দীর্ঘ কবিতা, জীবন ও মহাজীবনের অন্বয়
তৈমুর খান
--------------------------------------------------------------------
'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য থেকে শুরু করে সমস্ত মঙ্গলকাব্যই যে এক একটি দীর্ঘ কবিতা তা বলাই বাহুল্য। সময়কাল, সমাজ, জীবন, প্রেম, ভবিষ্যৎ ও আধ্যাত্মিকতা নিয়েই এই কাব্যগুলি রচিত হয়েছে। ব্যক্তিজীবন বৃহত্তর সমাজ জীবনে মিশে গেছে। সময় অনন্ত সময়ে যাত্রা করেছে। প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা সাধনার পথের দিশা দেখিয়েছে। তাই আজও কাব্যগুলি প্রাচীন হয়েও দীর্ঘমেয়াদী জীবনবাদের অন্বয়কেই নির্দেশ করে চলেছে। যখন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এর রাধার আর্তি শুনি:
"কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন।।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।।ধ্রু।।"
তখন এই প্রেমের আবেদন, আবেদনের উত্তর শত শত কবি বাংলা কবিতায় লিখেছেন। আল মাহমুদ তাঁর 'সোনালী কাবিনে' লিখেছেন:
"সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রূকুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন,
ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।"
এই আর্ত ও আর্তি দীর্ঘ কবিতায় আজও সঞ্চারিত হয়ে চলেছে।রাজা-বাদশার জয়-পরাজয়, সাম্রাজ্য বিস্তার, প্রশস্তি রচনা, কাব্য উৎপত্তির কারণ সব পর্ব ভেদ করে কবি-হৃদয়ের তাপ-অনুতাপ, হাহাকার, আত্মনিবেদনই প্রতিফলিত হয়েছে।ঘটনার সমাবেশ অথবা আখ্যানের ভেতর দিয়ে সময় ও সমাজের বাস্তবতাকে স্বীকার করেও জীবনের চরম ও পরম অভিযাত্রাই মর্মরিত হয়েছে। তাই জীবনানন্দ দাশের 'আট বছর আগের একদিন','১৯৪৬-৪৭'; কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী';আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর 'আমি কিংবদন্তির কথা বলছি'; নির্মলেন্দু গুণের 'স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের কীভাবে হলো' পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের 'শবযাত্রা','ইবলিসের আত্মদর্শন' ইত্যাদি পড়তে পড়তে জয় গোস্বামীর 'হরিণের জন্য একক' এবং 'পাতার পোশাকে' থেমে গেলাম। 'পাতার পোশাকে' জয় লিখলেন:
"ঐ যে প্রেমিক আর ঐ যে প্রেমিকা
প্রচুর ঘুমের পিল ব্যাগে নিয়ে ঘুপচি মতন হোটেলে উঠছে
ঐ যে যুবক আর ঐ যে যুবতী
ফলিডল শিশি নিয়ে চুপচাপ দরজা দিচ্ছে ঘরে
ঐ যে ছেলেটি আর ঐ যে মেয়েটি
রেললাইনের ধারে, ঝোপে ঝাড়ে, দাঁড়িয়ে রয়েছে সন্ধ্যেবেলা
দূরে
লোকালের আলো
আজ,কাল,পরশু,তরশু ওদের সবাইকেই
অপঘাতে মৃতরূপে খুঁজে পাওয়া যাবে…
ওরাতো মাস্টার-ছাত্রী,দেওর-বৌদি তো ওরা,
ওরা তো সুদূর সম্পর্কে ভাইবোন
লোকচক্ষু থেকে ওরা এই পথে বাইরে চলে এলো
আসলে, কখন ওরা হোটেলের ভ্যাপসা ঘর,
হাসপাতাল,মর্গ আর রেলখাল ছেড়ে
উঠে গিয়ে,
আকাশের একটুখানি পরে
বসতি তুলেছে – হ্যাঁ – জবর দখল।
সেখানে মেঘের তৈরি গাছ
সেখানে হাওয়ায় তৈরি কুটির—সেখানে
পাতা,শুধু পাতার পোশাক।
সে দেশে এখন
ছিন্নভিন্ন বৌটিকে ছবি এঁকে দিচ্ছে তার
রেলেকাটা কিশোর প্রেমিক
আঁচলে কষের রক্ত মুছিয়ে মেয়েটি বলছে :
তাহলে এবার একটা গান কর বটাই!
যুবকটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে মুছে দিচ্ছে যুবতীর
সারা গায়ে মর্গের সেলাই।
আর এক মাথা গরম কবি,
এই মর্ত্যমাঠ থেকে উপরে তাকিয়ে
দেব-দেবীদের সঙ্গে সমানে হাঙ্গামা করছে
স্বর্গের এই জমিটুকু এক্ষুনি ওদের নামে
লিখে দেওয়া চাই!"
এই প্রেমের গান,মৃত্যুর গান, জীবনের গান, ঘরকন্নার গান একসঙ্গেই মিলে গেছে। কবিতা আখ্যান ভেদ করে পুনরায় জীবন আখ্যানে পুনর্নির্মাণ লাভ করেছে। যেখানে লৌকিক-অলৌকিকতার সমন্বয় সম্ভব। যেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভেদ রেখা মুছে যায়। যেখানে জীবন মৃত্যুর দাক্ষিণ্য পরোয়া করে না। শুধু প্রেমই উজ্জীবনের সঞ্চরণ হয়ে ফিরে আসে। অপরিমেয় জীবনসূত্র তার আলোকচ্ছটায় উদ্দীপিত হয়।
দীর্ঘ কবিতা উল্লেখযোগ্য দৈর্ঘ্যের কবিতার একটি সাহিত্য ধারা । নির্দিষ্ট করে দীর্ঘ কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না, তা সর্বদা অস্পষ্ট এবং বিস্তৃত। তবে এই ধারাতেই এখনও পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কবিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যেমন মহাভারত। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ কবিতা যা ১০০,০০০ শ্লোকে লেখা হয়েছে। ইলিয়াড এবং ওডিসিকে একসঙ্গে করলেও আকারে তা দশগুণ। দান্তের 'ডিভাইন কমিডি'র পাঁচগুণ এবং ফেরদৌসীর 'শাহনামাহে'র চারগুণ। ইংরেজিতে,Beowulf জার্মানির বীরত্বপূর্ণ কিংবদন্তির ঐতিহ্যের একটি পুরাতন মহাকাব্য।Troilus ও Criseyde-ও জিওফ্রে চসারের একটি মহাকাব্য যা ট্রয়লাস এবং ক্রিসাইডের প্রেমিকদের বিয়োগান্তক কাহিনির বর্ণনা করে। ট্রয় অবরোধের সময়ে যুদ্ধের একটি পটভূমি।এটি রাইম রয়্যালে লেখা হয়েছিল এবং সম্ভবত ১৩৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সম্পূর্ণ হয়েছিল। অনেকেই চসারের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করেন। একটি সমাপ্ত দীর্ঘ কবিতা হিসেবে এটি অধিক পরিচিত, কিন্তু শেষপর্যন্ত অসমাপ্ত 'দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস'-এর চেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ।
একটি দীর্ঘ কবিতা যথেষ্ট দীর্ঘ যে এর বেশিরভাগ অর্থ বহন করে। সুসান স্ট্যানফোর্ড ফ্রিডম্যান দীর্ঘ কবিতাকে এমন একটি ধারা হিসেবে বর্ণনা করেছেন যেখানে কোনোমতেই ছোট বলে বিবেচিত নয় এমন সব কবিতাকে আলাদা করে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দীর্ঘ কবিতা আমেরিকান সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি উল্লেখযোগ্য ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । একটি দীর্ঘ কবিতা প্রায়ই একটি 'উপজাতির গল্প' বলতে কাজ করে বা একটি গল্প যা একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতির মূল্যবোধ এবং ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করে। বিখ্যাত কয়েকটি দীর্ঘ কবিতার সূচনা ও বিষয়টি উল্লেখ করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি এই সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।
আলফ্রেড লর্ড টেনিশনের In Memoriam A. H. H.কবিতাটির সূচনা হয়েছিল এভাবেই:
"Strong Son of God, immortal Love, Whom we, that have not seen thy face, By faith, and faith alone, embrace,
Believing where we cannot prove;"
অর্থাৎ
ঈশ্বরের শক্তিশালী পুত্র, অমর প্রেম,
আমরা যারা তোমার মুখ দেখিনি,
বিশ্বাসের দ্বারা, এবং শুধু বিশ্বাস,আলিঙ্গন,
বিশ্বাস করা যেখানে আমরা প্রমাণ করতে পারি না;
বোঝা-ই যাচ্ছে একান্ত ঈশ্বর নির্ভরতায় কবিতাটি আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কারণ কবিতাটির প্রেক্ষাপট ছিল,
কবির কলেজ বন্ধু আর্থার হেনরি হ্যালামের অনুরোধে লেখা। বন্ধুটি ২২ বছর বয়সে আকস্মিকভাবে মারা যান। তার আগে ২১ বছর বয়সে এটি লেখা শোকের মাত্রাকে উপলব্ধি করে। কবিতাটি ২৮৯২ লাইনের, কবি দুঃখকেই মাহাত্ম্য করে বন্ধুকে সারাজীবন স্মরণীয় করে রাখতে চান। কবিতাটিতে কবির দার্শনিকবোধ প্রত্যয়ের সীমানায় অনুরণিত হয়েছে:
"Tis better to have loved and lost Than never to have loved at all.”
ভালোবাসা এবং হারিয়ে যাওয়া ভালো কখনোই প্রেম না করার চেয়ে। বন্ধুত্বের রোমান্টিক প্রেমের উপলব্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ করেছে।
ওয়াল্ট হুইটম্যানের Song of Myself
কবিতাটি শুরু হয়েছে এইভাবে:
"I celebrate myself, and sing myself,
And what I assume you shall assume,
For every atom belonging to me as good belongs to you."
অর্থাৎ
আমি নিজেকে উদযাপন করি, এবং নিজে গান গাই,
এবং আমি যা অনুমান করি আপনিও অনুমান করবেন,
আমার কাছে থাকা প্রতিটি পরমাণু ভালো হিসাবে আপনার জন্য।
ওয়াল্ট হুইটম্যানের এই কবিতাটি দীর্ঘ কবিতা হিসেবে অসাধারণ বাঁক সমন্বিত এবং গতিময়। এটিতে বহুমুখী আত্মনির্মাণের পর্যায় রয়েছে। যেমন "I am large, I contain multitudes” এবং “These are the days that must happen to you”
আমি বড়, আমি বহুগুণ ধারণ করি এবং এই সেই দিনগুলি যা আপনার সাথে ঘটবে আরও অনেক কিছুই।
যদিও এইসব দার্শনিক বাণীগুলি পংক্তিবদ্ধ তবু এর ভাব সুদূরগামী। কবিতাটিতে মোট ১৩৪৯ লাইন আছে। দীর্ঘ কবিতা ঐতিহ্যগতভাবে গল্প বলা কবিতা হলেও হুইটম্যান ঐতিহ্যের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন। পরিবর্তে, তিনি তাঁর কথোপকথন, চেতনার স্টাইল ব্যবহার করেছেন নিজের পরিচয় এবং প্রকৃতির ধারণাগুলির উপর গুঞ্জন করার জন্য। মহাকাব্যগুলি যেখানে একজন নায়ককে তুলে ধরে যে তার সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন। কিন্তু হুইটম্যান তাঁর কবিতায় সাধারণ মানুষেরই গুরুত্বকে অনুধাবন করেছেন। তিনি তাৎপর্য এবং বীরত্ব তুলে ধরেছেন যা প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যেই প্রকট।
টি এস এলিয়ট দীর্ঘ কাব্য The Waste Land এর প্রথমেই উল্লেখ করেছেন:
"April is the cruellest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
Winter kept us warm, covering
Earth in forgetful snow, feeding
A little life with dried tubers.
Summer surprised us, coming over the Starnbergersee
With a shower of rain; we stopped in the colonnade,
And went on in sunlight, into the Hofgarten,
And drank coffee, and talked for an hour."
অর্থাৎ
নিষ্ঠুরতম মাস এপ্রিল,মৃত মাটি
জন্ম দেয় লাইলাক, মিশ্রিত করে
স্মৃতি ও কামনা, উজ্জীবিত করে
শুকনো শিকড় বসন্তের বারিপাতে।
শীত দিয়েছিল আমাদের উষ্ণতা
বিস্মৃতির তুষারে আবৃত করে ধরণীকে
পুষ্ট করে ক্ষুদ্র জীবন শুষ্ক মূল দিয়ে।
গ্রীষ্ম আশ্চর্য করেছে আমাদের স্টানবার্গের মাথায় চ'ড়ে
ঝরনা ঝরিয়ে থেমেছিলাম দু'সারি বৃক্ষ মাঝে
সূর্যালোকে এগিয়ে হফগার্টেনের ভেতর
সেখানে কফি পান হল এক ঘন্টা আলাপে।
৪৩৪ লাইনের কবিতাটি একটি উল্লেখযোগ্য দীর্ঘ কবিতা, যুদ্ধময় পৃথিবীর ধ্বংস শুষ্ক হৃদয়হীনতাকেই রূপকের মধ্য দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। নির্মম বসন্তকালের রূপের মধ্য দিয়েই নিষ্ফলা জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেখানে কবিতাটির মধ্যে রয়েছে:
'That corpse you planted last year in your garden,
Has it begun to sprout?'
যে মৃতদেহ আপনি গত বছর আপনার বাগানে রোপণ করেছিলেন,
এটি কি অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে?
'Here is no water but only rock.'
এখানে জল নেই শুধু পাথর।
'There is the empty chapel.'
আছে খালি চ্যাপেল(খ্রিস্টীয় ভজনালয়)।
একটা সময়ের সমগ্র মানবজাতির দীর্ঘশ্বাস শোনা গেছে এই কবিতাটিতে। সুতরাং এটাও ইতিহাস কিংবদন্তি হয়ে আছে।
দীর্ঘ কবিতা রচনায় বিভিন্ন কবি ‘রিভিশনারি মিথোপয়েসিস’কে গ্রহণ করেছেন।অর্থাৎ সৃজনশীলতার মাধ্যমে পুরানো গল্পগুলির পুনর্বিন্যাস এবং পুনর্বিনির্মাণ করেছেন। যেহেতু এই ধারাটির শিকড় সংযোগ রয়েছে এমন ফর্মগুলিতেই। সুতরাং দীর্ঘ কবিতা একটি 'মৌলিক সংশোধন'ও হতে পারে এবং সেই কবিদের জন্য একটি বক্তৃতা হিসাবে কাজ করতে পারে। এই 'পুনঃদর্শন'-এর মধ্যে থাকতে পারে অবহেলিত চরিত্র, ঐতিহ্যগতভাবে পালিত চরিত্রগুলির অবক্ষয়, এবং সাহিত্য ঐতিহ্য দ্বারা নির্ধারিত মানগুলির একটি সাধারণ পুনর্নির্মাণ। সমালোচক লিন কেলার তাঁর "পুশিং দ্য লিমিটস" প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, দীর্ঘ কবিতাটি আধুনিকতাবাদীদের সমাজতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক উপাদান অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে অনেক দীর্ঘ কবিতা ইতিহাসকে সংশোধনের অর্থে নয় বরং একটি বিন্দু প্রমাণ করার জন্য একটি সাধারণ পুনঃকথন হিসাবে কাজ করে। তারপর এমন কিছু লোক আছে যারা একধাপ এগিয়ে যায় এবং শেখানোর জন্য একটি স্থান বা মানুষের ইতিহাস আবৃত্তি করে। সংশোধনমূলক মিথোপয়েসিসের মতো, তারা ইতিহাসের কিছু অংশকে অতিরঞ্জিত বা সম্পাদনা করে একটি বিন্দু তৈরি করার বা একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করার চেষ্টার মধ্যে।
দীর্ঘ কবিতার লেখকরা কখনও কখনও সম্পূর্ণ কবিতাটিকে সুসংগত করতে অথবা এটি শেষ করার বা গুটিয়ে নেওয়ার উপায় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে খুব অসুবিধায় পড়েন । ব্যর্থ হবার ভয়ও একটা উদ্বেগের জন্ম দেয়, যে সম্ভবত কবিতাটি লক্ষ্যে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলবে না। যেহেতু অনেক দীর্ঘ কবিতায় লেখকের জীবৎকালই কেটে যেতে পারে। এজরা পাউন্ড এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছিলেন The Cantos লিখতে গিয়ে। দীর্ঘ কবিতার শিকড় মহাকাব্যের মধ্যে নিহিত থাকায়, দীর্ঘ কবিতার লেখকরা প্রায়ই তাঁদের দীর্ঘ কবিতাকে জাতীয় পরিচয়ে বা মানুষের একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর অংশ পরিচয়ে সাহিত্যে পরিণত করার জন্য তীব্র চাপ অনুভব করেন। আবার আমেরিকান কবির দীর্ঘ কবিতাটি ইউরোপিয়ান পূর্বসূরীদের চাপের মধ্যে থাকে। যেমন ওয়ার্ল্ড হুইটম্যানের Song Of Myself আমেরিকান পরিচয়ের বৈশিষ্ট্যের ধারণা অর্জন করেছিল। এইভাবে, লেখক যখন অনুভব করেন যে তাঁদের কাজ এমন একটি ক্যালিবারে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে বা অভিপ্রেত শ্রোতাদের মধ্যে একটি পরিবর্তনকে অনুঘটক করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন তাঁরা কবিতাটিকে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থতা বলে মনে করতে পারেন।
দীর্ঘ কবিতার কবিরা প্রায়ই সঠিক ফর্ম বা ফর্মগুলির সংমিশ্রণ খুঁজে পেতে লড়াই করেন। যেহেতু দীর্ঘ কবিতাকে একটি নির্দিষ্ট ফর্ম দ্বারা কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না, তাই সবচেয়ে কার্যকর ফর্মটি বেছে নেওয়ার মধ্যে একটি চ্যালেঞ্জ থাকে । তবে গদ্য এবং কঠোরভাবে গীতিকবিতার তুলনায় দীর্ঘ কবিতার ধারার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। দীর্ঘ কবিতা এবং অন্যান্য সাহিত্যের ঘরানার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট পার্থক্য হল: একটি দীর্ঘ রচনা সম্পূর্ণরূপে ছন্দে রচনা করার নিছক অসুবিধা। তবে দীর্ঘ কবিতায় শিল্পীকে মহান অর্থ সৃষ্টির জন্য একটি বৃহত্তর স্থান প্রদান করে। গীতিকবিতার সম্ভাব্য সংকীর্ণ ফোকাসের বিপরীতে একটি দীর্ঘ কবিতা মহাজীবনের প্রজ্ঞাকে শাশ্বত পর্যায়ে উন্নীত করে। অতীত ইতিহাসের গৌরবকে পুনরুজ্জীবন দান করে। একটি দীর্ঘ কবিতা শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী কবিতাকে অন্তর্ভুক্তই করে না, তার সংলাপ, গদ্য প্যাসেজ এবং এমনকি স্ক্রিপ্টিংও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।একজন পাঠক একটি দীর্ঘ কবিতা থেকে সমগ্র বিশ্বের দৃশ্য শোষণ করতে পারেন।
সুবোধ সরকার বহু দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন। সময় ও ইতিহাস ধারণ করে আছে তাঁর প্রতিটি কবিতায়। প্রতিবাদ থেকে আত্মক্ষরণের প্রবাহ নিয়ে কবিতাগুলি জেগে উঠেছে। তাঁর বহু কবিতা থেকে একটি কবিতা হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বারবার অভিঘাত তোলে। কিছুতেই ভুলে থাকতে পারি না। কবিতাটি হল 'মৃত্যুর আগে তুমি কাজল পরেছিলে'
কবির স্ত্রী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর ভয়ানক ব্যাধি ক্যানসারে মৃত্যুর পর কবিতাটি লিখেছিলেন।প্রকাশিত হয়েছিল
'দেশ' পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০১১-এর সংখ্যায়। কবিতাটি শুরু হয়েছিল এভাবে:
"তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচলে নদীর আত্মজীবনী লেখা রইল।
বিছানার নীচ থেকে কয়েক লক্ষ কর্কট
বিছানা-সমেত তোমাকে তুলে নিয়ে চলেছে মহাকাশযানে।
ম়ৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে তাও তুমি কাজল পরেছ,
কাজল ও কান্নার মাঝখানে তোমার মুখে এক চামচ জল
হ্যাঁ, আমি এক চামচ জল হয়ে
এক চামচ অন্তর্জলী হয়ে, এক চামচ অঞ্জলি হয়ে,
তোমার ভেতরে একটা পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া
বিমানবন্দরে আমি বসে থাকতে চেয়েছিলাম।
আমি বলেছিলাম এটা বিমানবন্দর নয়
এটা একটা গ্রাম, লোকে বিরহী বলে ডাকে
এখানেই আমরা জীবনে প্রথম চুম্বন করেছিলাম
তুমি ছিলে চাবুকের মতো তেজি এবং সটান
বেতস পাতার মতো ফার্স্ট ইয়ার এবং সেনসুয়াল কাঠবেড়ালি
বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে আন্তিগোনের মতো দেখাত।
আমি ছিলাম গাঙচিল,
দু’লাইন কাফকা পড়া অসংগঠিত আঁতেল।"
একটা মৃত্যু কতখানি মৃত্যুর উচ্চারণ রেখে গেল কবিতাটি তারই সাক্ষ্য প্রদান করছে। জীবন যে নদীর মতো, মৃত্যু যে সর্বময় আকাশের মতো, প্রেম যে অবিস্মরণীয় সর্বব্যাপী তা বুঝিয়ে দিলেন। আত্মজীবনের ছায়া পড়ল। নশ্বর জীবন কাব্যিক সুষমায় অবিনশ্বর রূপ পেল। দীর্ঘ জীবন নুয়ে পড়ল অসীমের প্রান্তভূমিতে । এ মৃত্যু যেন মৃত্যু নয়, জীবনের পুনর্নিমাণ। বেঁচে থাকার প্রতিধ্বনি। ইতিহাস ও সময়েরও, ব্যক্তির এবং নৈর্ব্যক্তিরও, নিজের এবং বিশ্বেরও কথা হয়ে উঠে এল। কবিতায় লিখলেন:
"ইরাকের মৃত্তিকাও অতবার ফুটো করেনি আমেরিকা
কিন্তু তোমার ধমনী আসলে একটা নদীর আত্মজীবনী"
উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকার ইরাকে পরমাণু বোমা অনুসন্ধান এবং ইরাককে ধ্বংস করার ইতিহাসের সঙ্গে, ক্যান্সার আক্রান্ত মল্লিকা সেনগুপ্তের চিকিৎসাও শরীর ধ্বংস করার নামান্তর। একটা জীবনকে বিস্ময়কর মহাব্যাপ্তির পর্যায় দান করেছেন। দীর্ঘ কবিতা তখনই মহাকাব্যিক পরিসর পেয়েছে। মল্লিকার শরীরের ধমনী হয়ে উঠেছে নদী। সেই নদীর প্রবাহই আত্মজীবনীর অক্ষর সাজিয়েছে। প্রাচুর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। শাশ্বতকালের অনন্ত দরজায় উপনীত হয়েছে। তাই কবি আবারও বলেছেন:
"আমাকে বাঁচাও, ভালবাসা, আমি বাঁচতে চাই।"
এই আকুলতা, সংসার, শিউলি গন্ধ, আকাশ, রোরো থেকে পারস্যের রানি আতোসা, ইস্তানবুলের নদী বসফরাস, এশিয়া ইউরোপ,জিপসিদের হাট, ইহুদি মেয়ে এবং সমগ্র মানবজাতি কবিতায় উঠে এসেছে।বিশ্ব ভ্রমণের নান্দনিকতায় নিজস্ব হাহাকার ও শূন্যতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। একটি নারীর হাত, একটি প্রেমের হাত, একটি সময়ের স্মৃতি, একটি হারানোর বেদনা সমস্ত মানুষের উপলব্ধিতে স্বয়ংক্রিয় রূপ পেয়েছে।
দীর্ঘ কবিতায় এভাবেই ব্যক্তিজীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে বহির্জীবনের দূরত্ব মাপতে থাকে। চেতনার তিনটি স্তরই স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। সামাজিক সত্তা আত্মসত্তার দ্বন্দ্বে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। চেতন মন বাস্তব জগতের হিসেবী বস্তুপণ্যের কথা বললেও অবচেতন মনে তা পৌঁছে যায়। অবশ্য তাকেও ছাড়িয়ে যায় অচেতনের দিকে। তখন ম্যাজিক রিয়ালিজম বা অ্যাবসার্ড কার্যকলাপেই তার সদগতি খুঁজে পায়। কবি মুক্ত করেন নিজেকে। সময়ের ধুলো ঝেড়ে মহাসমায়ের মহাশূন্যতায় নিজেকে ছেড়ে দেন। তখনই বিস্মিত হতে হয়। আমাদের চেনা পৃথিবীও পাল্টে যেতে থাকে। অনুভূতি আর কাজ করে না। যুক্তি-বিজ্ঞান কিছুই থাকে না সেখানে। শুধু সেই স্বয়ংক্রিয় এক ঘোরের চলন। সময়ের সীমানাও অতিক্রম করে। ব্যক্তিজীবনের ছায়াও উধাও হয়ে যায়। কবিতার এই রহস্যময় চলন থেকে পুনরায় কবি ফিরেও আসতে পারেন। মানবিক পৃথিবীর সন্ধান ও করতে পারেন। আত্মজিজ্ঞাসায় নিজের সম্মুখে দাঁড়াতেও পারেন। যে কবিতা তাঁর সময়ের উত্থানকে সূচিত করে, সেই কবিতা তাঁর জীবনের অন্ধকারের উৎসকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। কবিতা কোনো সমাধানের পথ নয়, প্রকাশ। পরিস্থিতির সমান্তরাল অভ্যন্তর থেকে আত্মউচ্চারণের প্রজ্ঞা। তাই দীর্ঘ কবিতার দীর্ঘ চলনে নদীরই সামঞ্জস্য সেখানে। নদী যেমন বহুধা বিস্তৃত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়, বহু বাঁক ধারণ করে, গতির তীব্রতা ও শ্লথকেও লালন করে, সেতুবন্ধনকেও সহ্য করে এবং ক্রমশ অগ্রসর হয়; দীর্ঘ কবিতাও তেমনি। তার তরঙ্গ, তার ধ্বস, তার বিভাজিকা, তার পূর্ণতা ও শূন্যতার মগ্নচড়া সমন্বিত সৌষ্ঠবকে নিয়ে প্রকাশিত হয়। কবিতায় শব্দের তরঙ্গ, উচ্চারণের কম্পন, ভাবের গাম্ভীর্য, গীতির কলস্বর, স্ফটিক ফেনরাশির ঔজ্জ্বল্য সবই সমর্থিত রূপ প্রাচুর্য। পাঠককে সাবধানে সেখানে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয়। প্রেমিক হতে হয়। সাঁতারু ও ডুবুরিও হতে হয়। এক রকমের ভালোবাসার ঘোরের ভিতর দিয়ে অনুসন্ধানী হতে হয়। চোখ খুলে এবং চোখ বন্ধ করে চলারও অনুশীলন করতে হয়। একটা সময়, একটা জীবন, একটা পৃথিবীকে—মহাসময়, মহাজীবন,মহাপৃথিবীর পথে খুঁজে পেতে হয়।
0 মন্তব্যসমূহ