হারাধন বৈরাগীর পাঁচটি কবিতা

হারাধন বৈরাগীর পাঁচটি কবিতা 


মা

মায়ের স্নেহে বড় হয়েছি/
মাকে নিয়ে‌ই স্বপ্ন এঁকেছি/ 
মাকেই জেনেছি বসুন্ধরা।/
প্রতিমা ঘরে আসতেই /
আমি হলাম দেশহারা।/ 

ভেদ করতে পারিনা কাঁটাতার/
ছুঁতে পারিনা নীলিমা।/
জানালা খুলেও বুঝতে পারিনা/ 
ঘরে কেমন আলোহাওয়া!/

বাবা

বাবার লেখাপড়া ছিল না/
বাবা যা পারলেন আমি পারলাম না।/
বাবা আগলে রেখেছিলেন ওম দিয়ে/
দিয়ে ছিলেন নিশ্চয়তার আলোহাওয়া।/

আমি দিতে পারলাম না/
রেখে  যাচ্ছি  আত্মজকে/ 
অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে/
প্রেসার,সুগার ও /
হাইপারটেনশনের নিশ্চিত অন্ধকারে।/


দেশহীনের কবিতা 

মহানবিজয়দিবসের জন্য /
আমার কোনো বুলেট নেই।/
মহানবিজয়দিবসের জন্য/ 
আমার কোনো আবেগ নেই/
মহান জন্মভূমির জন্য /
আমার কোনো বুলেট নেই।/
মহান জন্মভূমির জন্য /
আমার কোনো আবেগ নেই।/

জন্মভূমি দিয়েছে আমাকে অনিশ্চিয়তা/
পালানো আর পালানোর মারণখেলা/
কাঁটাতার আর কাঁটাতার,দুপারে দুইপা।/

একপারে আমার দাদুর গোরস্থান/
আরেক পারে দাদীর।/
দুপারে‌ই বহতা আমার গঙ্গা।/
এক গঙ্গায় ডুব দেই আরেক গঙ্গায় না।/

কাঁটাতারের জন্য‌ আমার কোনো কান্না নেই/
খানিকটা নিরাপত্তার হাওয়ায় গা ভাসাই।/

জন্মভূমির জল মাটি আবহাওয়া/
জন্ম দিয়েছে ছুতরাগাছ।/
কী বিষম জ্বালা!/
ভাই ভাইকে ভুলে গেছে/
বোন বোনকে,ভাই বোনকে,বোন ভাইকে!/

ভাই ভাইকে খুন করেছে/ 
ভাই ভাইকে ভিটে ছাড়া করেছে/
বোনকে‌ কুৎসিত ইঙ্গিতে তেড়ে এসেছে/
ধর্ষণ করেছে নিজেই নিজের আত্মাকে।/

কবিরা পারে।কবির বুলেট আছে।/
কবির আবেগ আছে।/
পাখি হয়ে উড়তে পারে নীল আকাশের গায়/
কাঁটাতার ভেদ করতে পারে এক লহমায়।/

আমার চোখে দুঃস্বপ্নের এক পাথরচাপারাত/
যে রাতে মা আমাকে বগলদাবা করে/
দাদুর কাছে দিদা, চোখের জলে বিদায় নিয়ে/

বাবার হাত ধরে একবস্ত্রে/ 
মেঘালয়ের ডাউকি হয়ে পা ফেলেছিল অচেনায়।/
আত্মজের নিশ্চয়তায়!/

আমি শিল্পী ন‌ই /
পারি না‌ দু’দেশের মাঝে/
সহীদসিঁড়ি বানাতে/
কাঁটাতার ভেদ করতে/
মঞ্চ আলো করতে/ 
হে মহান বিজয় দিবস!/ 
হে আমার মহান জন্মভূমি।/

কবিরা পারে।কবির কলম আছে।/
কবির বুলেট আছে।ভুলে যেতে পারে একলহমায়/
পূর্বজের ভিটেছাড়া জলাতঙ্ক গরুর দৌড়/
ভুলতে যেতে পারে দেশান্তরের মরিচঝাঁপি।/

দেশ আমাকে বানিয়েছে দেশহীন/ 
শরীরে ধারণ করছি রজ রক্ত ঘাম দ্বেষ বীর্য –/

দেশের জন্য কোনো আবেগ নেই আমার/
দেশের জন্য প্রেম নেই কোনো/
বুকে পাথর চেপে আছি/

আমি কবি ন‌ই/
কোনো রং নেই আমার/
শুধু একটাই রং,আমি দেশহীন।/

দেশের জন্য আমার কোনো উচাটন নেই/
দেশের জন্য আমার কোনো বুলেট নেই।/
আমাকে ক্ষমা করো সহীদ/
ক্ষমা করো দেশমাতা।/

আত্মজ

আমার ভেতরে ঘুম নেই /
বাইরে ঘুমের বনিতা করি।/
অনিশ্চয়তাযর মদে আপাদমস্তক/ 
ডুবে আছে আমার আত্মজ।/

আমার উষ্ণতা ক্রমশ শীতল হয়ে আসছে/
আমি তাকে দিতে পারছি না সুরক্ষাকবচ।/
প্রতি মুহূর্তে মনে হয় রেখে যাচ্ছি আমার/ 
আত্মজকে এক অন্ধকার বিসর্পের বুকে।/

আমার প্রস্থান হলেই পড়ে যাবে কালোগর্তে।/

আমার মদিরার ঘ্রাণ

দেওয়ালের ভেতরে থাকি/
ভেতরে ভেতরে আঁকিবুকি।/
আমার দমবন্ধ হয়ে যায়/
থেমে থেমে জল আসে।/
থেমে থেমে জলে ভাসি।/

দেওয়াল ছেড়ে জঙ্গলে যাই/
জল ছেড়ে যেন ডাঙ্গায় উঠি।/
আর জঙ্গলের শরীর থেকে /
ভুর ভুর করে ছড়িয়ে পড়ে /
বাতাসে,আমার মদিরার ঘ্রাণ।/

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ