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে যে সর্বব্যাপী এক শূন্যতা তৈরি হয়, সেই কেন্দ্রবিন্দুর সন্ধান আমরা পাই 'উত্তরবঙ্গ' গল্পের নায়ক সুবীর এবং নায়িকা সুনন্দার অস্তিত্বের শেকড়ে। অস্তিত্বের ভিতরকার অন্তবিবোধ এ গল্পকে ক্লাসিক গল্পে পরিণত করেছে। কোনকিছুর অভাব এবং স্তন্যতা যে লোভ, বিদ্বেষ এবং আত্মপ্রতারণার জন্ম দেয় এবং আত্মপ্রতারণা যে বিচ্ছিন্নতাবাধের জন্ম দেয়, সেই বোধ খুঁজে পাওয়া যায় বিমল চৌধুরীর গল্পে। বিমল চৌধুরীর এই গল্পে কিছু শিথিলতা, ফাঁকফোকর ও উচ্ছ্বাস প্রবণতা থাকলেও পরচালাকি এবং অস্বচ্ছতা নেই। কাহিনীর বুনোট খুব ঘন বা সংহত। এ গল্পকে প্রথমে গল্পই মনে হয় না। কিন্তু ধীরে ধীরে পড়লে এবং শেষ পর্যন্ত পড়বার পর আবার গোড়া থেকে পড়লে তার নক্সা কাটার সূক্ষ্মতা ও বিন্যাস আমাদের চমৎকৃত করে। এক লাইনের ভিতর অনেক লাইন লুকিয়ে রাখতেন লেখক। গড়পড়তা স্ত্রী-পুরুষের গল্প হলেও এক অন্তদৃষ্টি দ্বারা লেখক গল্পটিকে অন্য পান্তরে নিয়ে দাড় করিয়েছেন। বিমল চৌধুরীর সব গল্পেরই মজা হল- আমাদের প্রত্যক্ষ আচার আচরণ এবং ব্যক্ত ভাবনাচিন্তার আড়ালে দেহমনের যেসব জটিল কার্যকলাপ প্রতিটি অনুমুহূর্তে চলতে থাকে তাদের নিবিড় অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও উদ্ঘাটন। মানুষের ভয়হীনতা, ঈর্ষা, নির্বেদের সঙ্গে মমতা, বিবেক, দায়িত্ববোধ এগুলোর খুব ভালোভাবে চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিমল চৌধুরী তুলে আনতে পারতেন।
তিনি মানুষকে এত বেশ ভালোবাসতেন যে, মানুষের শুভ চেতনগুলো তাঁর গল্পে বেশি করে ফুটে ওঠে। মাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন- "মানুষ জগতের অক্ষদণ্ডা প্রশ্ন হতে পারে তার খুঁত, তার দোষত্রুটি? আমরা সকলে মানুষকে ভালোবাসার জন্য উন্মুখ, ক্ষুধার্ত, আর খিদের মুখে রুটি ভালো সেঁকা না হলেও তার স্বাদ মিষ্টি।" একথা বিমল চৌধুরী গল্পের নায়ক-নায়িকাদের জীবন দর্শনের ক্ষেত্রেও সত্য। প্রিয় গদ্যকার তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর এক লেখায় লিখেছেন- "ত্রিপুরার গল্প বিশ্বে নতুন পথ খোঁজার প্রক্রিয়া অব্যাহত। নতুন প্রজন্মের পথিকরা সংহত হচ্ছেন ক্রমশ। নান্দনিক পরিসর উৎসারিত হয় যে আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে, তাও বিবর্তিত হয়ে চলছে। "সবই ঠিক আছে কিন্তু অনেক সময়ই আমরা দেখি, মানুষ জগতের অক্ষদণ্ড একথা লেখকরা ভুলে যান, গল্পের আঙ্গিকের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে। "মাথা দপদপ করতে লাগল সুবীরের। সমস্ত বিরক্তি ও ক্ষোভ নিঃশেষে মিলিয়ে গিয়ে নিশ্চল এবং দুঃখবোধ ওকে সুবির করে দিল। ওর সমস্ত চেতনা যেন স্পষ্প হয়ে গেল। আচ্ছনের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সে। ক্ষীণ চাঁদের রেখাটির আর কোনও চিহ্ন নেই। এতক্ষণে কোন আকাশে তার অভ্যুদয় ঘটেছে, কোথায় আঁধারের মুখে আলোর হাসি ফুটিয়ে তুলেছে, জানে না সুবীর।
জানতেও চায় না। ওর চোখের সম্মুখে নিবিড় ঘন আঁধার। ধাপে ধাপে চাপ বেঁধে রয়েছে অরণ্যানীর মাথায়। সেই গহন অন্ধকার থেকে বেসে আসছে বনপোকার ঐক্যতান, সুধীরের কানে বেজে উঠেছে বাংলার এক গাঁ থেকে ভেসে আসা মায়ের করুণ আহ্বান... খোকা তোকে দেখবার জন্য কেন জানি বড়ো উতলা হয়েছে...একবারটি তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে হচ্চে, দ্যাক না কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়ে আসতে পারিস কিনা।"
দেশভাগ, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে শেকড় বিচ্যুত হয়ে শহরে গিয়ে কাজের সন্ধান করা এবং শেষ পর্যন্ত ওখানে থেকে যাওয়া, মা-বাবাকে মনে না রাখা- এসব বিষয়বস্তুর উৎস থেকে ব্যক্তিসত্তার অন্তরে যে অন্তর্গত সংকট তৈরি হয় তা ফুটিয়ে তুলেছেন বিমল চৌধুরী সুবীর চরিত্রের মধ্য দিয়ে 'উত্তরঙ্গ' গল্পে। শেকড় থেকে বিচ্যুতি মানুষের মনে কী রকম সংকট তৈরি করে- তা লেখক অনুভ করেছেন, সত্ত্বা দিয়ে।
(১৪)
প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করছে উচ্চস্বরে। ভিটে মাটি ছেড়ে আসা ছোট ছেলেটি মেলার সব জাক-জমক জিনিস দূরে সরিয়ে রেখে ভীরু পায়ে এসে পঁড়ায় যাদুকরের পাশে। কম্পিত মুঠিতে পাসো এগিয়ে দেয় যাদুকর বাক্সওয়ালাকে। কিন্তু সে জানে না তা দেওয়া পয়সা এখন পাকিস্তানের পয়সা হয়ে গেছে। এখানে এ পয়সা চলবে না। বিমর্ষ ছেলেটি মিনতি জানায়, "আমারে তুমি খালি নিশ্চিন্তপুর দ্যাহ্যও, আর কিছু দ্যাহান লাগব না।" অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে যাদুকর আর প্রশ্ন করে এ নিশ্চিন্তপুর 'ক্যায়া চিজ হ্যা'?" আর সেই বর্ধিত মূখের অতল গহ্বরে ছোট ছেলেটির নিশ্চিন্তপুর -হিজল খালের পাড়ে দাওয়া ঘেরা দুটি পর্ণ কুটির কাজলি গাই, কশি বেড়াল, করমচা, কামরাঙ্গা সিন্ধুরে আমগাছ, সবকিছু নিমির্ষে তলিয়ে নিচিহ্ন হয়ে যায়। আলোর ফুল ঝড়ি ছড়ানো জমকালো ইন্দ্র উজ্জ্যান্ত রাজপ্রাসাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণে দুপড়ে কেঁদে উঠে ছেলেটি। এই কান্না দেশভাগের পর সমস্ত রাজ্যে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল। দেশভাগ কেন্দ্রিক আর একটি অন্য রূপ কল্পের গল্প বিমল চৌধুরী "এ আমার পা, এ তোমার পাপ"। ত্রিপুরার গণআন্দোলন এবং নবজাগরণের মুখপত্র হিসাবে কাজ করেছিল গণআন্দোলনের অন্যতম নেতা প্রভাত রায় প্রতিষ্ঠিত 'চিনিহা' পত্রিকা। চল্লিশের সাহিত্য আন্দোলনকে আন্দোলিত করেছিল এই চিনিহা পত্রিকা। সম্পাদক প্রভাত রায় এবং অমরেন্দ্র দেববর্মা এবং বংশীঠাকুর চিনিহা' পত্রিকাকে সাহিত্যের বিকাশের জন্য সুসজ্জিত করতেন। এই চিনিহা পত্রিকার চতুর্থ বর্ষের প্রথম সংখ্যায় ২৪ চৈত্র ১৩৫১ ত্রিপুরাব্দে অর্থাৎ ইং ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল- 'এ আমার পাপ এ তোমার পাপ' গল্পটি। ভূমি, শেকড় এবং দেশ হারানো সব হারা পরাজিত মানুষের ক্ষুদার বিরুদ্ধে, খাদ্যের দাবিতে করা মিছিলে শেষে গল্পের নায়কের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল আর ৫ জন ছিন্নমূল মানুষের মত নিজভূমি ছেড়ে অন্যত্র উদ্বাস্তবা উদ্বাসন কেন হয়েছিল? এ পাপ কার? তোমার? আমার? এই কেন্দ্রিয় প্রশ্ন তোলে গল্পের নায়ক থু থু ছিটিয়েছেন র্যাড ক্লিপের টানা সীমান্ত দাগে। আমরা জানি স্বাধীনতা- দেশভাগ পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে যে অস্বাভাবিক জনসমাগম হয়েছিল। তারজন্য কর্কটক্রান্টি রেখার পাহাড়ি রাজ্যটি তৈরি ছিল না। মানুষ এবং ভূমির অনুঘ্রপত সেদিন অবৈজ্ঞানিক সীমারেখার উপর দাঁড়িয়েছিল। কারণ ভূমি সংস্কারে কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না পতিত জমিকে উদ্ধারের কোন প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা। যাট ভাগ জমি ছিল এফসলী। জনজাতিরা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর ছিল- Shifting Cultivation বা জমু চাষের উপর। ফলতঃ ১৯৪৯ সালে খাদ্য আন্দোলন দেখল ত্রিপুরার গণআন্দোলনের ইতিহাস ভূমি।
এই ইতিহাসকে ভিত্তি করে বিমল চৌধুরীর গল্প- 'তোরে নাহি করি ভয়'। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল নরুল হুদা সম্পাদিত নবজাগরণ পত্রিকায় তৃতীয় বর্ষের ২৫-২৬ সংখ্যায়। ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯ সালে গল্পটি প্রকাশ পায়। গণআন্দোলনের বিষয়কে গল্পে রূপান্তরিত করার রাজতন্ত্রের শাসনতন্ত্র ক্ষেপে যায়। এমনিতেই চল্লিশের দশক ছিল রতনমণি রিয়াংয়ের নেতৃত্বে রিয়াং বিদ্রোহ সহ অন্যান্য প্রজাতান্ত্রিক পত্রিকায়র প্রকাশক, সম্পাদক এবং মালিককে শোকজ করে। শোকজের উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে জরিমানা করে শেষ পর্যন্ত রাজরোষে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। দেশভাগ বিষয়ক বিমল চৌধুরী আর একটি উল্লেখযোগ্য গল্প-"মধ্যিখানে চর" এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত 'পৌণমী' সাহিত্য পত্রের দ্বিতীয় বর্ষের পঞ্চম সংখ্যায় ১৯৭২ সালে। পরবর্তী সময়ে 'পৌণমী'র ২৫ বৎসর পূর্তি সংখ্যায়ও গল্পটি ছাপা হয়েছিল। দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব এবং একাত্তরের মুক্তি যুদ্ধের চিত্রকল্প নিয়ে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অনুভরের গল্প। বাস্তবিক চিত্রকল্প দ্বারা জারিত বোধ, উৎসাহিত ভাবনা গল্পের আলোকে লেখক লিখেছেন "মাঝে মধ্যে ওরা দুজন পরস্পরকে এক নজর দেখে নিচ্ছিল। প্রায় চারদিকেই
(১৫)
জল ডোব অথবা শুকনো খেত-মাঠ-প্রান্তর। দূরে দূরে গাছ বন্ধ কুটিরের ইসারা। সরানো ছিনানো গাঁ। ধুলো অথবা কাদামাখা মেঠো পথ। পথগুলো এঁকে বেঁকে নিরুদ্দেশ। এই খেত-মাঠ-প্রান্তরে জলে, স্থলে কোথায় যে বাংলাদেশ আর ত্রিপুরার সীমানা টানা রয়েছে কিছু বোঝার উপায় নেই। উপায় থাকার কথাও নয়, কারণ র্যাডক্লীপ চিহ্নিত সীমানা ছিল বন্ধ ঘরে বসে টানা ধর্ম এবং বিভেদের ভিত্তিতে তৈরি করা মানচিত্রের চিহ্নায়ণ। বিমল চৌধুরীর ছোটোগল্প দেশভাগ বিষয়কে কেন্দ্র করে এখানেই সার্থকতা রয়েছে।
(১৬)
বিমল চৌধুরী: আগরতলার আড্ডা কবি কল্যাণব্রত চক্রবর্তী তার লেখা "বিমল চৌধুরী: ত্রিপুরায় বাংলা গল্পের ছয় দশক"- এ লিখছেন-
"চল্লিশ দশকের আরম্ভ থেকে হিসাব করে ত্রিপুরায় বাংলা গল্পের চর্চা, লেখালেখি আজ প্রায় সত্তর বছরের। এর আগে ছিল এ রাজ্যের রাজবাড়ী কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার রেওয়াজ। কিশোর সাহিত্য 'সমাজ এর উদ্যোগে 'সাহিত্য-সাময়িকী', 'রবি', প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪-এ। রবীন্দ্রনাথ বার সাতেন রাজন্য আমলের রাজধানী আগতলায় এসেছিলেন। কবির সফর এবং এখানে স্বল্পকার বসবাস 'রবি' সাময়িকী প্রকাশনায় উৎসাহ যুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। 'রবি' পত্রিায় গল্প খুব কমই বেরিয়েছে প্রয়াত দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিতবন্ধু দেববর্মা, সতীশ দেববর্মা প্রমুখর লেখায় বাংলার প্রায় অস্পষ্ট এক রূপরেখা ফুটে উঠেছিল বলা যায়। এছাড়া হরিদাস চক্রবর্তী, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, আব্দুল মতিন, রাজ্যশ্বর মিত্র সহ আরো কয়েকজনের লেখার গল্প রচনার দেখা গিয়েছিল। বিধুভূষণ এবং আব্দুল মতিন মূলতঃ কবি ছিলেন। তাঁদের কবিতায় আধুনিক নির্মাণের সূচনা হয়েছিল, একথা অনায়াসেই বলা যেতে পারে।
১৯৪০ এর গোড়ার দিক থেকে প্রায় ষাট বছর ধরে ত্রিপুরায় বাংলা গল্প লেখার এক অনন্য উজ্জ্বল উপস্থিতি বিমল চৌধুরী। সে সমস্ত এখানে লেখালেখি প্রকাশের নানা সীমাবদ্ধতা, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, বিশ্বজুড়ে ফ্যাসীবাদী আক্রমণের আতঙ্ক, মন্বন্তর, দেশভাগ, ৪৬-৪৭ দাঙ্গা এবং গণহত্যা, আর সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলা থেকে অগণিত ছিন্নমূল শরণার্থীর এ রাজ্যে আছড়ে পড়ার স্রোত, সব মিলিয়ে গল্প-উপন্যাস-সাহিত্য রচনায় বিচিত্র অনুভব এবং গভীর এক মানবিক সংবেদনের প্রেরণা এসেছিল বলা যায়। সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। এতো ক্ষিপ্ত এই রূপান্তর যে, এই সময়ের নানা গ্রন্থির স্বভাবনিহিত জটিলতার সঠিক ও সমাজমনষ্ক প্রতিফলন মোটেই সহজ কাজ ছিল না।
বিমূল চৌধুরী ১৯৫৬-এ 'জাগরণ' নামে যে গল্প লেখেন, এর পরিণামে ত্রিপুরার এক সরল আদিবাসী 'নগুরাই' এর রাজতন্ত্রের বিরোধিতায় এ সময়ে রণন অনুভব করা গিয়েছিল। পরে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইন্ধন বলে গণ্য হয়, এ আশঙ্খায় আগরতলায় কোন সম্পাদক লেখাটি প্রকাশ রাজি হননি। বছর তিনেক বাদে প্রয়াত প্রভাত রায় তাঁর 'চিনিহা' সাপ্তাহিক গল্পটি প্রকাশ করেছিলেন।
পঞ্চাশের দশক আরো ক'জন বিশিষ্ট গল্পকারের দেখা মেলে। এঁদের ক'জন স্বকীয়তায় চিহ্নিত হয়েছিলেন। সুখময় ঘোষ, সুবিমল রায়, রণেন্দ্রনাথ দেবের গল্প রচনায় ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পরেশ ভাদুড়ী,
আনন্দময় রায়, চিদানন্দ গোস্বামী, বিভুল চৌধুরী, দেবল দেববর্মা প্রমুখ এ সময়ে গল্প রচনার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট নাম। পঞ্চাশ দশকের গল্পচর্চার দুটি ভিন্ন ধারার ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত, একদা আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যে দেশভাগ পরবর্তী ব্যাপক ব্যাঙলী উদ্বাস্তুর আগমন এবং দ্রুত গড়ে ওঠা উপনিবেশ যাতে এক বিশেষ মাত্রা জুড়ে দিয়েছিল, এক অংশের গল্প এই বিন্যাস স্বার্থকভাবে ফুটে ওঠে। অন্য ধারাটি হচ্ছে, মূলতঃ রোমান্টিক গল্পের ধারা যা মুখ্যত বাংলা গল্পের মূলস্রোতের অনুকরণেই বিকশিত। প্রথম ধারার গল্পে সমাজের অবহেলিত অংশের জীবন, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষের টিকে থাকার লড়াই, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের কথা
(১৭)
বিশেষভাবে উঠে এসেছে। রোমান্টিক গল্পধারায় মূল উপাদান ছোট জীবন, কখনো সখনো কলকাতা পটভূমির
১৯৫৩ ইংরেজিতে আগরতলায় সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট আড্ডা 'সাহিত্যবাসর' গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় লেখালেখিতে এই মিলল ও পরস্পরের বিনিময় দশকের শেষ পর্যন্ত প্রেরণা যুগিয়ে এসেছে। এই সময়ে স্থানীয় বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে যাঁরা লেখালেখি করেছেন, তড়িৎমোহন দাশগুপ্ত, সুনীলবন্ধু ঘোষ, তুষার সেন, অপরাজিতা রায়, কদাবী দেববর্মণ, অনিল মুখোপাধ্যায়, সুজাতা চৌধুরী, শুভাগত দাশগুপ্ত, সুপ্রসন্ন চক্রবর্তী, দুলাল ভট্টাচার্য, বিভূতি চক্রবর্তী, ননীগোপাল কর, যোগব্রত সেন, পূরবী দেববর্মণ এঁদের অন্যতম। পঞ্চাশ দশকের গল্পে নির্মাণের আঙ্গিক ও স্বরূপ বিষয়ে লেখকদের আগ্রহের অভাব চোখ পড়ে। গল্প ও ছোট গল্পের সীমানা অনেক সময়েই মিলেমিশে একাকার, যে গল্প বলা হয়ে গেলেই লেখকের দায় শেষ।
পরবর্তী যাট-সত্তরের দশক গল্প রচনার ক্ষেত্রে এক বড়ো মাপের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। একদিকে গভীর সমাজমনস্কতা, গল্প বলার নিজস্বতা, নানামুখি নিরীক্ষায় আগ্রহ, বাংলা গল্পের মূলস্রোতের সমান্তরাল ভিন্ন ধারায় এগিয়ে যাবার আগ্রহ এই সময়ের গল্প রচনায় লক্ষণীয় প্রবণতা হয়ে দেখা দেয়। এক তরুণতর লেখকগোষ্ঠী 'আসন্ন' গড়ে তোলেন। এই গোষ্ঠীর উদ্যোগে ১৯৬৩ ইংরেজীতে বেরোয় সমাজমনস্ক সাহিত্যপত্র "গান্ধার"। গান্ধার প্রকাশ স্থায়ী না হলেও স্থানীয় লেখালেখির এর বিশেষ অবদান ছিল। দাগ রেখে গিয়েছিল, যা পরবর্তী তরুণদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। এই সময়ের বিশিষ্ট গল্পকার হিসাবে দেখা দেয় অনিল সরকার, ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য, মানস দেববর্মণ, কালিপদ চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, অরুণোদয় সাহা, শক্তি দাস, বিচিত্র চৌধুরীরা। স্থানীয় সরকারী কলেজে পড়ানোর কাজ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও গল্পকার কার্তিক লাহিড়ী। তরুণ লেখকদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার কেন্দ্র। গল্প লেখায় হালফিলের রুচি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন মননের গ্রন্থণার কাজটি করে দিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত লাহিড়ী। 'গান্ধার' সাময়িকীতে তিনি নিয়মিত লিখতেন। ত্রিপুরার পটভূমিতে বড় মাপের সাহিত্য রচনার স্বপ্ন তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন তরুণতর লেখক প্রজন্মকে। আগরতলায় তিন দশকের বেশি লেখালেখি করেছেন কার্তিক। লাহিড়ী। কলকাতার 'পরিচয়' এবং 'এক্ষণ' ছাড়াও বহু সাহিত্য সাময়িকীতে ছড়ানো তাঁর গল্প এবং উপন্যাস। বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং গল্প সংগ্রহ তাঁর বেরিয়েছে কলকাত এবং আগরতলার প্রকাশনী থেকে। সামাজিক রূপান্তরের লক্ষ্যে গভীরভাবে দায়বদ্ধ এই লেখক প্রতিবাদী বলিষ্ঠ চরিত্র নির্মাণে সাহস ও সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁর লেখায়। গল্প বলার টেকনিক নিয়ে নানা মাথায় বিচিত্র পরীক্ষা তাঁর লেখায়। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ সম্পর্কের টানাপোড়ন সঙ্কট এবং মানবিক উত্তরণের কথা তাঁর গল্পে।
যে কথা বলা হয়েছে, ত্রিপুরায় বাংলা গল্প লেখালেখির সূচনা বিগত চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকে। সাহিত্য তখনও এক ধরনের মধ্যবিত্ত সৌখিনতার ব্যাপার ছিল। সাহিত্য বলতেই রবীন্দ্রনাথ। সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে, তারাশঙ্কর কিছু কিছু পড়া হত এখানে সেখানে, এই মাত্র। জীবনানন্দের মৃত্যুর বেদনা তেমনভাবে ছুঁতে পারেনি এখানকার কবিদের, লেখকদের। দেশভাগ এবং এরপর ছিন্নমূল শরণার্থী নর-নারী দলে দলে ত্রিপুরায় প্রবেশের বিষয়টি গল্প সাহিত্যের মরমী উপাদান হলেও এখানকার লেখালেখিতে তখনও এর তেমনভাবে প্রভাব পড়েনি। আগরতলা শহরের আশেপাশে বিপুল সংখ্যায় উদ্বাস্ত শিবির গড়ে উঠেছিল। বহু পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছিল দেশ ছেড়ে আসা টানাপোড়েনে। শিবির বাসের অপরিমেয় যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা।
(১৮)
অকল্পনীয় দারিদ্র। শিবির জীবনে "ক্যাশ ভোল" মহাজনের ঋণ, পতন, বিষেষ, শত্রুতা যেমন ছিল, কিছু নতুন আশা, নতুন সম্পর্ক, নৈতিক-অনৈতিক প্রেম, বিবাহ, সবর্ণ, অসবর্ণ সবই তো ছিল, যা নিয়ে মানুষের জীবন। ত্রিপুরার লেখালেখিতে দেশভাগের এই বিপুল বেদনা আজো তেমন গভীর, গূঢ় ও সঞ্চারিত মাত্রায় উঠে আসেনি। এটা এ কারণে আক্ষেপের বিষয় যেহেতু পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় চলে গিয়েছে।
চল্লিশ দশকের গোড়ার দিক থেকে এ পর্যন্ত গল্প লেখায় তিনটি পর্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক, যাটের দশক এবং সত্তরের দশক থেকে এখন অবিধ। লেখালেখির প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে যাটের দশকে ত্রিপুরায় বাংলা গল্পচর্চায় এক ধরনের নতুন মাত্রা যোগ হয়। এর আগে এখানকার গল্পে রিফিউজির। জীবন যন্ত্রণা সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর নানামাত্রার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেলেও সামগ্রিকভাবে এ রাজ্যের জল-মাটি-মানুষের অবিকল সুখ-দুঃখের কথা এমনভাবে উঠে আসেনি, যা যাটের দশকের এর পরবর্তী সময়ের লেখায় সচেতন অনুশীলনের বিষয় হয়ে উঠেছিল। ত্রিপুরায় লেখা বাংলা গল্প বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের মূলস্রোতের অনুসারী হয়েও আজ যে স্বতন্ত্র ধারা ও উৎকর্ষের দাবিদার, সত্তর দশক এবং এর পরবর্তী সময়ের গদ্য শিল্পীদের সচেতন ও সমাজমনস্ক অনুশীলতেই তা সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যেই সার্থকতা এসেছে, এ কথা বলা না গেলেও, গল্পের চর্চার ক্রমশ সঠিক পথ চিনে নিয়েছে বলা যায়।
বিমল চৌধুরীর লেখালেখির প্রকাশ, এই শহরে এমন একটা সময়ে যখন এর থেকে বৈষয়িক পাওয়ার কিছু
ছিল না। খ্যাতিও নয়, অর্থও নয়। লেখালেখির মূল্যায়ন, জনপ্রীতির জন্য যেটুকু সামাজিক পরিবেশ দরকার, তেমনবাবে তখনো এই শহরে গড়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র সাহিত্যনিষ্ঠায় একটি আত্মপ্রকাশের আকাঙ্খা এটাই ছিল প্রেরণা। চেষ্টা ছিল, লেখার ভেতর দ্রুত বদলে যাওয়া সমাজবোধকে নানা মাত্রায় তুলে আনা।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১০ শ্রাবণ (১৯২২ ইংরেজি) ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বিমল চৌধুরীর জন্ম। বাবা যামিনীভূষণের বংশানুক্রমিক আয়র্বেদ চিকিৎসা ও ঔষধ তৈরি, সরবরাহের প্রতিষ্ঠান ছিল টাকা মহাশক্তি ঔষধালয়'। দেশভাগের পর সে প্রতিষ্ঠান আগরতলায় ১৪ নম্বর সেন্ট্রাল রোডে চলে আসে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বিমলদাই বড়। ঢাকায় জুবিলি ইস্কুলে ছেলেবেলায় পড়াশুনা। পরে সেখানে গ্র্যাজুয়েট স্কুল থকে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করে কলকাতার আয়ুর্বেদ সারস্বত মহাবিদ্যালয়ে কবরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান। ১৯৪২ সাল। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ গোটা পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন আগরতলায়।
গোড়ার দিকে কবিতা লিখতেন। ১৩ বছর বয়সে তাঁর লেখা কবিতা ঢাকায় তখনকার সাপ্তাহিত 'সোনার
বাংলা'র বেরিয়েছিল। সেই প্রথম। পিতা যামিনীবৃষণ খুশী হয়েছিলেন। ছেলের উৎসাহিত করেছিলেন। 'সোনার বাংলায়' বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো খ্যাত কবিরা লিখছেন একসময়। বিমল চৌধুরীর আগরতলায় বসবাস ১৯৪০ ইংরেজি থেকে। চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ভাগে তাঁর লেখা নিয়মিত বেরিয়েছে আগরতলার 'চিনিহা', 'নবজাগরণ', 'সমীক্ষা', 'অভ্যুদয়', এবং পরবর্তী সময়ে 'ত্রিপুরা' এবং 'ত্রিপুরার কথা'য়। (যাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে এ রাজ্যে প্রায় সবক'টি নিয়মিত পত্রিকার সাহিত্যপত্রে এবং নানা লিটল ম্যাগাজিনে, সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর লেখা বেরিয়েছে। বেশির গল্প। মাঝেসাএেঝ কবিতা কোথাও। ষাটের দশকে আগরতলায় অন্তত চার পাঁচখানা সাপ্তাহিকের প্রতিবছর শাদীয় সংকলন বেরুত, যার প্রত্যেকটি রীতিমত উল্লেখযোগ্য মানের। সেসব সংকলনের নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত, সোমেন্দ্রনাথ বসু, ডঃ সচ্চিদানন্দ ধর, বিষ্ণু দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, গোপাল হালদার, নীরেন্দ্রনাথ
(১৯)
চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টদের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে দেখেছি সে সময়ে। এ সমস্ত সংকলনে বিমল চৌধুরীর গল্প ছিল এক অপরিহার্য উপস্থিতি। বিমল দা'র গল্প লেখা আরও দেখা যায় সাম্প্রতিক 'নবজাগরণ' এর পাতায় ১৯৪৬-এ। পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মাও নরুল ঋণ। সে সময়ে 'নবজাগরণ' সম্পাদনা করতেন। সত্তর-আশি-নব্বই এর দশকে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক নামী সাহিত্য-সামরিকীতে বিমল চৌধুরীর গল্প প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে।
১৯৫৭ ইংরেজীর সেপ্টেম্বরে, মনে আছে ঠিক পুজোর আগে এক ঘটনা সূত্রে বিমলদার সঙ্গে পরিচয়। আমার তখন স্কুল ফাইন্যাল হয়ে গেছে। উমাকান্ত একাডেমীর পশ্চিম আশে পুকুরপাহের সম্বা টিনের ঘরে এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের মধ্যে দেবদাস গঙ্গোপাধ্যায়, চিদানন্দ গোস্বামীর কথা মনে আছে। সাংস্কৃতিক সমাবেশে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহোদয় পৌরোহিত্য করেছিলেন। অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন পথিকা দেববর্মণ। কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় বিচারক বিমল চৌধুরী। আমার ভাগ্যে পুরস্কারের নিকে কী করে নেমেছিল মনে নেই, তবে কবিতাটি সভায় পড়তে বলায় আমার কেমন ঘাম দিয়েছিল সেটা মনে আছে। নার্ভাস হয়ে বুলভাল পড়ে ফেলেছিলাম। পরের দিন সকালে বটতলায় বাজারে গিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা। বাজার করে ফিরছিলেন। আমাকে বকেছিলেন স্যার। কথায় স্নেহের টান ছিল। বলেছিলেন, এ সময় কবিতার নিজস্ব পাঠরীতি আছে। এটা জানার বিষয়। বিমলবাবুর কাছে যেও, ভালো আবৃত্তি করেন, তোমায় ঠিক বুঝিয়ে দেবেন। সেই থেকে 'ঢাকা মহাশক্তি'তে কত অশ্রক্রবার গেছি, ১৯৫৭ থেকে প্রায় ২০০০ অবধি, প্রথম রোজ। কোন কোনদিন সকালে বিকালে। সম্প্রতি ঢাকা মহাশক্তি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বিমলদা'র বার্ধক্য, অসুস্থতা কারণে। সেখানে আয়ুর্বেদের তুলনায় আড্ডার এক্রিয়ার অনেক বেশি। ঘন ঘন ডবল হাফ চা। সেন্ট্রাল রোডে ওপাশে শীতলের দোকানের ময়লা পেয়ালায় যে চা আসতো তাতেও যেন চ্যবনপ্রশের গন্ধ ছিল, দীর্ঘদিনের অভ্যাসে আমাদের সবারই ভালো লেগে গিয়েছিল। বিমলদার খুব আড্ডা, স্বজন-বন্ধু প্রিয় মানুষ ছিলেন। কবিরাজ বললেন অখুশী হতেন, আর কথা-সাহিত্যিক বিমল চৌধুরী বললে শিশুর মতো প্রসন্ন হতেন। আড্ডার মূল বিষয় লেখালেখি, সাহিত্য, সাম্প্রতিক কবিতা, পাঠ-আবৃত্তি-কদাচিৎ গান, গুনগুনিয়ে মহাশক্তির আড্ডায় কাকে দেখিনি, সেটাই হয়ত বলা মুস্কিল। বিমলদা' নিজেও ভরাট গলায় কবিতা বলতেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ডঃ নীলমাধব সেন, সোমেন বসু, কবি পুণেন্দু বিকাশ ভট্টাচার্য, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, এম. এ. মতিন, ডঃ হিমাংশুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রণেন্দ্রনাথ দেব, সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ, নরুল হুদা, হরিদাস চক্রবর্তী, পরেশ ভাদুড়িসহ আরো অনেককে মহাশক্তির আড্ডায় দেখেছি। ষাটের দশকের গোড়ায় তরুশদেরই ভীড় ছিল বেশি। শব্শ্বপল্লব আদিত্য, প্রদীপ চৌধুরী, ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য, কালিপদ চক্রবর্তী, খগেশ ও মানস দেববর্মণ, কখনো অশোক দাশগুপ্ত, নকুল রায়, মিহির দেব, তপন দাশগুপ্ত, কার্তিক লাহিড়ী, বিজয়কৃষ্ণ চৌধুরী, বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্য। আবার একটু ভিন্ন মাত্রায় ধবলকৃষ্ণ দেববর্মণ, প্রাঞ্জলকৃষ্ণ, শক্তি হালদার, অনাথকৃষ্ণ দেববর্মণ, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রিপুরেশ মজুমদার, অনিল চন্দ্র ভট্টাচার্যসহ অনেকেই শীতলের কবিরেজি গন্ধমাখা ডবল হাফ খেয়েছেন নিয়মিত। আড্ডা জমে গেলে রোগী এলেই বিষণ্ণ হতেন বিমল চৌধুরী। বলতেন, আজ শুধু অবলেহ নিয়ে যান। রবিবার দুপুর নাগাদ এলে রোগের বাকি সব বিবরণ শুনবো। এই করে করে মহাশক্তি ঔষধালয়ে রোগী দেখার ব্যাপারটা শিকেয় উঠে গিয়েছিল। দূরের গ্রাম থেকে রোগীরা আসতেন। অনেকে গরীব মানুষ। রোগী ফিরে দিলে খারাপ লাগত। নিজেদের নিমিত্ত ভবে খুব অস্বস্তি লাগতো। আড্ডার নীট ফলের মধ্যে।
(২০)
এইটুকুই, বহু সাহিত্য সাময়িকীর জন্ম। কথিসভা, পাঠ, আবৃত্তির অনুষ্ঠান চূড়ান্ত হয়েছে, অথবা বাতিল হয়েছে মহাশক্তিতে বসে শলাপরাপর্শ করে।। নতুন লেখা হ'লে বিমলদা যেমন আমাদের পড়ে শোনাতেন, বললে কিছু কিছু অদলবদলও করতেন লেখায়, নতুন কবিতা লেখা হ'লে বিমল চৌধুরীকে না শোনানো পর্যন্ত মনে গ্রত কিছুই তো হল না। এভাবে ত্রিপুরায় লেখালেখি নিয়ে যখনই যা কিছু হয়েছে, আন্দোলন-আলোচনা-সমাবেশ, যাই কিছু বিমলদা' সবকিছুতেই নিজেকে জড়িয়ে দিতেন। যাটের দশকে অনিল সরকার, নিধুভূষণ হাজরার যৌথ সম্পাদনায় 'উত্তরণ' সাহিত্যপত্র প্রগতিশীল ও সমাজমনস্ক লেখালেখির ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার দিশারী হয়ে উঠে। 'উত্তরণ'র এর সময়বাঞ্জিত ভূমিকা বিষয়ে মোটামুটি এক দীর্ঘ আলোচনা আমাদের সাময়িকীতে ছাপতে দিয়েছিলেন বিমলদা'।
রোমান্টিক, ভাবুক গোছের মানুষ। জীবনের শেষ অবধি এই রোমান্টিকতায় টান ধরেনি। যেসব বাস্তব অভিজ্ঞতা, ধারণা, পদ্ধতি জানা থাকলে মানুষ 'সংসার সুখী' হয়, বিমলদা সে সম্পর্কে কোন কালেও আগ্রহ দেখাননি। রোদে মেঘে বেলা বয়ে গিয়েছে। সংসারে বাস্তব জ্ঞানের অভাবে নানাভাবে দুঃখ পেয়েছেন। আসলে চারিদিকের সমাজ পরিপার্শ্ব কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে তা সঠিক পরিমাপ করে চলতে চাননি বলে যন্ত্রণা আরো বড়েছে। জীবনের শেষ দিনগুলিতে প্রিয়জন বিয়োগের শোকও পেয়েছেন। শেষ বয়সে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে আজ হয়েছিলেন এক বছরের বেশি। বলতেন আমি আর যদি দেখতেই না পাই, পড়তে লিখতে না পারি তবে আর কী হবে বেঁচে থেকে। চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে কলকাতা, গৌহাটিতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাও হয়েছিল। কিন্তু তেমন কাজ হয়নি কিছুতেই। ত্রিপুরার জীবন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছে ছিল। খানিকটা কাজ আরম্ভও করেছিলেন। কিন্তু চোখের আলো চলে যাওয়ায় ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত।
তাঁর নিজের কথায়, এ অবধি কম তো আর দেখিনি, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশভাগ, আকালও দেখেছি, মানুষের ছিন্নমূল জীবনযন্ত্রণা অনুভব করতে চেয়েছি গভীরভাবে। যা দেখেছি এর ছিটে ফোঁটাও লিখে উঠতে পারিনি। ত্রিপুরার মানুষ আমায় অনেক ভালোবাসা, স্নেহ দিয়েছেন। সাধ ছিল হাত পা ছড়িয়ে লিখবো ত্রিপুরার কথা। চোখের দৃষ্টি হারিয়ে আমার সবশেষ। মানুষের কাছে এই ঋণের বোঝা, আমাকে বড় অস্থির করে তোলে মাঝে মাঝে।
গল্প কাহিনীতে বস্তুনিষ্ঠা পরিবেশ নির্মণে এই লেখকের এক অসামান্য ক্ষমতা ছিল, যা উপন্যাস রচনায় সাধারণতঃ খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ত্রিপুরার সামাজিক রূপান্তরের ধারাবাহিকতা, মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, দিন যাপনের লড়াই, মানুষের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা, সময় ও সমাজ প্রেক্ষিত অসামান্য বিশিষ্টতায় উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। তাঁর লেখায় ত্রিপুরার মাটি মানুষ নিসর্গ চেতনায় জারিত হয়ে অন্যমাত্রা পেয়েছে। এ রাজ্যের রঞ্জিত উপজাতি জীবন জীবন নিয়ে তিনি স্বার্থক সাহিত্য রচনা করছেন। অন্যদিকে দেশভাগ এবং ছিন্নমূল উদ্বাস্ত জীবনের বেদনা গভীর সংবেদনে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনায়।
বিমল চৌধুরী প্রথম গল্প সংগ্রহ 'মানুষের চন্দ্র বিজয় ও তারানাথ' পৌণমী প্রকাশন বের করেন ১৯৭৩-এ। দ্বিতীয় গল্প সংকলপ 'ভাগীরথের তালা' ১৯৯৭-এ প্রকাশিত হয়। কবি কৃত্তিবাস চক্রবর্তী ও কাকলি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে। বিমল চৌধুরী লেখা 'তির ও তরঙ্গ', 'জাগরণ', হিজল খালের কান্না', 'অনুভাব', মানুষের চন্দ্র
(২১)
বিজয় ও তারকনাথ' মানুষের প্রতি গভীর অঙ্গীকারে অসামান্য। তাঁর গল্পে নানা বৈচিত্র বিষয় এবং পটভূমি। গল্পের মেজাজ মতো নিজস্ব ভাষা নির্মাণেও তাঁর কৃতিত্ব। আধুনিক বাংলা গল্পের যা বিশেষ লক্ষণ। গল্প বলার পদ্ধতি থেকে ভাষাকে আলেদা করে নিয়ে বিচার করা যায় না। উভয় ধারাই এক গভীর অন্বয়ে পরম্পর সম্পৃক্ত। কিছু কিছু গল্পের তিনি স্বার্থক প্রতীক এবং চমৎকার সঙ্কেত- ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাঁর গল্পের সংযম এবং কিরমিতির বোধ রচনাকে শিল্পকুশলন করেছে। ঋজু ও মননজাত তাঁর ছোট গল্প যা বড়োর ব্যঞ্জনা পেয়ে যায়। পরিমল চৌধুরী ত্রিপুরায় প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত লেখক। 'গুয়াহাটি কালচারেল ফোরাম পেয়ে যায়। ইংরেজীর ১৫ আগস্ট গৌহাটিতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তাকে সংবর্ধনা জনিয়েছিলেন। কেবলছানা গত ২০১ প্রকাশন তাকে সংবর্ধনা জানান ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ ইংরেজিতে। ১৯৯৪ ইংরেজিতে আগরতলার অর্নাঞ্চিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাহিত্য সম্মেলনের কেন্দ্রিয় কমিটিতে কার্যকরী সভাপতি হিসাবে তাকে মনোনীত করা হয়েছিল। কমিটির মূল সভাপতি ছিলেন ককবীক সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যােিক সুবন্ধ দেবার্মা। বিমল চৌধুরী রাজের গণতান্ত্রিক কলাকুশলর সংগঠনের কেন্দ্রিয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন।
দাঙ্গা, ফ্যাসিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে, শান্তির বার বার তাঁকে পদযাত্রার দেখেছি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। শিল্পী-লেখকদের আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের সমর্থনে একটু ভিন্ন চেহারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয় আগরতলায়, রাজ্যের অন্যত্রও। এ আন্দোলনের সামনেও তিনি ছিলেন, যেভাবে রুগ্ন শরীরেও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংহত প্রতিবাদের পদযাত্রায় তিনি বেরিয়ে এসেছেন রাজপথে।
0 মন্তব্যসমূহ