বিমল চৌধুরী: ত্রিপুরায় বাংলা গল্পের ছয় দশক || কল্যাণব্রত চক্রবর্তী

বিমল চৌধুরী: ত্রিপুরায় বাংলা গল্পের ছয় দশক|| কল্যাণব্রত চক্রবর্তী

চল্লিশ দশকের আরম্ভ থেকে হিসেব করে ত্রিপুরায় বাংলা গল্পের চর্চা, লেখালেখি আজ প্রায় যাট বছরের। এর আগে ছিল এরাজ্যের রাজবাড়ি কেন্দ্রিক সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার রেওয়াজ। 'কিশোর সাহিত্য সমাজ' এর উদ্যোগে সাহিত্য-সাময়িকী' 'রবি' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৪ এ। রবীন্দ্রনাথ বার সাতেক রাজন্য আমলের রাজধানী আগরতলায় এসেছিলেন। কবির সফর এবং এখানে স্বল্পকাল বসবাস 'রবি' সাময়িকীর প্রকাশনায় উৎসাহ যুগিয়েছিল নিঃসন্দেহে। 'রবি' পত্রিকায় গল্প খুব কমই বেরিয়েছে (প্রয়াত দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিতবন্ধু দেববর্মা, সতীশ দেববর্মা প্রমুখর লেখায় বাংলা গল্পের প্রায় অস্পষ্ট এক রূপরেখা ফুটে উঠেছিল বলা যায়। এছাড়া হরিদাস চক্রবর্তী, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, আব্দুল মতিন, রাজ্যেশ্বর মিত্রসহ আরো কয়েকজনের লেখায় গল্প রচনার আভাস দেখা গিয়েছিল। বিধুভূষণ এবং আব্দুল মতিন মূলত কবি ছিলেন। তাঁদের কবিতায় আধুনিক নির্মাণের সূচনা হয়েছিল, একথা অনায়াসেই বলা যেতে পারে।

১৯৪০ এর গোড়ার দিক থেকে প্রায় ঘাট বছর ধরে ত্রিপুরায় বাংলা গল্প লেখায় এক অনন্য ও উজ্জ্বল উপস্থিতি বিমল চৌধুরী। সে সময়ে এখানে লেখালেখি প্রকাশের নানা সীমাবদ্ধতা, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, বিশ্বজুড়ে ফ্যাসীবাদী আক্রমণের আতঙ্ক, মন্বন্তর, দেশভাগ, ৪৬-৪৭ এর দাঙ্গা এবং গণহত্যা, আর সেই সঙ্গে পূর্ববাংলা থেকে অগণিত ছিন্নমূল শরণার্থীর এরাজ্যে আছড়ে পড়ার স্রোত, সব মিলিয়ে গল্প-উপন্যাস-সাহিত্য রচনায় বিচিত্র অনুভব এবং গভীর এক মানবিক সংবেদনের প্রেরণা এসেছিল বলা যায়। সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। এতো ক্ষিপ্র এই রূপান্তর যে, এই সময়ের নানা গ্রন্থির স্বভাবনিহিত জটিলতার সঠিক ও সমাজমনস্ক প্রতিফলন মোটেই
সহজ কাজ ছিলনা। ? ২২ বিমল চৌধুরী ১৯৪৬ এ'জাগরণ' নামে যে গল্প লেখেন, এর পরিণামে ত্রিপুরার ?

এক সরল আদিবাসী 'নগুরাই' এর রাজতন্ত্রের বিরোধিতায় এ সময়ের রণন অনুভব করা গিয়েছিল। পরে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইন্ধন বলে গণ্য হয়, এ-আশঙ্কায় আগরতলায় কোন সম্পাদক লেখাটি প্রকাশে রাজি হননি। বছর তিনেক বাদে প্রয়াত প্রভাত রায় তাঁর 'চিনিহা' সাপ্তাহিক গল্পটি প্রকাশ করেছিলেন।

পঞ্চাশের দশকে আরো ক'জন বিশিষ্ট গল্পকারের দেখা মেলে। এঁদের ক'জন স্বকীয়তায় চিহ্নিত হয়েছিলেন। সুখময় ঘোষ, সুবিমল রায়, রণেন্দ্রনাথ দেবের গল্প রচনায় ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পরেশ ভাদুড়ী, আনন্দময় রায়, চিদানন্দ গোস্বামী, বিভুল চৌধুরী, দেবল দেববর্মা প্রমুখ এ সময়ে গল্প রচনার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট নাম। পঞ্চাশ দশকের গল্পচর্চায় দু'টি ভিন্ন ধারা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত, একদা আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যে দেশভাগ পরবর্তী ব্যাপক বাঙালী উদ্বাস্তুর আগমন এবং দ্রুত গড়ে ওঠা উপনিবেশ যাতে এক বিশেষ মাত্রা জুড়ে দিয়েছিল, এক অংশের গল্পে এই বিন্যাস স্বার্থকভাবে ফুটে ওঠে। অন্য ধারাটি হচ্ছে, মূলত রোমান্টিক গল্পের ধারা যা মুখ্যত বাংলা গল্পের মূলস্রোতের অনুকরণেই বিকশিত। প্রথম ধারার গল্পে সমাজের অবহেলিত অংশের জীবন, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের টিকে থাকার লড়াই, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের কথা বিশেষভাবে উঠে এসেছে। রোমান্টিক গল্পধারায় মূল উপাদান ছোট শহর জীবন, কখনো সখনো কলকাতা পটভূমির গল্পও।

১৯৫৩ ইংরেজীতে আগরতলায় সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট আড্ডা 'সাহিত্যবাসর' গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় লেখালেখিতে এই মিলন ও পরস্পরের বিনিময় দশকের শেষপর্যন্ত প্রেরণা যুগিয়ে এসেছে। এই সময়ে স্থানীয় বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে যাঁরা লেখালেখি করেছেন, তড়িৎমোহন দাশগুপ্ত, সুনীলবন্ধু ঘোষ, তুষার সেন, অপরাজিতা রায়, করবী দেববর্মণ, অনিল মুখোপাধ্যায়, সুজাতা চৌধুরী, শুভাগত দাশগুপ্ত, সুপ্রসন্ন চক্রবর্তী, দুলাল ভট্টাচার্য, বিভূতি চক্রবর্তী, ননীগোপাল কর, যোগব্রত সেন, পূরবী দেববর্মণ এঁদের অন্যতম। পঞ্চাশ দশকের গল্পে নির্মাণের আঙ্গিক ও স্বরূপ বিষয়ে লেখকদের আগ্রহের অভাব চোখে পড়ে। গল্প ও ছোট গল্পের সীমানা অনেক সময়েই মিলেমিশে একাকার, যেন গল্প বলা হয়ে গেলেই লেখকের দায় শেষ।

পরবর্তী যাট-সত্তরের দশক গল্প রচনার ক্ষেত্রে এক বড়ো মাপের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। একদিকে গভীর সমাজমনস্কতা, গল্প বলার নিজস্বতা, নানামুখি নিরীক্ষায় আগ্রহ, বাংলা গল্পের মূলস্রোতের সমান্তরাল ভিন্ন ধারায় এগিয়ে যাবার আগ্রহ এই সময়ের গল্প রচনায় লক্ষ্যণীয় প্রবণতা হয়ে দেখা দেয়। এক তরুণতর লেখক গোষ্ঠী 'আসন্ন' গড়ে তোলেন। এই গোষ্ঠীর উদ্যোগে ১৯৬৩ ইংরেজীতে বেরোয় সমাজমনস্ক সাহিত্যপত্র "গান্ধার”। গান্ধারের প্রকাশ স্থায়ী না হ'লেও স্থানীয় লেখালেখিতে এর বিশেষ অবদান ছিল। দাগ রেখে গিয়েছিল, যা পরবর্তী তরুণদের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। এই সময়ের বিশিষ্ট গল্পকার হিসেবে দেখা দেন অনিল সরকার, ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য, মানস দেববর্মণ, কালিপদ চক্রবর্তী, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, অরুণোদয় সাহা, শক্তি দাস, বিচিত্র চৌধুরীরা। স্থানীয় সরকারী কলেজে পড়ানোর কাজ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও গল্পকার কার্তিক লাহিড়ী। তরুণ লেখকদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার কেন্দ্র। গল্প লেখায় হালফিলের রুচি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন মননের গ্রন্থনার কাজটি করে দিয়েছিলেন শ্রীযুক্ত লাহিড়ী। "গান্ধার" সাময়িকীতে তিনি নিয়মিত লিখতেন। ত্রিপুরার পটভূমিতে বড় মাপের সাহিত্য রচনার স্বপ্ন তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন তরুণতর লেখক প্রজন্মকে। আগরতলায় তিন দশকের বেশী লেখালেখি করেছেন কার্তিক লাহিড়ী। কলকাতার 'পরিচয়' এবং 'এক্ষণ' ছাড়াও বহু সাহিত্য, সাময়িকীতে ছড়ানো তাঁর গল্প এবং উপন্যাস। বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং গল্প সংগ্রহ তাঁর বেরিয়েছে কলকাতা এবং আগরতলার প্রকাশনী থেকে। সামাজিক রূপান্তরের লক্ষ্যে গভীরভাবে দায়বদ্ধ এই লেখক প্রতিবাদী বলিষ্ঠ চরিত্র নির্মাণে সাহস ও সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁর লেখায়। গল্প বলার টেকনিক নিয়ে নানা মাত্রায় বিচিত্র পরীক্ষা তাঁর লেখায়। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজ সম্পর্কের টানাপোড়েন, সঙ্কট এবং মানবিক উত্তরণের কথা তাঁর গল্পে।

যে কথা বলা হয়েছে, ত্রিপুরায় বাংলা গল্প লেখালেখির সূচনা বিগত চল্লিশ দশকের গোড়ার দিকে। সাহিত্য তখনও একধরণের মধ্যবিত্ত সৌখিনতার ব্যাপার ছিল। সাহিত্য বলতেই রবীন্দ্রনাথ। সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে, তারাশঙ্কর কিছু কিছু পড়া হ'ত এখানে সেখানে, এই মাত্র। জীবনানন্দের মৃত্যুর বেদনা তেমনভাবে ছুঁতে পারেনি এখানকার কবিদের, লেখকদের। দেশভাগ এবং এরপর ছিন্নমূল শরণার্থী নর- নারীর দলে দলে ত্রিপুরায় প্রবেশের বিষয়টি গল্প সাহিত্যের মরমী উপাদান হ'লেও এখানকার লেখালেখিতে তখনও এর তেমনভাবে প্রভাব পড়েনি। আগরতলা শহরের আশপাশে বিপুল সংখ্যায় উদ্বাস্ত শিবির গড়ে উঠেছিল। বহু পরিবার ভেঙ্গে গিয়েছিল দেশ ছেড়ে আসার টানাপোড়েনে। শিবির বাসের অপরিমেয় যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা। অকল্পনীয় দারিদ্র। শিবির জীবনে 'ক্যাশ ডোল', মহাজনের ঋণ, পতন, বিদ্বেষ, শত্রুতা যেমন ছিল, কিছু নতুন আশা, নতুন সম্পর্ক, নৈতিক- অনৈতিক প্রেম, বিবাহ, সবর্ণ, অসবর্ণ সবই তো ছিল, যা নিয়ে মানুষের জীবন। ত্রিপুরার লেখালেখিতে দেশভাগের এই বিপুল বেদনা আজো তেমন গভীর, গূঢ় ও সঞ্চারিত মাত্রায় উঠে আসেনি। এটা এ কারণে আক্ষেপের বিষয় যেহেতু পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় চলে গিয়েছে।

চল্লিশ দশকের গোড়ার দিক থেকে এ পর্যন্ত গল্প লেখায় তিনটি পর্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক, যাটের দশক এবং সত্তরের দশক থেকে এখন অবধি। লেখালেখির প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে যাটের দশকে ত্রিপুরায় বাংলা গল্পচর্চায় এক ধরণের নতুন মাত্রা যোগ হয়। এর আগে এখানকার গল্পে রিফিউজীর জীবন যন্ত্রণা, সমাজবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর নানা মাত্রার প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেলেও সামগ্রিকভাবে এ রাজ্যের জল মাটি মানুষের অবিকল সুখ দুঃখের কথা এমনভাবে উঠে আসেনি, যা যাটের দশকের এবং পরবর্তী সময়ের লেখায় সচেতন অনুশীলনের বিষয় হয়ে উঠেছিল। ত্রিপুরায় লেখা বাংলা গল্প বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের মূলস্রোতের অনুসারী হয়েও আজ যে স্বতন্ত্র ধারা ও উৎকর্ষের দাবীদার, সত্তর দশক এবং এর পরবর্তী সময়ের গদ্য শিল্পীদের সচেতন ও সমাজমনস্ক অনুশীলনেই তা সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যেই সার্থকতা এসেছে, এ কথা বলা না গেলেও, গল্পের চর্চা ক্রমশ সঠিক পথ চিনে নিয়েছে বলা যায়।

বিমল চৌধুরীর লেখালেখির প্রকাশ, এই শহরে এমন একটা সময়ে যখন এর থেকে বৈষয়িক পাওয়ার কিছু ছিল না। খ্যাতিও নয়, অর্থও না। লেখালেখির মূল্যায়ন, জনপ্রীতির জন্য যেটুক্ সামাজিক পরিবেশ দরকার, তেমনভাবে তখনো এই শহরে গড়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র সাহিত্যনিষ্ঠায় একটি আত্মপ্রকাশের আকাগুক্ষা এটাই ছিল প্রেরণা। চেষ্টা ছিল, লেখার ভেতর দ্রুত বদলে যাওয়া সমাজবোধকে নানা মাত্রায় তুলে আনা।

১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১০ শ্রাবণ (১৯২২ ইংরেজী) ঢাকার গেন্ডারিয়ায় বিমল চৌধুরীর জন্ম। বাবা যামিনীভূষণের বংশানুক্রমিক আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও ওষুধ তৈরী, সরবরাহের প্রতিষ্ঠান ছিল 'ঢাকা মহাশক্তি ঔষধালয়'। দেশভাগের পর সে প্রতিষ্ঠান আগরতলায় ১৪ নম্বর সেন্ট্রাল রোডে চলে আসে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বিমলদা'ই বড়। ঢাকায় জুবিলি ইস্কুলে ছেলেবেলায় পড়াশোনা। পরে সেখানে গ্র্যাজুয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করে কলকাতার আয়ুর্বেদ সারস্বত মহাবিদ্যালয়ে করেজি বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান। ১৯৪২ সাল। স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ গোটা পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন আগরতলায়।

গোড়ার দিকে কবিতা লিখতেন। ১৩ বছর বয়সে তাঁর লেখা কবিতা ঢাকায় তখনকার সাপ্তাহিক 'সোনার বাংলা'য় বেরিয়েছিল। সেই প্রথম। পিতা যামিনীভূষণ খুশী হয়েছিলেন। ছেলেকে উৎসাহিত করেছিলেন। 'সোনার বাংলায়' বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মতো খ্যাত কবিরা লিখেছেন একসময়। বিমল চৌধুরীর আগরতলয় বসবাস ১৯৪০ ইংরেজী থেকে। চল্লিশ দশকের দ্বিতীয়ভাগে তাঁর লেখা নিয়মিত বেরিয়েছে আগরতলায় 'চিনিহা', 'নবজাগরণ', 'সমীক্ষা', 'অভ্যুদয়' এবং পরবর্তী সময়ে 'ত্রিপুরা' এবং 'ত্রিপুরার কথা'য়। (যাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে এ রাজ্যের প্রায় সবক'টি নিয়মিত পত্রিকার সাহিত্যপত্রে এবং নানা লিটল ম্যাগাজিনে, সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর বহু লেখা বেরিয়েছে। বেশীরভাগ গল্প। মাঝেসাজে কবিতা কোথাও। ষাটের দশকে আগরতলায় অন্তত চার পাঁচখানা সাপ্তাহিকের প্রতিবছর শারদীয় সাহিত্য সংকলন বেরুত, যার প্রত্যেকটি রীতিমত উল্লেখযোগ্য মানের। সে সব সংকলনে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ড. শশীভূষণ দাশগুপ্ত, সোমেন্দ্রনাথ বসু, ড. সচ্চিদানন্দ ধর, বিষ্ণু দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, গোপাল হালদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্টদের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতে দেখেছি সে সময়ে। এ সমস্ত সংকলনে বিমল চৌধুরীর গল্প ছিল এক অপরিহার্য উপস্থিতি। বিমল দা'র গল্প লেখার আরম্ভ দেখা যায় সাপ্তাহিক 'নবজাগরণ' এর পাতায় ১৯৪৬-এ। পন্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা ও নুরুল হুদা সে সময়ে 'নবজাগরণ' সম্পাদনা করতেন। সত্তর-আশী-নবব্বুই এর দশকে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক নামী সাহিত্য-সাময়িকীতে বিমল চৌধুরীর গল্প প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে।

১৯৫৭ ইংরেজীর সেপ্টেম্বরে, মনে আছে পুজোর ঠিক আগে এক ঘটনাসূত্রে বিমলদা'র সঙ্গে পরিচয়। আমার তখন স্কুল ফাইন্যাল হয়ে গেছে। উমাকান্ত একাডেমীর পশ্চিম অংশে পুকুরপাড়ের লম্বা টিনের ঘরে এক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের মধ্যে দেবদাস গঙ্গোপাধ্যায়, চিদানন্দ গোস্বামীর কথা মনে আছে। সাংস্কৃতিক সমাবেশে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মহোদয় পৌরোহিত্য করেছিলেন। অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন পথিকা দেববর্মণ। কবিতা লেখার প্রতিযোগিতায় বিচারক বিমল চৌধুরী। আমার ভাগ্যে পুরস্কারের শিকে কি করে নেমেছিল মনে নেই, তবে কবিতাটি সভায় পড়তে বলায় আমার কেমন ঘাম দিয়েছিল সেটা মনে আছে। নার্ভাস হয়ে ভুলভাল পড়ে ফেলেছিলাম। পরেরদিন সকালে বটতলায় বাজারে গিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা। বাজার করে ফিরছিলেন। আমাকে বকেছিলেন স্যার। কথায় স্নেহের টান ছিল। বলেছিলেন, এ সময়ে কবিতার নিজস্ব পাঠরীতি আছে। এটা জানার বিষয়। বিমলবাবুর কাছে যেও, ভালো আবৃত্তি করেন, তোমায় ঠিক বুঝিয়ে দেবেন। সেই থেকে 'ঢাকা মহাশক্তি'তে কত অজস্রবার গেছি, ১৯৫৭ থেকে প্রায় ২০০০ অবধি, প্রায় রোজ। কোন কোনদিন সকালে বিকেলে। সম্প্রতি ঢাকা মহাশক্তি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বিমলদা'র বার্ধক্য, অসুস্থতার কারণে। সেখানে আয়ুর্বেদের তুলনায় আড্ডার এক্তিয়ার অনেক বেশী। ঘন ঘন ডবল হাফ চা। সেন্ট্রাল রোডের ওপাশে শীতলের দোকানের ময়লা পেয়ালায় যে চা আসতো তাতেও যেন চ্যবনপ্রাশের গন্ধ ছিল, দীর্ঘদিনের অভ্যাসে আমাদের সবারই ভালো লেগে গিয়েছিল। বিমলদা' খুব আড্ডা, স্বজন-বন্ধু প্রিয় মানুষ ছিলেন। কবিরাজ বললে অখুশী হতেন, আর কথাসাহিত্যিক বিমল চৌধুরী বললে শিশুর মতো প্রসন্ন হতেন। আড্ডার মূল বিষয় লেখালেখি, সাহিত্য, সাম্প্রতিক কবিতা, পাঠ-আবৃত্তি-কদাচিৎ গান, গুনগুনিয়ে। মহাশক্তির আড্ডায় কাকে দেখিনি, সেটাই হয়ত বলা মুস্কিল। বিমল দা' নিজেও ভরাট গলায় কবিতা বলতেন। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ড. নীলমাধব সেন, সোমেন বসু, কবি পূর্ণেন্দুবিকাশ ভট্টাচার্য, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, এম. এ. মতিন, ড. হিমাংশুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রণেন্দ্রনাথ দেব, সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ, নুরুল হুদা, হরিদাস চক্রবর্তী, পরেশ ভাদুড়িসহ আরো অনেককে মহাশক্তির আড্ডায় দেখেছি। ষাটের দশকের গোড়ায় তরুণদেরই ভীড় ছিল বেশী। শঙ্খপল্লব আদিত্য, প্রদীপ চৌধুরী, ভীষ্ণদেব ভট্টাচার্য, কালিপদ চক্রবর্তী, খগেশ ও মানস দেববর্মণ, কখনো অশোক দাশগুপ্ত, নকুল রায়, মিহির দেব, তপন দাশগুপ্ত, কার্তিক লাহিড়ী, বিজনকৃষ্ণ চৌধুরী, বাণীকণ্ঠ ভট্টাচার্য, আবার একটু ভিন্ন মাত্রায় ধবলকৃষ্ণ দেববর্মণ, প্রাঞ্জলকৃষ্ণ, শক্তি হালদার, অনাথকৃষ্ণ দেববর্মণ, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ত্রিপুরেশ মজুমদার, অনিলচন্দ্র ভট্টাচার্যসহ অনেকেই শীতলের কব্রেজি গন্ধমাখা ডবল হাফ খেয়েছেন নিয়মিত। আড্ডা জমে গেলে রোগী এলেই বিষণ্ণ হতেন বিমল চৌধুরী। বলতেন, আজ শুধু অবলেহ নিয়ে যান। রবিবার দুপুর নাগাদ এলে রোগের বাকি সব বিবরণ শুনবো। এই করে করে মহাশক্তি ঔষধালয়ে রোগী দেখার ব্যাপারটাই শিকেয় উঠে গিয়েছিল। দূরের গ্রাম থেকে রোগীরা আসতেন। অনেকে গরীব মানুষ। রোগী ফিরিয়ে দিলে খারাপ লাগতো। নিজেদের নিমিত্ত ভেবে খুব অস্বস্তি লাগতো। আড্ডার নীট ফলের মধ্যে এটুকই, বহু সাহিত্য সাময়িকীর জন্ম, কবিসভা, পাঠ-আবৃত্তির অনুষ্ঠান চূড়ান্ত হয়েছে, অথবা বাতিল হয়েছে মহাশক্তিতে বসে শলাপরামর্শ করে। নতুন লেখা হ'লে বিমলদা যেমন আমাদের পড়ে শোনাতেন, বললে কিছু কিছু অদলবদলও করতেন লেখায়, নতুন কবিতা লেখা হ'লে বিমল চৌধুরীকে না শোনানো পর্যন্ত মনে হ'ত কিছুই হয়ত হ'ল না। এভাবে, ত্রিপুরায় লেখালেখি নিয়ে যখনই যা কিছু হয়েছে, আন্দোলন - আলোচনা-সমাবেশ, যা ই কিছু, বিমলদা' সবকিছুতে নিজেকে জড়িয়ে দিতেন। ষাটের দশকে অনিল সরকার, নিধুভূষণ হাজরার যৌথ সম্পাদনায় 'উত্তরণ' সাহিত্যপত্র প্রগতিশীল ও সমাজমনস্ক লেখালেখির ক্ষেত্রে এক নতুন ধারার দিশারী হয়ে ওঠে। 'উত্তরণ' এর সময়বাঞ্ছিত ভূমিকা বিষয়ে মোটামুটি এক দীর্ঘ আলোচনা আমাদের সাময়িকীতে ছাপতে দিয়েছিলেন বিমল দা'।

রোমান্টিক, ভাবুক গোছের মানুষ। জীবনের শেষ অবধি এই রোমান্টিকতায় টান ধরেনি। যে সব বাস্তব অভিজ্ঞতা, ধারণা, পদ্ধতি জানা থাকলে মানুষ 'সংসারে সুখী' হয়, বিমলদা সে সম্পর্কে কোনকালেও আগ্রহ দেখান নি। রোদে মেঘে বেলা বয়ে গিয়েছে। সংসারে বাস্তব জ্ঞানের অভাবে নানাভাবে দুঃখ পেয়েছেন। আসলে, চারদিকের সমাজ পরিপার্শ্ব কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে তা সঠিক পরিমাপ করে চলতে চান নি বলে যন্ত্রণা আরো বেড়েছে। জীবনের শেষের দিনগুলিতে প্রিয়জন বিয়োগের শোকও পেয়েছেন। শেষ বয়েসে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়েছিলেন এক বছরের বেশী। বলতেন, আমি আর যদি দেখতেই না পাই, পড়তে লিখতে না পারি তবে আর কি হবে বেঁচে থেকে। চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে কলকাতায়, গৌহাটিতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসাও হয়েছিল। কিন্তু তেমন কাজ হয়নি কিছুতেই। ত্রিপুরার জীবন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছে ছিল। খানিকটা কাজ আরম্ভও করেছিলেন। কিন্তু চোখের আলো চলে যাওয়ায় ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায় শেষপর্যন্ত।

তাঁর নিজের কথায়, এ অবধি কম তো আর দেখিনি, যুদ্ধ দাঙ্গা দেশ ভাগ, আকালও দেখেছি, মানুষের ছিন্নমূল জীবনযন্ত্রণা অনুভব করতে চেয়েছি গভীরভাবে। যা দেখেছি, এর ছিটে ফোটাও লিখে উঠতে পারিনি। ত্রিপুরার মানুষ আমায় অনেক ভালোবাসা, স্নেহ দিয়েছেন। সাধ ছিল হাত পা ছড়িয়ে লিখবো ত্রিপুরার কথা। চোখের দৃষ্টি হারিয়ে আমার সব শেষ। মানুষের কাছে এই ঋণের বোঝা, আমাকে বড় অস্থির করে তোলে মাঝে মাঝে।

গল্প-কাহিনীতে বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশ নির্মাণে এই লেখকের এক অসামান্য ক্ষমতা ছিল, যা উপন্যাস রচনায় সাধারণতঃ খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। চল্লিশ - পঞ্চাশ -ষাটের দশকের ত্রিপুরায় সামাজিক রূপান্তরের ধারাবাহিকতা, মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধ, দিন যাপনের লড়াই, মানুষের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা, সময় ও সমাজ প্রেক্ষিত অসামান্য বিশিষ্টতায় উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। তাঁর লেখায় ত্রিপুরার মাটি মানুষ নিসর্গ চেতনায় জারিত হয়ে অন্যমাত্রা পেয়েছে। এ রাজ্যের বঞ্চিত উপজাতি জীবন নিয়ে তিনি স্বার্থক সাহিত্য রচনা করেছেন। অন্যদিকে দেশভাগ এবং ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনের বেদনা গভীর সংবেদনে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনায়।

বিমল চৌধুরীর প্রথম গল্প সংগ্রহ 'মানুষের চন্দ্র বিজয় ও তারানাথ' পৌণমী প্রকাশন বের করেন ১৯৭৩ এ। দ্বিতীয় গল্প সংকলন 'ভগীরথের তালা' ১৯৯৭ এ প্রকাশিত হয় কবি কৃত্তিবাস চক্রবর্তী ও কাকলি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশেষ উদ্যোগে। বিমল চৌধুরীর লেখা 'তির ও তরঙ্গ', 'জাগরণ', 'হিজল খালের কান্না', 'অনুভাব', 'মানুষের চন্দ্র বিজয় ও তারানাথ' মানুষের প্রতি গভীর অঙ্গিকারে অসামান্য। তাঁর গল্পে নানা বিচিত্র বিষয় এবং পটভূমি। গল্পের মেজাজ মতো নিজস্ব ভাষা নির্মাণেও তাঁর কৃতিত্ব। আধুনিক বাংলা গল্পের যা বিশেষ লক্ষণ। গল্প বলার পদ্ধতি থেকে ভাষাকে আলাদা করে নিয়ে বিচার করা যায় না। উভয় ধারাই এক গভীর অন্বয়ে পরস্পর সম্পৃক্ত। কিছু কিছু গল্পে তিনি স্বার্থক প্রতিক এবং চমৎকার সঙ্কেত ভাষা ব্যবহার করেছেন। তাঁর গল্পে সংযম এবং পরিমিতির বোধ রচনাকে শিল্পকুশল করেছে। ঋজু ও মননজাত তাঁর ছোট গল্প যা বড়োর ব্যঞ্জনা পেয়ে যায়।

বিমল চৌধুরী ত্রিপুরায় প্রথম রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত লেখক। 'গুয়াহাটি কালচারেল ফোরাম' গত ২০০১ ইংরেজীর ১৫ আগস্ট গৌহাটিতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন। 'জলছবি' ও 'পুনশ্চ' প্রকাশন তাঁকে সম্বর্ধনা জানান ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ ইংরেজীতে। ১৯৯৪ ইংরেজীতে আগরতলায় অনুষ্ঠিত উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কার্যকরী সভাপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করা হয়েছিল। কমিটির মূল সভাপতি ছিলেন ককবরক সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক সুধন্ব দেববর্মণ। বিমল চৌধুরী রাজ্যের গণতান্ত্রিক কলাকুশলী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন।

দাঙ্গা, ফ্যাসিবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে, শান্তির মিছিলে বার বার তাঁকে পদযাত্রায় দেখেছি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ শিল্পী লেখকদের আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের সমর্থনে একটু ভিন্ন চেহারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয় আগরতলায়, রাজ্যের অন্যত্রও।এ আন্দোলনের সামনেও তিনি ছিলেন, যেভাবে রুগ্ন শরীরেও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংহত প্রতিবাদের পদযাত্রায় তিনি বেরিয়ে এসেছেন রাজপথে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ