জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।”—রবীন্দ্রনাথ || মীনাক্ষী ভট্টাচার্য

জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।”—রবীন্দ্রনাথ || মীনাক্ষী ভট্টাচার্য 

২০০৮ সালে আমি বিদ‍্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রমোশন পেয়ে বদলি হই বিশালগড় মহকুমার মতিনগর হাইস্কুলে।সহকারী প্রধান শিক্ষিকা। আমি বরাবর পড়াতে ভালোবাসি। এখন পড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যালয়ের অন‍্যান‍্য দিকগুলোর দিকেও নজরদারি করার দায়িত্ব যুক্ত হলো। বিদ্যালয়টি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে।কম‍্যান্ডার জীপে করে নাগেরজলা থেকে যেতে হয়।বিদ্যালয়টি বর্ডার এলাকায়। এলাকাবাসীর বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ ভালো। এলাকাবাসী বেশিরভাগ গরীব।
মেয়েদের  বিয়ে দেবার বিষয়ে বেশিরভাগ অভিভাবকদের মনোযোগ বেশি, পড়ানোর দিকে অনেক কম। শতকরা প্রায় পঁচানব্বই ভাগ মুসলিম সম্প্রদায়ের। এলাকায় মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার আছে বিত্তশালী। কারণ, তাদের পরিবারের কোনো সদস‍্য সম্ভবত দুবাই চাকরি করেন। এলাকায় শিক্ষিতের হার যথেষ্ট কম।  চাষবাস করা, ক্ষুদ্র ব‍্যবসা করা - ইত্যাদি ছিল বেশিরভাগ এলাকাবাসীর সংসার চালানোর উপায়।
আমি বদলি হয়ে যখন এই স্কুলে এলাম- তখন একজন প্রধান শিক্ষক ছিলেন ( নামটা ইচ্ছে করেই লিখলাম না) । স্কুলের সার্বিক উন্নয়নের দিকে মহোদয়ের  কোনো উৎসাহ ছিল না। অভিভাবকদের সাথে আমাদের মিটিং ডেকে আমি অত্যন্ত যত্ন সহকারে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, মেয়েদের লেখাপড়া করাটা কতোটা জরুরি।
আমার এ পদক্ষেপ উনার পছন্দ হয় নি। তবে Teacher’s council secretary সফিকুল ইসলাম স‍্যার (এলাকার বাসিন্দা ) সব সময় আমার এইসব কার্যকলাপের পক্ষে ছিলেন।যাইহোক- এ বিষয়ে আমি বিশদে এখন যাবো না। পরে একসময় বলা যাবে সে আরেক কাহিনী। এখন ছাত্রছাত্রীদের কবিতা লেখার প্রসঙ্গে যতটুকু দরকার- ততটুকুই বলবো।
অল্প কিছুদিন পর প্রধানশিক্ষক বদলি হয়ে গেলেন।
নতুন প্রধানশিক্ষক হয়ে এলেন মলয় ভৌমিক মহোদয়।
স্কুলের সাংস্কৃতিক দিকে আমার ভূমিকা দেখে খুব খুশি হলেন। আমার রুমটি উনার রুমের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট ছিল। তিনি লক্ষ করলেন যে, আমার রুমটিতে টিফিনের সময় কিংবা আমার কোনো অফ্ পিরিয়ডে বাচ্চারা আমাকে ঘিরে থাকে। ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির হয়তো মহড়া দিচ্ছি কিংবা কবিতা নিয়ে আলোচনা করছি । তখন তিনি তাঁর বিশাল কক্ষটি আমার জন্যে ছেড়ে দিয়ে তিনি অন‍্য একটি মোটামুটি বড় কক্ষে শিফ্ট করলেন। আমার বাচ্চাদের তো আনন্দের সীমা নেই। বিদ‍্যালয়ের শিক্ষিকা রীতা সাহা রায় ও নিভা দিদিমনি আমার রুমে আসতেন এবং আমাকে এসব বিষয়ে সাহায্য করতেন। স‍্যার একটি হারমোনিয়াম কিনে এনে আমার রুমে রাখলেন। আমি কৃতজ্ঞ। হারমোনিয়াম থাকায় প্রেয়ার মিটে গানগুলো জমত ভালো। আমি এবং রীতা সাহারায় দিদিমনি হারমোনিয়ামটা বাজাতাম। কখনো সুধাংশু স‍্যার এবং মধুসূদন স‍্যারও বাজিয়েছেন।
বিদ‍্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম ক্লাস পর্যন্ত যে কোনো ক্লাসে যে কোনোদিন কখনো আমি এবং কখনো H. M. পরিদর্শনে যেতাম। এছাড়া কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত হলে সেই ক্লাসগুলোর একটা অন্তত আমি নিতাম। HM ও নিতেন। অন‍্যান‍্য শিক্ষক শিক্ষিকারাও নিতেন।
সেইসব ক্লাস নিতে গিয়ে আমি তাদের কখনো কবিতা লিখতে বলতাম। কিংবা কখনো তাদের ইচ্ছেমতো কোনো মেলা সম্পর্কে অথবা বিদ্যালয় সম্পর্কে বা যার যা মনে আসে সে সম্পর্কে লিখতে বলতাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওরা বেশিরভাগই কবিতা লিখত শুরু করল। আমি এতো খুশি যে ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলাম। ছাত্র ছাত্রীরা জানত আমি কবিতা লিখি। বই প্রকাশিত হয় ইত‍্যাদি। এরকম অভ‍্যাস প্রায়ই চলতে থাকার পর আমি একদিন আমাদের স্টাফ মিটিং এ একটি দেয়াল পত্রিকা বের করবার প্রস্তাব দিই। প্রধানশিক্ষক সহ অন‍্য স্টাফেরা সবাই সহমত পোষণ করলেন। উদ‍্যোগ  শুরু হয়ে গেল।
একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও প্রস্তুতি শুরু করলাম।
অবশেষে একদিন ছাত্রছাত্রীদের লেখা গল্প, কবিতা, নিবন্ধ, ছড়া ইত্যাদিতে সাজানো ‘ জোনাকি ‘ নামে একটি দেয়াল পত্রিকা বের হল। আগরতলার স্বনামধন্য সাহিত্যিক আমার মিত্রসম শিক্ষক ড. আশিসকুমার বৈদ্য মহোদয়কে আমন্ত্রণ করে আনা হল উদ্বোধনের জন্য।
তিনি যথাসময়ে এসে উদ্বোধন করলেন এবং চমৎকার একটি বক্তব্যও রেখেছিলেন। এলাকায় এর আগে বিদ‍্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানে এতো লোকসমাগম হয় নি।
এলাকাবাসীর কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পেয়েছি যে আমি অভিভূত। পরবর্তীতে আমি তথ‍্য সংস্কৃতি দপ্তরে যোগাযোগ করে কবি হিসেবে আমার ছাত্র ছাত্রীদের নাম লেখাই। তারপর বইমেলার কবিসম্মেলনে তাদের কবিতা পাঠ করার জন্য আমন্ত্রণ আসে। আজও তারা কবিতা পাঠ করে। পত্রিকাতে যখন দেখলাম ( ২০২৫ সাল) কবিতা পাঠ করবে বিউটি ঘোষ, চামেলি বেগম, দোস্ত মহম্মদ এরা— তখন অদ্ভুত এক আবেশে মনটা ভরে গেল। 
আমি ঐ স্কুল থেকে আবার প্রমোশন পেয়ে ২০১৪ সালে বদলি হয়ে রাজনগর গান্ধীগ্রাম হাই স্কুলে প্রধানশিক্ষিকা পদে বৃত হই। দশ বছর হলো অবসর নিয়েছি। আজো কবিতাস্রোত বইছে আমার ছাত্র ছাত্রীদের বুকের মধ্যে- এটা ভাবলে সবকিছুই বড়ো সুন্দর মনে হয়। জীবনে বড়ো কিছু তো করতে পারলাম না। অন্তত ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে বেঁচে থাকার মতো একটুখানি কাব‍্যবীজ রোপন করতে পেরেছি ভেবে সান্ত্বনা পাই। আমার সকল ছাত্র ছাত্রীদের বলছি- তোরা ভালো থাকিস্ আর সমাজকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিস্। আদর আদর অনেক আদর।❤️❤️❤️❤️❤️

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ