মীনাক্ষী ভট্টাচার্যের নির্বাচিত কবিতা
কবি পরিচিতি
মীনাক্ষী ভট্টাচার্য ত্রিপুরার সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে একটি বিশিষ্ট নাম। তাঁর জন্ম কৈলাসহরে। তিনি প্রয়াত কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ও প্রয়াতা শান্তিলতা ভট্টাচার্যের কন্যা। পড়াশোনা এম. এ (বাংলা) বি. এড (ফার্স্ট ক্লাস) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী এবং দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে সাহিত্য জগতে সুপরিচিত নাম। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুস্থ সংস্কৃতির বীজ বপনে তাঁর প্রয়াস ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর 'শিক্ষক দিবসে' তিনি রাজ্য সরকারের বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তর কর্তৃক কৃতী শিক্ষিকা হিসেবে সংবর্ধিত হন। রাজ্যের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ যেমন প্রকাশিত হয়েছে-তেমনি পশ্চিমবঙ্গ ও শিলচরের কয়েকটি সাহিত্য পত্রিকায়ও তাঁর লেখা বেরিয়েছে। তিনি কবি হিসেবে ২০১৪ সালে 'মীনাক্ষী সেন স্মৃতি' সম্মান, ২০১৫ সালে 'আচার্য গৌরদেব স্মৃতি' সম্মান এবং ২০১৬ সালে 'বিমলকুমার ঘোষ স্মৃতি' সম্মানে সম্মানিত হন।
'মানবী' প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত নির্বাচিত দুটো গল্প সংকলনেই তাঁর দুটো ছোটো গল্প স্থান পেয়েছে। তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে অসমীয়া ভাষায়ও।
তিনি রাজ্যের একজন বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী।
২০১১ সালে বিশালগড় মহকুমা ভিত্তিক বিজ্ঞান নাটক প্রতিযোগিতায় তাঁর বিদ্যালয় অর্থাৎ মতিনগর উচ্চ বিদ্যালয় প্রথম পুরস্কার পায় তাঁর লেখা নাটক অভিনয় করে। তিনি পান বেস্ট ডিরেক্টরের পুরস্কার ও বেস্ট স্ক্রিপ্ট রাইটারের পুরস্কার। মীনাক্ষী ভট্টাচার্য ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ থেকে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন এবং তিনি এই সংস্থার একজন আজীবন সদস্য। ২০১৯ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর আগরতলা লায়ন্স ক্লাব ফেমিনা থেকে মীনাক্ষী ভট্টাচার্যকে কৃতী শিক্ষিকা হিসেবে সংবর্ধনা
জানানো হয়।
২০২১ সালে ত্রিপুরা প্রকাশনা মঞ্চ থেকে মীনাক্ষী কবি হিসেবে পুরস্কার পান "কবি হিমাদ্রী দেব" স্মৃতি সম্মাননা। এছাড়া বহু সম্মাননা ও শুভেচ্ছা স্মারক পেয়েছেন বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা থেকে কখনো কবি হিসেবে কখনো বাচিকশিল্পী হিসেবে। ২০২২ সালের ৮ ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহিলা চিত্রশিল্পীদের সংস্থা LA FEMME থেকে বিশিষ্ট লেখিকা হিসেবে তাঁর সম্মাননা প্রাপ্তি। ২০১৬ সালে 'স্রোত' প্রকাশনা সংস্থা থেকে তিনি সাহিত্য সম্মান' লাভ করেন। ২০১১ সালে রবীন্দ্র জন্ম সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে ত্রিপুরা কর্মচারী সমন্বয় কমিটি (এইচ. বি. রোড) আয়োজিত একক অভিনয় প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের " কর্ণকুন্তীসংবাদে" অভিনয় করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন।
মীনাক্ষী বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে অনেক নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যগীতি আলেখ্য ইত্যাদি মঞ্চস্থ করিয়েছেন। তিনি তাঁর বিদ্যালয়ে জোনাকি' নামে একটি দেয়াল পত্রিকা বের করিয়েছিলেন। তাঁর লেখা সৌরস্নাত রবীন্দ্রনাথ "প্রবন্ধগ্রন্থটি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত হয়েছে। এই গ্রন্থটি কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের গ্রন্থাগারেও স্থান পেয়েছে।
স্বাধীনতা তুমি
স্বাধীনতা তুমি
পবিত্র মহালয়া ভোর
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠ
একটি সূর্যকরোজ্জ্বল প্রভাত ।
স্বাধীনতা তুমি
ভারতের চন্দ্রবিজয়
মহাকাশ গবেষণায়
বিজ্ঞানীদের বিপুল জয়।
স্বাধীনতা তুমি
ফেব্রুয়ারি ও মে মাসের
ভাষা-আন্দোলনের ঝড়।
তুমি চৈতন্যের অগ্নিবর্ণ ফুল
দশভুজার খোলা চুল।
স্বাধীনতা তুমি
রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’
নজরুলের শেকলভাঙ্গার গান ।
বিদ্যাসাগরের ‘ বর্ণপরিচয়’
তোমাকে ভুলবার নয় ।
স্বাধীনতা তুমি
ভাঙ্গছ অনর্গল অর্গল
গাইছ ধ্রুপদ , ঠুংরী, গজল।
পড়ছ কবিতায় ‘ অটল’।
স্বাধীনতা তুমি
সুকান্তের আঠারো বছর বয়স বঙ্কিমের দেবীচৌধুরাণী ,
স্বামীজীর শিকাগো-ভাষণ
নেতাজীর প্রদীপ্ত বানী।
স্বাধীনতা তুমি
আশ্বিনের আকাশপ্রদীপ ।
প্রতিমার উজ্জ্বল মুখ ,
বর্ষায় ভরা গঙ্গার বুক।
স্বাধীনতা তুমি
নদী-জলের তরল কম্প্র ছবি ।
তুমি দেশপ্রেমিক এক
আবেগপ্রবণ কবি।
স্বাধীনতা তুমি
নীলাকাশে ঘুড়ির উড্ডীন ,
যা দেখে কেটে যায়
‘ অমলের’ সারাদিন।
স্বাধীনতা তুমি
প্রকৃতির বিচিত্র বৈভব ।
নানা ধর্মের প্রার্থনার রব ,
তাইতো তুমি এতো রমণীয় ,
এতো কাঙ্ক্ষিত, এতোটা প্রিয়।
শেষের গোধূলিলগন
ও চোখ কেমন কবিতা শুনায়
স্বপ্ন দেখায় আলসে ভোরে
ও চোখ আমায় সুরটি চেনায়
কড়া নাড়ে মনের দোরে ।
শ্রাবণগহন একটি দিনে
চুল আর চিন্তা উড়িয়ে পবনে
পাশাপাশি হেঁটেছি দুজন
নিবিড় ছিল কথোপকথন ।
তখন আমাদের ভরদুপুর
গালদুটো গোলাপ-লাল
সমীর তখন ছিল সুমধুর
সঙ্গে তোমার লঘু চাল ।
প্রথম ফুলের গন্ধে বিভোর
তখন আমাদের পল অনুপল
প্রকৃতি সেদিন যুগিয়েছিল বল
ছিল অমলিন সেদিনের ভোর।
এখন সঙ্গীবিহীন ক্লান্ত যাপন শেষে
দ্রুত হচ্ছে হঠাৎ-ই হৃদস্পন্দন
টের পাচ্ছি সময় সন্নিকটে
আসন্ন সেই শেষের গোধূলিলগন।
কয়েক টুকরো মেয়েবেলা
স্কুল ফিরতি হঠাৎ বৃষ্টির তোডে
জামা কাপড় ভিজে যখন একশা
বাড়ি ফিরতেই দেখি অবাক চোখে
মা দাঁড়িয়ে হাতে আদা- চা।
পড়তে পড়তে রাতে যখন
চোখ ঢুলুঢুলু —
মশারী টেনে , পাখা চালিয়ে
বাবা বলতেন একটু জোরে —
‘ কাল যেন পড়তে দেখি
ঠিক কাকভোরে।’
মাছ খেতে অনীহা ছিল
ছোটবেলায় খুবই
কাঁটাবাছার ভয় যে আমার
বুঝতেন বাবা ঠিকই
যত্ন করে দিতেন বেছে,
এবং তাই—
তৎক্ষণাৎই গপাগপ্ খাই।
পূজো এলেই বাবা দিতেন
ফ্রক জামা জুতো
সব্বাইকে পছন্দমতো
নবমীতে বাবা-মা
যেতেন দেবী- দর্শণে
কী অপরূপ লাগত তাঁদের
খুশি ঝলোমল দর্পণে।
পরণে কিন্তু থাকত তাঁদের
পুরনো কাপড় ইস্ত্রি- করা
কপালের ভাঁজে জমানো কিছু
কর্তব্য কাজ সেরে
পূর্ণ থাকত মনটি তাঁদের
আনন্দেতে ভরে।
আসত যদি ফিরে সেই
ছোট্ট মেয়েবেলা
শুতাম তবে মায়ের কোলে
হোক্ না অবেলা।
হেমন্তে বেহালার সুর
গোলাপগুলো বাইরে দেখতে লাল
অন্তরে তার রক্ত ঝরে কতো
আমায় দেখে বুঝতে কি পারো
বক্ষে আমার কী গভীর ক্ষত ?
তোমার হৃদয় হারিয়ে গেছে ভীড়ে
হেমন্তে বেহালায় শুধু বাজে
উৎকন্ঠিত প্রতীক্ষার সুর
কখন তুমি আসবে আবার ফিরে।
প্রিয়তমা গোমতী
হঠাৎ এল বৃষ্টি
দেখি-বৃষ্টি হেঁটে নামল সোজা
তোমার জলে
তখন তুমি টই- টম্বুর
তখন তুমি কী মিষ্টি!
কি জানি কোথা থেকে
আসবে সুজন
নৌকো ভাসাবে তোমার জলে
জানি না সে কোন্ জন্ ?
বৃষ্টির স্বরলিপি দেখে দেখে
আমরা গাইব গান
যাবো নারকেল কুঞ্জে
বিমুগ্ধ হবে প্রাণ ।
যখন জলতরঙ্গে
চাঁদ দোলে
পর্যটনের প্রকৃতি- সুখকে
দ্বিগুণ বাড়িয়ে তোলে
চারপাশের সেকি অপরূপ দৃশ্য !
বাউলের চিত্র-বিচিত্র জামা-সদৃশ ।
যাচ্ছি আমরা ডুম্বুর
কতো জেলে মাছ ধরে
বাঁচে তোমারই বরে
যাবো মন্দির শহর উদয়পুর ।
তোমারই তীরে দাঁড়িয়ে
মাতা ত্রিপুরেশ্বরী
এবং ‘রাজর্ষি’, ‘বিসর্জন’-খ্যাত
মা ভুবনেশ্বরী।
ইচ্ছে করে গোমতী,
তোমার সাথে সাথে যাই
পার করি ঢেউয়ে ঢেউয়ে
জীবনের চড়াই- উৎরাই।
যখন বৃষ্টি ঝরে
রূপোলি এক মাঝনদীতে
নৌকো যখন কাৎ
হঠাৎ দেখা তোমার সাথে
নেহাৎ-ই দৈবাৎ
খর-চৈত্রের দুঃসহ এই
তপ্ত হৃদয়-ভরে
সংগোপনে কোথায় যেন
আজো বৃষ্টি ঝরে ।
বৃষ্টিফোঁটার জলের মতোন
প্রাণের আকুলতা
সৃষ্টি করে মিষ্টি কতো
প্রেমের কবিতা
চাঁদের আলোয় তোমার হিয়া
যখন প্রাণিত
বৃষ্টি ঝরত অঙ্গ জুড়ে
কেউ কি জানিত?
আঁধার রাতে প্রদীপ জ্বেলে
তোমার দৃষ্টিপাত
আঁখিপাতে তখন আমার
নীরব বৃষ্টিপাত।
স্বাক্ষরহীন আলোর চুম্বনে
পদ্ম ফুটল মনের উপবনে
দৃষ্টিতে তোমার প্রণয়-ঝালর, খুশির
যেন শারদ- প্রাতের প্রথম শিশির।
একাকী দাঁড়াতে পারি প্রতীক্ষা অধীর
তুমি কি ডেকেছিলে কবিতা
স্বপ্নের মাঝে ঘুমের নিঃশ্বাসে?
মেঘলা আকাশ থেকে
কার যেন কন্ঠস্বর ভেসে আসে!
তবে কি তারাদল নিয়ে এল
স্মৃতির গোধূলি!
কোনো এক অনিদ্রাজাগর রাতে
হাসি-অশ্রুর শব্দ বসিয়ে বসিয়ে
শব্দের ইমারত গড়ে তুলি।
যৌবনের সান্নিধ্য খুঁজি
মলিন বইয়ের ছেঁড়া পাতায়
উড়ে আসা চৈত্রের পত্রে
কবিতাকে মনে পড়ে যায়।
‘ভালোবাসা’ চোখ বুজে পড়ে আছে
পুরনো এ্যালবামে
পাতায় পাতায় রয়েছে
শেষ অস্তরাগ
যেখানে ছড়িয়ে আছে
প্রেমের পরাগ।
এই যে ছবি দেখে
বুকের মাঝে অকাল বৃষ্টি ঝরে
কিংবা, বিশেষ দৃশ্য দেখে
রোদ জ্বলে হৃদয়- ঘরে
এই যে হঠাৎ টের পাই মনের মধ্যে
প্রীতি-গন্ধ মাখা বাতাস
তারজন্যই তো
বেঁচে আছে এখনো
কবিতা লেখার আশ।
সেদিন বলেছিলে—
হাতে হাত রেখে দেখবে
কান্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয়
তোমার সান্নিধ্যে পালাবে আমার
পাহাড়ে চড়ার ভয়।
কথা ছিল আরোও—
খেলবো দুজনে
জল ছুঁই ছুঁই খেলা
এখন জলভরা চোখে
মনে পড়ে শুধুই
মিথ্যে শপথের বেলা।
শুধু তোমার জন্যই কবিতা,
এখনো দাঁড়াতে পারি
একাকী প্রতীক্ষা অধীর
যতোই চারপাশে থাকুক
দুর্ভেদ্য তিমির।
ঠিকানা জানে অন্তরঙ্গ বিকাল
যেমন করে ভোরের ঘাস
সেরে নেয় শিশিরে স্নান-
তেমনি তোমার গানের ধারায়
স্নাত হয়েছি কতো দিন-মাস।
প্রণয়-বিমোহিত গন্ধে
থেকেছি বিভোর
সুরের মায়ার মুগ্ধতায়
কেটেছে রাত- ভোর।
এখন আকাশ আঁচড়াচ্ছে যেন কেউ
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন
স্মৃতি-ঘরে উঁকি দিচ্ছে মন
বুকের ভেতর শূণ্যতার ঢেউ।
সন্ধ্যেবেলা ছাদে গাইবার সময়
উড়ু উডু থাকত তোমার অলক
বাঁকা চোখে তা দেখত
ছাদের কোণের চাঁদ অপলক।
ভালোবাসা সহসা গেছে প্রবাসে
ঠিকানা খুঁজছি অবিরাম
কবে যে পৌঁছব সেখানে
যাবই বা কোন্ বাসে।
ঠিকানা তো জানে শুধু
এক অন্তরঙ্গ বিকাল
খুঁজে তো পাবোই তাকে
আজ না হোক কাল।
অপেক্ষায় অনূঢ়া
শীত এলে যেভাবে মানুষ
গ্রীষ্মকে ভুলে যায়—
ছেলেটিও ভুলে গেল মেয়েটিকে
শেষ দেখা ফাগুন পূর্ণিমায়।
মাটিতে আলপনা আঁকে
মেয়েটির অশ্রুধারা
তার ভাবনা—তাকে
জোড়া-শালিখ এনে দেবে কারা।
ভুল করে হয়তো মেয়েটি
একবারই গেয়েছিল
বসন্তের গান বর্ষার বিকেলে
কিংবা শীত মধ্যযামে খেলাচ্ছলে।
শীতের শেষে বসন্তের হাতছানি
এই নিদারুণ মধুমাসে
মলিন হয়েছে মেয়ের স্বর্ণ-মুখখানি
গাছে গাছে লাল কৃষ্ণচূডা
বিবিক্ত জীবন নিয়ে আজও
অপেক্ষায় অনূঢ়া।
0 মন্তব্যসমূহ