মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে কিছু কথা /অলোক বিশ্বাস

সম্প্রতি বীজেশ সাহা সম্পাদিত কৃত্তিবাস পত্রিকায় সদ্য প্রয়াত কবি ও গদ্যকার মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে আমার এই লেখাটি প্রকাশিত হয়ছে। যাঁরা হাংরিয়ালিস্ট ও পোস্টমডার্ন সন্দর্ভের এই আভগার্দ লেখককে চেনেন এবং যাঁরা চেনেন না, তাঁদের সকলের প্রতি নিবেদিত এই লেখা। পড়ুন এবং আপনার প্রতিক্রিয়া লিখুন সযত্নে।

মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে কিছু কথা /
অলোক বিশ্বাস

আপাত শান্ত, ভেতরে অশান্ত, বহুমুখী সন্দর্ভে প্রবাহিত লেখক ও চিন্তক মলয় রায়চৌধুরী। দক্ষিণ কলকাতায় নাকতলার একই বাড়ির একতলায় বসবাসকারী অন্য এক মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে নিজের পার্থক্য রাখতে দোতলায় মলয়দা নিজের নামের আগে 'কবি' শব্দটা লিখে রেখেছিলেন। আমি যেদিন প্রথম গেলাম, আমার জানা ছিল না বলে, লেটারবক্স পাড়ার একটি বাড়ির প্রথম তলার দরজায় কলিং বেল বাজাতেই, দ্বিতীয় তল থেকে গম্ভীর গলা ভেসে এলো, ওপরে উঠে এসো। মলয়দার গম্ভীর কণ্ঠ। ওপরে উঠে আমার চক্ষু চড়কগাছ। সেখানেও দরজায় লেখা মলয় রায়চৌধুরী, অবশ্য তার আগে একটা শব্দ, 'কবি'। বুঝে গেলাম, একই বাড়িতে থাকেন দুই মলয় রায়চৌধুরী। ব্যস, দু'চার মিনিটেই মনে হলো, মলয়দা আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত মানুষ। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে, তাহলে হাংরি সম্পর্কে আপনার এখনকার বোঝ-বোঝান্তি কেমন ? আবার কি হাংরি আন্দোলন শুরু করতে ইচ্ছা হয় না ? সেই পরিবেশও কি আছে ? আপনি কি এখনো স্বপ্ন দেখেন, তরুণ কবিরা কোথাও আবার হাংরি আন্দোলনের মতো কোনো আন্দোলন শুরু করুক ? আচ্ছা ধরুন, একটা চ্যালেঞ্জ নিতে বলা হলো আপনাকে, ঠিক এই নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে আবার হাংরি আন্দোলন শুরু হোক, আপনি কিভাবে নেবেন, অথবা ঝাঁপিয়ে পড়বেন কিনা। গোটা কয়েক প্রশ্ন শুনে, মলয়দা বললেন, তুমি কি কোমর বেঁধে এসেছো ? কিছুক্ষণ চুপ ক'রে থাকার পর, মলয়দা বললেন, আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাবো। এখানে ভালো লাগছে না। তাছাড়া, কলকাতায় প্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। মুম্বাইতে একটা ফোন দিলেই, ঘরে বসে যেকোনো জিনিস পেয়ে যাই। আর এখানে এই বয়সে তিনতলা থেকে নেমে বস্তুসামগ্রী কিনে আনার ক্ষমতা বিশেষ নেই। আমি বললাম, মলয়দা, আপনার কাছে কয়েকটা বিষয় জানতে চেয়েছিলাম, আপনি অন্য প্রসঙ্গে চলে  যাচ্ছেন। ঠিক আছে, বলছি, বলছি, তুমি তো হুইস্কি খাচ্ছই না। দ্যাখো, আমি আর হাংরি সম্পর্কে কিছু ভাবছি না। হাংরি ইতিহাস আমাকে এখন আর হন্ট করে না। তো নতুন করে সেই আন্দোলন শুরু করার প্রশ্নই উঠছে না। হাংরির মতন আন্দোলন কেবল নয়, আর কোনো আন্দোলনই সম্ভব নয়, অনুপম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরে একটি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন। দু'এক জায়গায় কিছু লেখক/কবি নতুন ক'রে এই বিষয়ে উন্মাদনা দেখালেও, সেই অতীত পরিসরটা তারা কোথায় পাবে ? আমার ঘরে যেসব বইপত্র আছে, হাংরি বিষয়ক কিছু আমেরিকান বইপত্রও আছে, আমি কেউ চাইলে সব দিয়ে আবার মুম্বাই ফিরে যেতে চাই। তবে ছেলের বিয়ের বৌভাতের একটা অনুষ্ঠান এখানে ক'রে যেতে হবে। তোমাকে আসতে হবে সেই অনুষ্ঠানে। আমি মলয়দার ছেলের বৌভাতে নাকতলায় গেছিলাম। মলয়দা বারবার বলছিলেন, বেশি ক'রে খাও, বেশি ক'রে খাও। বেচে যাওয়া সব খাবার কেটারার ফেরত নিয়ে যাবে।
##
না, হাংরি নিয়ে মলয়দার কোনো অবসেশন ছিল না। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আর কথাও বলতেন না। যদিও হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে যাকিছু লিখে গেছেন, সেগুলো গবেষণার বিষয় হয়ে গেছে। একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম যেটা ২০১০ সালে লালগোলা থেকে 'কালগাড়ি' নামে একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে হাংরি আন্দোলনের প্রায় ৪৫ বছর পর তিনি বলছেন--- 'কোনো আন্দোলনই আর সম্ভব নয়। আবিষ্কার ও প্রযুক্তির দ্রুতির কারণে ব্যক্তির বহুমাত্রিক আত্মপরিচয় আমাদের কৌম-সমাজকে অত্যন্ত পরিবর্তনশীল ক'রে দিয়েছে। ষাটের যুগে একদশকে যে রদবদল সমাজ ও সংস্কৃতিতে আকার লাভ করতো, তা এখন এক সপ্তাহে ঘটে যায়। লেখা প্রকাশের মঞ্চ এবং নিজের পত্রিকা প্রকাশ ও বিতরণ করার আর্থিক সামর্থ্য  না থাকায় হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত হতো হ্যান্ডবিলের আকারে, একফালি কাগজে যা আজকের দিনে অচিন্ত্যনীয় ; এখন তো প্রায় ১৫০০ লিটল ম্যাগাজিন কেবল এই বাংলায় প্রকাশিত হয়'। হাংরি আন্দোলনের অধ্যায় ছিল মাত্র পাঁচ বছর। এরপর পশ্চিমবঙ্গে মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী পার্টিগুলোর মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব, প্রধান কমিউনিস্ট দলের ভাঙ্গন, নকশাল আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন দমন, কংগ্রেস দলের স্বৈরাচারী রূপ ধারণ, সিদ্ধার্থশঙ্করের আমলের ব্যাপক পুলিশি অত্যাচার, পাড়া ভার্সেস পাড়া  ব্যাপক বোমাবাজি, প্রকাশ্য দিবালোকে যত্রতত্র খুন, হেমন্ত বসু হত্যাকান্ড, বরানগরে নকশাল সন্দেহে যুবকদের হত্যা ক'রে গঙ্গায় লাশ ভাসিয়ে দেওয়া, ১৯৭৫ সালের জরুরী ব্যবস্থা জারি এবং ১৯৮২ সালে পুনরায় বিপুল জনসমর্থনে বামপন্থীদের বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে সরকার গঠন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ভাঙ্গন, চীনের যুব সমাজের মধ্যে সরকার বিরোধী গণআন্দোলন থেকে শুরু ক'রে ব্যাপক অস্থিরতার কালখণ্ডে হাংরি আন্দোলনের বা অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে কারও মাথা ঘামানোর সুযোগ ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা হাংরি আন্দোলনকারীরা সেই আন্দোলনের পর থেকেই পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং রাস্তাবদল। কবি মলয় রায়চৌধুরীও বেপাত্তা দীর্ঘ সময়কালে। তাঁর পুনরুত্থান ঘটে আবার নয়ের দশকের শুরু থেকে। এমনিতেই তিনি তেমন কোনো মঞ্চে বা সাহিত্য সভায় যেতেন না। প্রভাত চৌধুরী সম্পাদিত 'কবিতাপাক্ষিক' প্রকাশের পর দেখেছি মলয়দাকে 'কবিতাপাক্ষিক'-এর কোনো কোনো সভায় উপস্থিত থাকতে। কিন্তু বাংলা একাডেমি সহ অন্য কোনো মঞ্চে কখনো মলয়দাকে উপস্থিত থাকতে দেখিনি। দেখিনি কোনো পুরস্কার বা মেমেন্ট হাতে তুলে নিতে। নয়ের দশক থেকে বরং মলয়দা মজে উঠলেন পোস্টমডার্ন কালচারে। ভাষাতাত্ত্বিক প্রবাল দাশগুপ্ত পোস্টমডার্ন-এর বাংলা করলেন 'অধুনান্তিক'। দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে মেতে উঠলেন অধুনান্তিক সন্দর্ভ বিষয়ে একের পর এক রচনায় এবং একই সঙ্গে নিরন্তর গল্প উপন্যাস আর হাংরি সময়কালীন ভাষা উত্তীর্ণ পোস্টমডার্ন কবিতায়। 'আন্দোলন' শব্দটাকে ব্যবহারের পরিবর্তে 'আলোড়ন'  শব্দকে পছন্দ ক'রে নিলেন। পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা সম্পর্কে পূর্বোক্ত সাক্ষাৎকারে বললেন--- 'সময় ও পরিসর কবিতাকে প্রভাবিত করে, নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হয়, সেই বৈশিষ্ট্যগুলো কবিতাতেও চলে আসে, যে কারণে সময় অনুযায়ী কবিতা পরিবর্তিত হতে থাকে। এখনকার কবিরা ওই বৈশিষ্ট্যগুলোকে এক-একটি নামকরণ করেছেন : পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা ওইরকম নামকরণ। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে RUBRIC, বাংলায় এর সঠিক প্রতিশব্দ নেই। কবিরের ক্ষেত্রে পোস্টমডার্ন হলো RUBRIC' ।
##
সময়, আন্দোলন, তত্ত্ব, বিষয়, আধুনিকতা--- এইসব শব্দের ব্যবহারের পরিবর্তে তিনি ব্যবহার শুরু করেছিলেন কালখণ্ড, আলোড়ন, সন্দর্ভ, পরিসর, অধুনান্তিকতা ইত্যাদি। সৃষ্টি, সৃজন, পুরস্কার, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিষয়গুলোর সঙ্গে তাঁর বিরোধ ছিল নিরন্তর। 'একাকার', 'বহুরৈখিকতা', 'রাইজোম্যাটিক' শব্দগুলোকে খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু দশকওয়ারী বিভাজন মানতেন না। এই বিষয়ে বরাবরই আমার সঙ্গে মলয়দার তুমুল তর্ক বাঁধতো। আজীবন প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানসিকতা টানটান রেখে গেছেন মলয়দা। তবে আমার বারবার মনে হতো, নিজের স্ট্রিমের লেখক কবিদের লেখা ছাড়া অন্য কোনো স্ট্রিমের লেখক কবিদের লেখা তিনি পাত্তা দিতেন না বা পড়তেনও না। এমনকি পঞ্চাশ ষাট সত্তর আশি দশকের কবিদের সম্পর্কে তাঁর কোনো আলোচনাধর্মী লেখা আমি দেখিনি। কিন্তু সমীরদার কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ের কবিদের কবিতা বিষয়ে মতামত পাওয়া যেতো, যেটা মলয়দার কাছ থেকে কথোপকথনের সময়েও সেভাবে পাওয়া যেতো না। আমি এটাকেও একপ্রকার প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত করলে মলয়দা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, যা কিছু আপডেটেড লেখালেখি হচ্ছে তার সবটাই কোনো-না-কোনোভাবে অধুনান্তিক সন্দর্ভের সঙ্গে জড়িত বা উৎসারিত। এই বিষয়ে আমার সঙ্গে মলয়দার তর্ক বাঁধতো। মনে হতো, মলয়দা যাকিছু পোস্টমডার্ন নয় তাঁর মতানুসারে, সেগুলোকে সাহিত্য আখ্যা দিতে রাজি নন বা তাঁর টেবিলে এন্ট্রি দিতে রাজি নন। প্রভাত চৌধুরী এবং বারীন ঘোষালেরও ছিল এই রোগ, যে রোগে আক্রান্ত ছিলেন না সমীর রায়চৌধুরী। উল্টোদিকেও দেখেছি, একটা বড়ো অংশের আবহমান ধারার কবিরা, লেখকরা মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে একেবারে নেগেটিভ কথা বলে যাচ্ছেন, এমনকি তাঁর কবিতা, কবিতা নয় বলেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। হাংরি ও পোস্টমডার্ন কবিদের লেখা সম্পর্কে আবহমান ধারার বিশ্লেষণকে আমি কোনদিন প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। আবার আবহমান কবিদের কবিতা সম্পর্কে প্রভাত চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী বা বারীন ঘোষালের মতামত সম্পর্কে আমার ভাবনার তীব্র পার্থক্য জানিয়ে দিতে দ্বিধা করতাম না বলেই একটা সময় এঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের স্বাভাবিকতায় বেশ দ্বান্দ্বিক রূপ ধারণ করেছিল। একই সাথে যাঁরা মাঝেমাঝেই বলে থাকেন, মলয় রায়চৌধুরী, প্রভাত চৌধুরী এবং বারীন ঘোষাল বাংলা কবিতার ক্ষতি ক'রে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি আদৌ একমত নই, এবং যাঁরা এরকম মন্তব্য করেন, তাঁরা আদৌ মলয়দা বা প্রভাতদা বা বারীনদার লেখা সেভাবে পড়েছেন কিনা আমার সন্দেহ হয়।
##
আমি মলয় রায়চৌধুরীর সহনশীলতার যথেষ্ট পরিচয় পেয়েছি। একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতেই হচ্ছে। মলয়দা একবার ত্রিস্তান জারার কবিতার কিছু বাংলা অনুবাদ গ্রন্থাকারে 'কবিতা ক্যাম্পাস' থেকে প্রকাশ করতে চেয়ে আমাকে একটি চিঠি লেখেন, কিন্তু চিঠিটা আমার ঠিকানার পরিবর্তে কবিতা ক্যাম্পাসের তৎকালীন কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়েছিলেন। মলয়দা কোনো ভুল করেননি। কিন্তু এক বিশেষ ব্যক্তির ঠিকানায় আমার নামেই চিঠি পাঠানো হলো কেন, কারও কারও এরকম ক্ষোভ প্রকাশের পর, কবিতা ক্যাম্পাসের সঙ্গে যুক্ত দু'একজন চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু ক'রে দেয় যে, একজন হাংরিয়ালিস্টের বই কোনোভাবেই কবিতা ক্যাম্পাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা যাবে না। আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, কবিতা ক্যাম্পাসের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্ব সেদিন বারীন ঘোষাল রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করেছিলেন। আমি মলয়দাকে সমস্যার কথাটা বললাম। কিন্তু মলয়দা কোনোভাবেই বিরক্ত হলেন না বা রাগ অভিমান প্রকাশ করলেন না। বললেন যে, ত্রিস্তান জারার কবিতা সম্পর্কে সম্ভবত ওরা না জেনেই বিরোধিতা করেছে। পরে 'কবিতা ক্যাম্পাস' থেকে সমস্ত ফালতু বিরোধ উপেক্ষা করেই মলয়দার একটি কবিতার বই প্রকাশ করলে মলয়দা খুব খুশি হয়েছিলেন। মলয়দা মনে করতেন, একজন লেখক বা কবির বই বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হওয়া দরকার এবং সেখানে কোনো কপিরাইট থাকবে না। যে কেউ পরে ইচ্ছা করলে সেই টেক্সটকে ব্যবহার করতে পারবে। পুনরায় প্রকাশ করতে পারবে।
##
২০০০ সাল নাগাদ অতি তরুণ কবি, যাকে লেট-এইটিজ কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, দিল্লির অধিবাসী সেই কবি দীপঙ্কর দত্তর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন মলয়দা। আমরা সাধারণত দেখি যে, তরুণ বা অনুজরা অগ্রজের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। পোস্ট কলোনিয়াল এসথেটিক্সের এটাই নিয়ম, যা চলে আসছে বহুকাল ধরে। মলয়দা সেটা একেবারে উল্টে দিয়ে কবি দীপঙ্কর দত্তর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন, সেখান থেকে কিছু উল্লেখ করলে মলয়দার মানসিকতার কিছু পরিচয় পাবো আমরা--- 'বুঝলে দীপঙ্কর, যতো দিন যাচ্ছে, কলোনিয়াল ইসথেটিক্স থেকে ছাড়ান্ পাবার বদলে, বাঙালিরা আরো বেশি করে সেই মাকড়সার জালে জড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে। এই জালের সঙ্গে মিশেছে এককালের সোভিয়েত দেশের বঙ্গীয় ঝুল। তাই তোমার একটা সাক্ষাৎকার নেবার তোড়জোড় করছি শুনে অনেকেই ঘাবড়ে গেছে। তুমিও দেখছি বেশ অবাক হয়েছো। এই ধরণের প্রতিক্রিয়ার কারণটা কিন্তু অতি সরল। ইউরোপের সরবরাহ করা ঔপনিবেশিক অনুশাসনে, সময়ের অনুক্রম একরৈখিক। অর্থাৎ আমার পরে তুমি জন্মেছো, আমার তুলনায় তুমি খ্যাতি বা কুখ্যাতি এখনো পর্যন্ত তেমন যোগাড় করতে পারোনি, তাই তোমার উচিত আমার সাক্ষাৎকার নেয়া, নানা প্রশ্ন তোলা, যার জবাব আমি খ্যাতিমান অগ্রজ সেজে নাক ফুলিয়ে দেবো। তত্ত্বটা এখনও অব্দি আছড়ে ভেঙে ফেলা হয়নি কেন, সেটাই আশ্চর্য। ইউরোপের অনুশাসনগুলো, ম্যাকলের দৌলতে, রেনেসাঁসি ব্রাহ্মদের আদর খেয়ে হিন্দু মূল্যবোধের জায়গায় দিব্বি চাড়িয়ে দিতে পেরেছিল খৃষ্টধর্মীদের আলোকপ্রাপ্তির তত্ত্ব-তেউড়। আফ্রিকার দেশগুলোয় দ্যাখো, ইউরোপ বিদেয় হতেই ওরা কলোনিয়াল ইসথেটিক্সকে লাথিয়ে বের করে দিয়েছিল। আমাদের এখানে ইংল্যান্ডিনী-প্রেমী জহোরলাল নেহেরু আর ইংল্যান্ড-প্রেমী জ্যোতি বসুরা সুযোগই দিলেন না যাতে আমরা ফ্রানৎস ফ্যানন-এর মতন ক্রুদ্ধ, এডওয়ার্ড সাঈদ-র মতন ঘৃণাকারী, ওলে সোইঙ্কা-র মতন মতবিরোধী, এলেচি আমাদি-র মতন প্রান্তিক, নগুগি ওয়া-থিয়ঙ ও-র মতন আক্রমণকারী ভাবুক-লেখক-কবি পাই। আমার আর্গুমেন্টটা ফলো করছো তো ? ঠিকমতন ফলো না করলে, কেন তোমার ইন্টারভিউ নিচ্ছি, সেটা ক্লিয়ার হবে না'।  আমি জানি না, অগ্রজ কবি মলয় রায়চৌধুরী ছাড়া একজন তরুণ কবির সাক্ষাৎকার কেউ কোথাও নিয়েছেন কিনা। হ্যাঁ, কবি বারীন ঘোষালকেও দেখেছি একবার একজন অনুজ কবির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিতে জামশেদপুরে বসে। উভয় ক্ষেত্রেই আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম, প্রথমটি পরোক্ষে আর দ্বিতীয়টি প্রত্যক্ষভাবে।
##
একটা বড়ো গুণ ছিল মলয়দার। কেউ কোথাও অন্যরকম লিখলে, তার নাম চাউর ক'রে দিতেন জনে-জনে। কেউ কোথাও ভালো ম্যাগাজিন করলে, সেই ম্যাগাজিনের নাম-ধাম জনে-জনে বলে বেড়াতেন। কারা কোথায় প্রথা বিরোধী লেখা লিখছেন খোঁজ রাখতেন আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচক সমালোচকের ঠিকানায় পত্রিকা ও বই পাঠিয়ে দিতে বলতেন। আসামের একজন অধ্যাপক বিষ্ণুচন্দ্র দে মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। আমাকে তাঁর এবং আরও কিছু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচকের ঠিকানা দিয়েছিলেন ফোন ক'রে। মলয়দা তাঁর লেখায় স্ল্যাংসম ভাষা বা লুম্পেনদের চালচলন ব্যবহার করলেও, আমি কোনোদিন তাঁকে মৌখিকভাবে খিস্তিখেউর করতে দেখিনি। অত্যন্ত মার্জিত ভাষা ব্যবহার করতেন কথা বলার সময়। সমীর রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রেও দেখেছি, মার্জিত ভাষার ব্যবহার। তবে মলয়দার লেখায় আছে প্রচুর তথাকথিত ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া হুলিগানিজমের ভাষা, যা সমীর রায়চৌধুরীর লেখায় একেবারেই দেখা যায় না। অবশ্য তাঁর কবিতা, উপন্যাস ও গল্পের বইয়ের নামকরণে দেখতে পাওয়া যায় অদ্ভুত ভাষা। তাঁর একটা গল্পের বইয়ের নাম 'ছোটলোকের ছেলেবেলা', একটা কবিতার বইয়ের নাম 'মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো', একটা উপন্যাসের নাম 'ভিড়পুরুষ ও নরমাংসখোরদের হালনাগাদ'। নয়ের দশকের পর থেকে এক নাগাড়ে লিখে গেছেন। অদ্ভুত সব ফর্ম ব্যবহার করেছেন। একটি কবিতায় একটিই নামকরণ হয় বলে আমরা জানি। কিন্তু মলয়দা এমন অনেক কবিতা লিখেছেন, যেগুলোর অনেকগুলো ক'রে নামকরণ। সেরকম কিছু কবিতা আমার সম্পাদিত 'কবিতা ক্যাম্পাস' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬-৭ সাল নাগাদ। তার আগে ২০০২ সালে 'কবিতা ক্যাম্পাস' থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কবিতার বই 'কৌণপের লুচিমাংস'।
##
মুম্বাই চলে গেলেও কলকাতা তাঁকে বারবার টানছিল বলেই হয়তো ফিরে এসেছিলেন। কিছুদিনের জন্য থেকে ছিলেন বাগুইহাটির বিগ বাজারের সামনে একটি ফার্নিশড ফ্ল্যাটে। সেই সময় আবার মলয়দার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমার কবিতার বই 'আরঙ রসিয়া' হাতে পেয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা ক'রে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতা তাঁকে শেষ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারলো না। আবার চলে গেলেন মুম্বাই। প্রয়াণের আগে পর্যন্ত দু'হাত ভরে লিখে গেছেন তিনি। ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন হাত-মুখ নেড়ে অদ্ভুত সব লাইভ ছবি। সেইসব লাইভের মাধ্যমে তিনি হাংরি অধ্যায়ের কিছু দৈহিক ভাষার পুনর্নির্মাণ করতে চাইছিলেন বলে আমার মনে হচ্ছিল। ডেস্কটপ হয়ে পড়েছিল তাঁর প্রধান অবলম্বন। যাঁরাই প্রকাশের জন্য কবিতা বা গদ্য চেয়েছেন, মলয়দা কাউকে হতাশ করেননি। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নির্বাচিত রচনা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যবসায়ী প্রকাশনী থেকে গ্রন্থ প্রকাশে রাজি হননি। মলয়দার প্রয়াণে অবিরাম নিরীক্ষামূলক অপ্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো বলা যায়। আভগার্দ সাহিত্য, দ্রোহের কবিতা, পোস্টমডার্ন কবিতা, বহুরৈখিক প্রাণময় কালখণ্ডের সন্দর্ভের উল্লেখযোগ্য অবসান ঘটলো মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়াণের মধ্যে দিয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ