অণুগল্প || দিব্যেন্দু নাথ

নিজেই নিজের গন্তব্য

দিব্যেন্দু নাথ

শহরের দক্ষিণ প্রান্তে তুইসামার স্রোত বয়ে চলে নিরন্তর—নীরব, অথচ অবিচল---প্রাণবন্ত সারা বছর। তারই পাড়ে ‘আমা-নিকাতি’ (মায়ের ঘাট), যেখানে প্রতিদিন জীবনের নানা রং এসে জড়ো হয়। ওপারের ছোট্ট গ্রাম কাঙরাই। জুমের সময় ছাড়া গ্রামবাসীরা শহরের দিকে আসে জীবিকার আশায় নিকাতি ধরে।

প্রতিদিন সকালে এক তরুণ—কিশোর, নৌকা চড়ে শহরে যায়, ফিরে আসে সন্ধ্যায়। সে এক নিঃশব্দ নায়ক, যার জীবন গড়ে উঠেছে অভ্যাস ও নিঃসঙ্গতায়। 

কাঙরাইয়ের প্রথম টিলায় তার গাইরিঙ (টং)। ছোট্ট বারান্দায় বসে মাকথৈ (হুক্কা) টানে আর পুরনো খবরের কাগজে চোখ বুলায়। আজ তার চোখে একরাশ ক্লান্ত শান্তি। অফিস চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। সহকর্মীরা বলত, - ও তো আমাদের সেন্টিমেন্টাল ফ্রেন্ড—সব শোনে, সব বোঝে, কিন্তু কিছু চায় না।

এই নির্জীব জীবনের বাইরেও কিশোরের ছিল এক কল্পনার জগৎ—কেউ তাকে ডাকবে, বলবে, - তুমি থাকো আমার পাশে।

সেই আহ্বান এসেছিল কয়েকবার, কিন্তু সবাই ছিল স্বার্থের কাঙাল। তবুও কিশোর মানুষকে বিশ্বাস করে। ভাবে, হয়তো একদিন তার মনের মানুষের সঙ্গে দেখা হবেই।

এই অপেক্ষা আর আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই অফিসের এক অনুষ্ঠানে আলাপ হয় চৈতির সঙ্গে। পার্টি ছিল জমজমাট, কিন্তু সন্ধ্যার আলো ফুরিয়ে আসতেই ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা এক মেয়েকে দেখে এগিয়ে যায় কিশোর। মেয়েটি ছিল প্রচণ্ড সংবেদনশীল, অথচ বেইমান।

- আপনি কি এই অফিসের কেউ?
- আপনার মতো প্রশ্ন সবাই করে। আমি উত্তর দিই না।

তবুও কথার মায়াজালে তারা জড়িয়ে পড়ে। কিশোর বলে, - আমি মানুষ দেখি না, শুনি। কণ্ঠের ধ্বনিতে হৃদয়ের সুর খুঁজি।
- আমায় শুনে তোমার কী মনে হল?
- অনেক শূন্যতা লুকিয়ে আছে গলায়...

চৈতি ম্লানভাবে হাসল, কিছু বলতে গিয়েও বলল না। শুরু হলো এক নীরব টান—চায়ের আমন্ত্রণ, বইয়ের নাম, গভীর রাতে হোয়াটসঅ্যাপের কোমল বাক্য। চৈতি ধীরে ধীরে খুলে দিল নিজের ভাঙা গল্প—এক সংসার, অবহেলিত জীবন, এক চুনিলাল—ভণ্ড প্রেমিক, লাভের ব্যবসায়ী।

এক বিকেলে কিশোরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নদীর ঘাট পর্যন্ত এল চৈতি। বলল, - তুমি জানো, আমি একসময় বিশ্বাস করতাম
- কি?
- কারো কাছে নিজের সব কিছু বলতে পারলে শান্তি পাওয়া যায়। এখন আর পাই না।
- হয়তো সময় বদলে গেছে।
- শুধু সময় নয় কিশোরদা, মানুষও বদলে যায়। তবে তুমি আলাদা। মন দিয়ে শোনো। বাকিরা শোনার ভান করে।

চৈতির চোখে জল। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠল—চুনিলালের কল। একটু দূরে সরে যায়।

চৈতির জীবন সহজ ছিল না। সংসার ছিল, স্বামী ছিল, কিন্তু ভালোবাসা ছিল না। সেই শূন্যতার মধ্যেই এসেছিল চুনিলাল। প্রেমের নামে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারবার ছিঁড়ে ফেলেছিল চৈতির আত্মবিশ্বাস। অথচ চৈতি ভালোবেসেছিল, ভেবেছিল—জীবন বদলে যাবে। হয়নি।

কল রিসিভ করে চৈতি বলল, - একটু বিজি আছি, পরে কথা বলব। মোবাইল ব্যাগে রেখে ধীরে ধীরে ফিরে আসে কিশোরের কাছে।
- তুমি অতীত ভুলতে পারছ না চৈতি?
- সে অতীত নয়, এক অভিশাপ আমার।

কিশোর ছিল এসব কাহিনির নিঃশব্দ শ্রোতা। প্রতিবার চৈতি বলত, “সব শেষ।” আর কিশোর ভাবত—এবার বুঝি চৈতির মুক্তি।
- তুমি চাইলে আমি ওকে থামাতে পারি, চৈতি।
- না! এই লড়াইটা আমি একাই লড়তে চাই, কিশোরদা।

(২)

এক শীতের সন্ধ্যায় নদীর কূলে বসে ছিল তারা। দূর থেকে ভেসে আসছিল তুইসামার মাতাল বাতাস। শেষ শীতের আমেজ, বসন্তের রঙ লেগেছে হাওয়ায়। আশপাশে কম আলো, ঘাসে কুয়াশা। পাখিরা সন্ধ্যার ব্যকুলতা নিয়ে ডাকছে।

চৈতি বলল, - তুমি সবসময় পাশে থেকো, কিশোর। তোমার মতো কাউকে আগে পাইনি।

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিশোর। কিছু বলল না। দেখল চৈতির চোখে জমে থাকা ভালোবাসার কথা, ঠোঁটে আহ্বান, শরীরে নিবেদন। সময় কেটে যাচ্ছিল, কেউ বুঝতেই পারল না।

(৩)

একদিন হঠাৎ কিশোরের পুরোনো বান্ধবী জয়া সঙ্গে দেখা। সে জানাতে এসেছে - তুই কারো জন্য এতটা করিস না যে, নিজেকে হারিয়ে ফেলিস্।
- না না, আমি তো কখনো পাওয়ার জন্য কিছু করিনি, জয়া। শুধু চৈতিকে শুনি। তাকে শুনতে ভালো লাগে।
- তার সমস্যার কথা শহরের অনেকেই জানে...। এখনো সময় আছে, সাবধান হ।

কিছুদিন কিশোরের ফেসবুক ভরে থাকল ব্যথায়। পোস্ট আসত—ভালোবাসা কি শুধু প্রতিশ্রুতি? কেউ শুধু কষ্ট দিয়ে যায়, কেউ কিছু রেখে যায়...।

চৈতি ফোন করে বলত, - এসব করে কী প্রমাণ করতে চাও? আমি তোমায় ভালোবাসি!
- কিছুই না, কষ্টটা একটু হালকা করার চেষ্টা করি।
- দেখ, আমরা শুধু বন্ধু দুজন। ভালোবাসায় আর বিশ্বাস নেই আমার। যা ঘটেছে, তা কেবল এক ঘটনা মাত্র...।

তবুও মাঝে মাঝে চৈতি আনমনে বলত, " কিশোর, হয়তো অজান্তেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।

কিন্তু চুনিলালের ফোন এলেই, দ্বিধাগ্রস্ত হয় চৈতি। কিশোরের সঙ্গে দার্শনিক আলোচনা শুরু করে...

একদিন চুপচাপ কিশোর মেসেজ পাঠাল—“তুমি নদীর মতো। এসে ছুঁয়ে গেলে, আবার সরেও গেলে... আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তুমি ভালো থেকো, চৈতি।”

চৈতির কোনো উত্তর এল না; বরং ফেসবুকে ব্লক করল কিশোরকে। ফোনের নোটিফিকেশন বন্ধ করল। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে লিখল—এত নিচু মানসিকতার মানুষ তুমি! আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকলে আমার সম্মানহানি হবে। আজকাল এই ফেসবুক সবাই দেখে'  কিশোর কিছু বলার আগেই সেখানেও ব্লক হল।

অনেক দিন পর চৈতি সেই পুরোনো গলি ধরে নদীর পারে এল। জানে না কিশোর কোথায়, কী করে। ওপারের দিকে তাকিয়ে রইল আনমনে। সহসা মনে হল, টিলা গড়িয়ে গলিপথ ধরে ভেসে আসছে এক বাউলা সুর—“দেখেছি রূপ-সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা, তারে ধরি ধরি...”

চৈতি নদীর জলে নিজের মুখ দেখে - ভালোবাসা সত্যিই ছিল। কিন্তু আমি চিনতে পারিনি। হয়তো কিশোর এখন বস্তির কোনো টিলায়, গ্রামের কোনো গলিতে হাঁটে। গান গায়। হয়তো সে শান্ত। আর আমি? এখন আর নদী নই—নিজেই নিজের গন্তব্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ