সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীমন্দিরের লোকশ্রুতি, ইতিহাস ও সংস্কৃতি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরারাজ্যে অতি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তিসাধনার ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির তারই একটা উজ্জ্বল উদাহরণ । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করে সারা ত্রিপুরা রাজ্যটাই শক্তিপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে । ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠার পাঁচশো বছর পেরিয়ে গেছে । সেই সময়ের পর থেকে অর্বাচীন কালের ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে মহকুমা শহরগুলোতেও কালিকা মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়ে এসেছে এবং নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে আসছে । এই হিসেবে নাম করা যেতে পারে কমলপুরের কমলেশ্বরী, বিলোনিয়ার যোগমায়া কালীবাড়ি, মতাইর বুড়া কালীবাড়ি ইত্যাদির । এগুলির অনেকগুলিরই প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজন্যইতিহাস জড়িয়ে নেই । মূলত জনপদগুলো গড়ে ওঠার সাথে সাথেই স্থানীয় জনগণ দেবস্থান প্রতিষ্ঠার আগ্রহে এবং কিছুটা হলেও ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এই মন্দিরসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছেন । এক কথায় সারা ত্রিপুরা রাজ্যকেই শক্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরারাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজ্যের পিলাক, মাতাবাড়ি, বক্সনগর,এবং ঊনকোটির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লক্ষ্য করলেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।
এ রাজ্যের পাশাপাশি সাব্রুমেও শক্তি চর্চা হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তিক শতাব্দীপ্রাচীন মহকুমা শহর সাব্রুম । তারপরই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা শহর রামগড় । মাঝখানে সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে বয়ে চলেছে ফেনীনদী । সাব্রুম শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ফেনীনদীর পাড়ে রয়েছে প্রাচীন কালীমন্দির । এই মন্দিরটি দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত। খুবই জাগ্রত এই দেবী । সাব্রুমের আপামর জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন । দেবী এখানে 'দক্ষিণাকালী' নামে পূজিতা হয়ে আসছেন । রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম সম্ভবত 'দক্ষিণাকালী' ।স্থানীয় জনগণের কাছে এটাও ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর ন্যায় এক পীঠস্থানের মতো । এই মন্দিরে নিত্য দেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে এই কালীবাড়িতে প্রত্যেক অমাবস্যায় দেবী কালিকার পুজোসহ মেলা ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা-অর্চনাও হয়ে থাকে । বহু বছর যাবত এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে । এককথায় বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার জনগণের গভীর শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন দেবী 'দৈত্যেশ্বরী' কালীমাতা । এই দেবীকে কেন্দ্র করে বহু অলৌকিক কাহিনি সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে । এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে গণেশ চক্রবর্তী, লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন প্রমুখগণসহ আরো অনেকে অনুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ।
লোকশ্রুতি-সূত্র
দেবী দৈত্যেশ্বরী মন্দির ও তার সৃষ্টিকাল সম্বন্ধে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে । এই বিগ্রহের প্রাপ্তিস্থান হিসেবেও বিভিন্ন মত আছে । তার মধ্যে একটি মত হল, বিগ্রহটি সাব্রুম শহরের পূর্ব দিকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রবাহিত 'মাগরুম' ছরাতে পাওয়া যায় । অপর মতে জানা যায় যে, এটি ফেনীনদীতে পাওয়া গেছে । এছাড়াও আরও একটি মত থেকে জানতে পারা যায় যে, এটি সাব্রুম শহরের ওপারে বর্তমান বাংলাদেশের শহর রামগড় থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত সোনাইপুল এলাকায় ছরার মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল । সেখানে এটি প্রথম স্থাপিত হয়েছিল । শোনা গেছে, এখনও সেখানে একটি কালীমন্দির আছে । কেউ কেউ বলেন এই পাথরের বিগ্রহটি সাব্রুমের পশ্চিমপ্রান্তের গ্রাম দৌলবাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দৈত্যছরাতে পাওয়া যায় । সেখান থেকে হাতি দিয়ে তুলে এখানে আনা হয় । দৈত্যছরা থেকে পাওয়া যায় বলে এই বিগ্রহের নাম হয়েছে 'দৈত্যেশ্বরী' । আবার একটা অংশের মত হল এই পাথরপ্রতিমাটি সাব্রুম শহরের পূর্বদিকে কিছু দূরের একটি ছরার পাড়ের পাহাড়ের একটি গুহার মধ্যে ছিল । সেখান থেকে নৌকাযোগে তুলে এনে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই কাহিনিটিরই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে একদল বলে থাকেন যে, এই বিগ্রহটি শিলাছড়িস্থিত শিলাগুহা থেকে রাজকর্মচারীরা তুলে নৌকা করে এনে এখানে স্থাপন করেন । এই মন্দিরের পাশেই ছিল রাজার তহশিল কাছারি । যা এখনও বর্তমান । যাই হোক, এ সমস্ত কিংবদন্তী বা লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে এই মন্দিরের সৃষ্টির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যোগাযোগ অবশ্যই ছিল ।
ইতিহাস-সূত্র
এবারে আসা যাক, এই মন্দিরের সৃষ্টির ঐতিহাসিক সূত্রটির সন্ধানে । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসসম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থটির নাম রাজমালা । এই রাজমালার প্রথম লহরের শুরুতে ত্রিপুরার আদিযুগের রাজাদের একটি তালিকা রয়েছে । এই তালিকার পঁয়তাল্লিশতম রাজা হলেন দৈত্য । তাঁর পিতা ছিলেন চিত্ররথ । সুশীলা নাম্নী মহিষীর গর্ভে যথাক্রমে চিত্রায়ুধ, চিত্রযোধি ও দৈত্য নামে তিন রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন । দৈত্যের বড়ো দুইভাইয়ের মৃত্যু হলে দৈত্য রাজা হন । রাজমালা প্রথম লহর ( যযাতি হইতে মহামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ )-এ গ্রন্থারম্ভের পরই দৈত্য খন্ডের শুরুতে রয়েছে―
দ্রুহ্যু বংশে দৈত্য রাজা কিরাত নগর ।
অনেক সহস্র বর্ষ হইল অমর ।।
বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল ।
ত্রিবেগেতে জন্ম নাম ত্রিপুর রাখিল ।।
রাজা দৈত্যের সময়কাল থেকে রাজমালা প্রথম লহরের বর্ণনা শুরু । এই দৈত্য ছিলেন কালিকাদেবীর উপাসক । রাজ্যের প্রবীন গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী তাঁর 'ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ' একদা দৈত্য আশ্রম সন্নিহিত গভীর অরণ্যে ভ্রমণকালে এক মন্দির দেখিলেন । মন্দিরস্থিতা কালিকাদেবীর সশস্ত্র মূর্তি দর্শন করিয়া দৈত্যের মনে ক্ষত্রিয়তেজ জাগিল । দেবীর অর্চনা করিয়া নিষ্ঠার সহিত অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন পারদর্শিতা অর্জন করি এবং মায়ের আশীর্বাদে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করিয়া এবং মায়ের আশীর্বাদ লইয়া তিনি পিতৃরাজ্যে প্রত্যাবর্তন পূর্বক পাত্র-মিত্র সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন।' এখানে ধারণা করা যায় যে, রাজা দৈত্য অরণ্যস্থিত যে দেবীর অর্চনা করে রাজধানীতে ফিরেছিলেন তিনিই এই দেবী দৈত্যেশ্বরী। এছাড়া মহারাজা রামমাণিক্যের পুত্র রত্নমাণিক্যের (১৬৮২–১৭১২ )দুই মাতুল দৈত্যনারায়ণ ও বলীভীমনারায়ণ নবীন রাজাকে রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন । বলীভীম নারায়ণ মতাই জোলাইবাড়ি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন । রাজ্যের দক্ষিণ অংশ দেখাশুনা করতেন দৈত্যনারায়ণ । এই দৈত্যনারায়ণের নামের সঙ্গে দৈত্যেশ্বরীর নাম যুক্ত থাকতে পারে । দৈত্যনারায়ণ হয়তো স্বীয় ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তদানীন্তন রাঙ্গামাটির ,( ত্রিপুরার রাজধানী ) দক্ষিণাঞ্চলে নিজস্ব তালুক গড়ে তুলে থাকতে পারেন এবং এই দৈত্যনারায়ন কর্তৃক বা তাঁর নির্দেশে সেখানে কোনো রকম মন্দির প্রতিষ্ঠা করা বা দেবীকল্পের প্রতিষ্ঠা ও অসম্ভব নয় । দৈত্যনারায়ণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর নাম অনুসারে এই দেবীর নাম দৈত্যেশ্বরী হয়েছে বলে মনে করা যায় । বহু বহু প্রাচীনকালে এই সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল অরণ্যসংকুল ছিল । পরবর্তী রাজন্যকুল তাঁদের পূর্বজ বংশধরের সাধনাস্থল ও দেবী সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন বলেই পরবর্তী পুরুষেরা তার সন্ধান করে বিগ্রহটি উদ্ধার করেন । অমরমাণিক্যের ( ১৫৭৭–১৫৮৫ ) সময়ে এই রাজ্যের দক্ষিণ অংশ মগদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল । তারাও এই দেবীবিগ্রহটি সরিয়ে গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে পারে । অনেকে বলেন মগগণ এই দেবীর পূজা করতেন । এই মন্দিরের ব্যয়নির্বাহসংক্রান্ত হিসাবের একটি পুরানো চিরকুটে চাঁদাদাতা হিসাবে মগ পুরুষ ও নারী ভক্তের নাম পাওয়া যায় । ( তথ্যসূত্র : মন্দিরের প্রথম পুরোহিতের বংশধর তপন চক্রবর্তী, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ) ।
ভাষাতাত্ত্বিক সূত্র
এ অঞ্চলে যে বাঙালি জনগোষ্ঠী বসবাস করছেন দীর্ঘকাল ধরে, তাদের অনেকেই চট্টগ্রাম বা নোয়াখালি অঞ্চলের আদি বাসিন্দা । সেকারণে এখানকার ভাষার মধ্যে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি ভাষার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় । বাংলা সাধুভাষা বা মান্য চলিত ভাষার সঙ্গে এই ভাষার দূরত্ব অনেকটা রয়ে গেছে । তাই এখানকার বাংলা ভাষাভাষী লোকেরা কথ্যভাষায় যেসব শব্দ ব্যবহার করে থাকেন, পরিশীলিত ব্যবহার বা উচ্চারণের সময় সেইসব শব্দের সাধুরূপকে মর্যাদা দেন । যেমন, দই, সোনা, ফুল, দুপুর, বমি ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার তৎসম শব্দরূপ দধি, স্বর্ণ, পুষ্প ( হুস্স ), দ্বিপ্রহর, বমন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় । সেইরূপ এই অঞ্চলে দৈত্যকে বলা হয় 'দৈস্য' । যেমন 'ব্রহ্মদৈত্য' শব্দটি এখানে বলা হয় 'বর্মদস্য' । ভাষাতত্ত্বে শব্দ পরিবর্তনের একটা বিশেষ নিয়ম আছে । তাকে বলা হয় 'লোকনিরুক্তি' । শব্দের ব্যবহারিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করে অনেক সময় শব্দকে পরিবর্তন করা হয় । উদাহরণস্বরূপ একটি শব্দের উল্লেখ করছি । যেমন 'নপুংসক' শব্দটিকে এ অঞ্চলে বলা হয় 'নয়নসুখ' । নপুংসক শব্দের অর্থ হল পুরুষত্বহীন মানুষ । ব্যবহারিক সাদৃশ্যে অর্থ খুঁজে নেওয়া হয়েছে এইভাবে যে, দৈহিক সুখী হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। অর্থাৎ চোখে দেখেই সে কামতৃপ্তি পায় । তদ্রূপ ব্রহ্মদৈত্যকে 'বর্মদস্য' বলা হয় এ কারণে যে ব্রহ্মদৈত্যের মধ্যে দস্যুতার স্বভাব বিদ্যমান থাকাই স্বাভাবিক । 'দস্যু' শব্দটাই বিকৃত হয়ে দৈত্যের স্থলে 'দৈস্য' হয়েছে । মূল শব্দটি জানা থাকার ফলেই নিকট উচ্চারণের সময় 'দস্যু' বা 'দৈস্য' শব্দটির বদলে 'দৈত্য' শব্দটি ব্যবহার করা হয় । সেই হিসেবে কোনো 'দস্যুশ্বরী' বা 'দৈস্যেশ্বরী' মার্জিত রূপ নিয়ে হয়তো 'দৈত্যেশ্বরী' হয়েছে ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এখানে দস্যু কারা । তাহলে আবার ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হয় । একটি লোকশ্রুতিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, এই বিগ্রহের পুজকরা মগ জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত । এই বক্তব্যের সমর্থনে একথা বলাই যায় যে, এই তথ্যটি অনেকটা প্রামাণ্য। এই অঞ্চলে মগ জনগোষ্ঠীর বসবাস দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে । শামসুদ্দিন তালিশ নামে জনৈক লিপিকরের রচনা থেকে জানা যায় যে, আকবরের সময় থেকে শায়েস্তা খাঁর চট্টগ্রাম বিজয় অবধি আরাকানের মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা বাংলাদেশের লুটতরাজ চালাত । তাদের আক্রমণে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী তাদের যাত্রাপথের নদীগুলোর দুই তীরবর্তী জনপদসমূহ একেবারে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল । এই মগরা অমর মানিক্যের আমলে ( ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ ) উদয়পুর দখল করে নেয়। মগসৈন্যরা উদয়পুরে পৌঁছে অবাধে লুটপাট শুরু করে । অমরমানিক্য তাঁর রাজধানী উদয়পুরে সরিয়ে নেন । মগ সৈন্যরা উদয়পুর বিধ্বস্ত করে এবং ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের সুউচ্চ চূড়াটি ভেঙে ফেলে ।
এই মগরা পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ছড়িয়ে পড়ে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে । এখানে উল্লেখ্য যে মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । মহাযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধের সঙ্গে বিভিন্ন দেবদেবীর ও আরাধনা করে থাকেন । এই সকল বৌদ্ধ দেবদেবীরা পঞ্চধ্যানী বুদ্ধের কোনো না কোনো একটি পরিবারভুক্ত । পরবর্তীকালে বৌদ্ধরা আক্রান্ত হলে বৌদ্ধ দেব-দেবীরা হিন্দু দেব-দেবীতে রূপান্তরিত হওয়ার সংমিশ্রণ বিমিশ্রণের ইতিহাসগত স্বীকৃতি তো রয়েছেই । সেই হিসেবে প্রচলিত লোকমতকে সমর্থন করে আমরা ধরে নিতে পারি যে, দৈত্যেশ্বরী দেবী পূর্বে মগদের পুজিত দেবী ছিলেন । মগদের দস্যুতার ইতিহাস সম্বন্ধে এই অঞ্চলের জনগণ দীর্ঘকাল পূর্ব থেকে পরিচিত, সে কারণে মগ 'দস্যুঈশ্বরী' বা 'দৈস্যেশ্বরী' পরবর্তীকালের বাঙালি জনগোষ্ঠীর দ্বারা শিষ্ট উচ্চারণে দৈত্যেশ্বরী নামে পরিগণিত হয়েছেন । এই ধারণার পেছনে যুক্তি হিসেবে উল্লেখ করতে পারি, একটা প্রামাণ্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, চট্টগ্রামে মগদের পূজিত দেবী মগধেশ্বরীই পরবর্তীকালে ত্রিপুরেশ্বরীতে রূপান্তরিত হয়েছেন । 'ত্রিপুর বংশবলি'তে উল্লেখ আছে যে ধন্য মানিক্য–
রাধা কৃষ্ণ স্থাপিবারে মঠ আরম্ভিল
চট্টেশ্বরী দেবী আসি স্বপ্ন দেখাইল
এই মাঠে আমাকে রাজা করহ স্থাপন
নতুবা অব্যাহতি তোমার নাহি কদাচন
এ মঠে যদি আমা স্থাপন না কর
তবে জান রাজা তোমার নাহিক নিস্তার
চট্টগ্রামের সদরঘাটে এক বৃক্ষ মূলে
পুজয়ে আমারে সদা মগ সকলে
সেই স্থান হতে শীঘ্র আনহ আমায়
কাজেই দৈত্যেশ্বরী যে মগদের দেবী সে বিষয়ে আরো নিঃসংশয় হওয়া যায় । বেলে পাথরের এই মূর্তিটি মগদের কোনো দেবী বলে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সংশয়ের উদ্রেক করে এ কারণে যে, প্রস্তর প্রতিমাটির গায়ে কোন প্রকার আবয়ব লক্ষণ দৃষ্ট হয় না । এক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে বলা যায় যে, ইতিহাস অনুসন্ধানের দ্বারা যেভাবে প্রাচীনতা নিরূপিত হচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট করে বলা যায় যে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এই প্রতিমা শতাব্দীর পর শতাব্দীর বৃক্ষতলে, আকাশের নিচে ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই পারে । কালের করাল গ্রাসে সে চিহ্ন ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে । পাঁচশো বছর আগে তুলে আনা প্রস্তরমূর্তিটিরও অনেকটা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা দৃষ্ট হয় । সেই মূর্তিটি প্রাচীন হওয়ায় দেবীর চারপাশের কোন আয়ুধই স্পষ্ট নয়, উপরিভাগ ক্ষয় পেয়ে যাওয়ার কারণে যদি ধরে নিই দৈত্যেশ্বরী মূর্তিটির নির্মাণকাল ত্রিপুরেশ্বরীর সমসাময়িক কালের হয় তাহলে ত্রিপুরেশ্বরী মূর্তিটি উদ্ধার করে সংরক্ষণের আরও প্রায় চারশো-সাড়ে চারশো বছর পর পর্যন্ত দৈত্যেশ্বরী বিগ্রহ উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে থেকে তার অঙ্গ থেকে চিহ্ন একেবারে মুছে ফেলেছে ।
( 'দৈত্যেশ্বরী' নামকরণের উৎসসন্ধানে–অশোকানন্দ রায়বর্ধন/প্রবন্ধ ) ।
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাসের আকরগ্রন্থ রাজমালায় কি কারণে জানিনা ত্রিপুরার দক্ষিণ অঞ্চলের জনপদের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না । যার ফলে প্রত্নতত্ত্বের অফুরন্ত ভান্ডার পিলাক সম্বন্ধেও কোন উল্লেখ রাজমালায় পাওয়া যায় না । সাব্রুম তো আরও দক্ষিণে অবস্থিত । শুধুমাত্র শেখ মনোহর গাজী রচিত গাজীনামাতে প্রসঙ্গক্রমে ফেনীনদীর উল্লেখ আছে । এই ফেনীনদী সাব্রুম শহরের দক্ষিণপ্রান্তে রাজনৈতিক সীমানা হিসেবে বিরাজমান । তাই প্রামাণ্য কোনো তথ্য না থাকায় ইতিহাস, পুরাণ, জনশ্রুতি ইত্যাদি থেকে কষ্টকল্পিত মনে হলেও দৈত্যেশ্বরী নামের উৎস সন্ধানের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে মাত্র । কোন ছলচাতুরি নয় আগামী প্রজন্মের কোন গবেষকের গবেষণায় যদি ধরা পড়ে যে, এইসব তথ্য ভ্রান্ত কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত সেই ভয় পূর্বাহ্নেই সেই অনাগত গবেষকের কাছে ক্ষমাপ্রদর্শনের আর্জি পেশ করে রাখছি । শুধুমাত্র অন্তরের তাগিদেই নিজস্ব মেধা ও যুক্তিবুদ্ধিকে একটা ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করেছি যাতে অনুসন্ধান এর ক্ষেত্রটিবিস্তৃত হয় এবং আগ্রহ সৃষ্টি করে । মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্যের দায়বদ্ধতাই এই ধরনের প্রচেষ্টার উৎস । গবেষণার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভক্তের কাছে নামে কি আসে যায় । মা তো মা । ভক্তের আকুল প্রার্থনার স্থল । তাঁর চরণপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের হৃদয় ।
উত্তরকাল
যতদূর জানা যায়,উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মন্দিরে পূজার্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সাব্রুমের সম্ভ্রান্ত ব্যানার্জী পরিবার ( রাজ্যের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী কালিপদ ব্যানার্জীর পূর্বপুরুষ ) । এই বাড়ির এক কালীভক্ত সদস্য সতীশ ব্যানার্জী এই মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি । এই মাতৃমন্দির ও মাতৃসাধক সতীশ ব্যানার্জীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সাব্রুমে । উনিশ শতকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব সময়কালে সারা বাংলাদেশ জুড়েই মাতৃসাধনার জোয়ার এসেছিল । সেকালে সাব
রুমের ব্যানার্জী পরিবারের ব্যবসাসূত্রে এবং পরিবারে সদস্যদের অবস্থানসূত্রে কলকাতার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল । ফলে বাংলার নবজাগরণের প্রভাব সাব্রুমের এই বনেদি পরিবারের সদস্যদের উপরও পড়েছিল সেদিন ।
সাব্রুম অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ হলেও ভারতভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ( ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯ ) সাব্রুমের জনগণের ওপারের রামগড়ের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি । এখানকার মানুষ রামগড় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেন । রামগড়ের অনেক ব্যবসায়ীর জমিজমাও ছিল এখানে । তাঁরাও ব্যবসাসূত্রে সাব্রুমে অবস্থান করতেন । দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে তাঁদেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল । দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ির প্রথম পুরোহিত চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর পৌত্র বর্তমানে সাব্রুম শহরের বর্ষিয়ান বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাজলক্ষ্মী গেস্ট হাউসের মালিক শ্রীতপন চক্রবর্তী মহোদয়ের কাছে রক্ষিত তাঁর কাকা হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে লেখা তাঁদের বংশপরিচয় থেকে জানা যায় যে, ১৮৮৫ সালে রামগড়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিরীশচন্দ্র দাস অর্থাৎ গিরীশ মহাজন ( সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধি দীপক দাস মহোদয়ের ঠাকুরদাদা ) সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজার্চনা করার জন্য তাঁর আদিনিবাস নোয়াখালির আন্ধারমাণিক গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীকে সাব্রুম নিয়ে আসেন । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, সে সময়টা ছিল মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) আমল ।
চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর চার সন্তান । যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রথম সন্তান যোগেন্দ্র চক্রবর্তী ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন তাঁর কর্মস্থল ছিল খোয়াইতে । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী দেশের বাড়ি নোয়াখালির আন্ধারমাণিকে আসাযাওয়া করে পর্যায়ক্রমে এইমন্দিরে পূজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন এই মন্দিরে দেবীর পূজার্চনা করে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ,শনিবার, কার্তিকী অমবস্যার রাত ৪-৩০ মিনিটে সাব্রুমে পরলোক গমন করেন । তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী মায়ের মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পান । দীর্ঘদিন মায়ের সেবার্চনা করার পর ১৯৬২ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন । তারপর কিছুদিন মায়ের মন্দিরে পুজো করেন উপেন্দ্র চক্রবর্তী । এরপর আবার চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মন্দিরের দায়িত্বে আসেন । হরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরে বর্তমান পুরোহিত অজিত চক্রবর্তীর বাবা শিবশংকর চক্রবর্তী দায়িত্বে আসেন । তাঁরাই বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত মায়ের মন্দিরে পুজো করে আসছেন । ( তথ্যসূত্র : সুব্রত চক্রবর্তী, সাব্রুম ) ।
সমীকরণ
রাজন্য আমলে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে ( সম্ভবত সে সময় সাব্রুম ডিভিশনের ডিভিশনাল অফিসার ছিলেন যোগেন্দ্র গাঙ্গুলী ) দৈত্যেশ্বরী মন্দিরটি বর্তমান স্থানের আরো কিছুটা পশ্চিম দিকে তহসিল অফিস সংলগ্ন একটি জরাজীর্ণ দোচালা ঘরকে কেন্দ্র করেছিল । রাজন্যআমলে রাজা বা রাজপুরুষেরা মন্দিরসংলগ্ন তহশিল কাছারিতে খাজনা আদায় বা পুণ্যাহের জন্য এলে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়েই তাঁদের কাজ শুরু করতেন । এ অবস্থায় বেশ কিছুদিন থাকার পর গত শতাব্দীর চারের দশকের শেষ দিকে কিংবা পাঁচের দশকের প্রথমদিকে তদানীন্তন মন্দিরসংলগ্ন পূর্বদিকের অংশের মালিক কৈলাসচন্দ্র বিশ্বাস ( কৈলাশ উকিল ) নামে এক ভদ্রলোক দান করেন । বর্তমান প্রস্তরপ্রতিমাটি তখন সেই মন্দিরে ছিল । রাজার আমল থেকে এই পুজো চলে আসছে । কিন্তু এই মন্দিরের কোনরকম রাজানুকুল্য বা সরকারি বরাদ্দ আজ অবধি নেই । পুরোহিতদেরও কোনো মাসোহারা বরাদ্দ নেই । একসময়ে মন্দিরের সামনে ও পেছনের সামান্য ভূমিতে খেতকৃষি করে তাঁরা সংসার চালাতেন । মন্দির কমিটি তাঁদের সামান্য মাসোহারা বরাদ্দ করেন । মন্দিরটিও ছোট্ট একটি চারচালা ঘর ছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল পুরোহিতের আবাস । আর ভক্তদের দানদক্ষিণায় তাঁদের সংসার চলে । মন্দিরেরও নিজস্ব কোনো স্থায়ী তহবিল নেই । ভক্তবৃন্দের আর্থিক অনুদানে মায়ের মন্দিরের সব ব্যয় নির্বাহ হয় ।
সেসময়ের মূল মন্দির এলাকা পেরিয়ে দক্ষিনে এগিয়ে বর্তমান তহশীল অফিসের পশ্চিম দিকে ফেনীনদীর পাড়ে ছিল সাব্রুম টাউন ক্লাব । বিশাল হলঘর, মঞ্চ, ব্যালকনিসহ তখনকার সাব্রুম শহরে এটি ছিল সমস্ত রকম সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র । সেই টাউন হলে প্রচুর আসবাবপত্র, বইপত্র, মঞ্চে ব্যবহারের জন্য বড়ো বড়ো পর্দায় আঁকা বিশাল বিশাল দৃশ্যপট ( রাজদরবারের চিত্র বনপথের চিত্র, যুদ্ধশিবিরের চিত্র, অশ্বারোহী সৈন্যদল, শ্মশানদৃশ্য ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের দৃশ্যপট ) ছিল । মঞ্চে অভিনয়ের সময় প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো ব্যবহার করা হত । দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় শেষের দিকে টাউন হলটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে । পরবর্তী সময়ে ছয়ের দশকে প্রথম দিকে এক বিধ্বংসী ঝড়ে সাব্রুম টাউনক্লাব ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় । এই সময় এই টাউন ক্লাবের টিন-কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী যার যেমন সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন । তখন এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি উকিল বাবু যতীন্দ্র লোধ, শচীন্দ্র মজুমদার, যদনন্দন সিংহ, জগবন্ধু বসাক প্রমুখগণ উদ্যোগী হয়ে কিছু টিন কালীবাড়ির জন্য সংগ্রহ করে রাখেন । টাউনহলের মহার্ঘ দৃশ্যপটগুলো সেই ডামাডোলে রামগড় টাউনক্লাবের কর্মকর্তারা বুদ্ধি করে সংগ্রহ করে নিয়ে যান । এদিকে সংগৃহীত টিনকাঠগুলো দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই কালীমন্দিরের জন্য একটি ছাউনিযুক্ত ঘর তৈরি হয় । সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে জেলাশাসক মানিক গাঙ্গুলীর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে বর্তমান নাট মন্দিরটি তৈরি হয়।
সেসময়ের একজন প্রাচীন বাসিন্দা নিতাই বসাকের বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায় যে, বর্তমান পাথরপ্রতিমাটি তিনের দশকের কোন এক সময়ে সংগৃহীত হয়েছিল । এবং সংগ্রহকালীন সময়ে পাথরটি আকারে ছোটো ছিল বলে সমসাময়িক লোকের বর্ণনায় প্রকাশ পায় । পঞ্চাশের দশক থেকে যাঁরা প্রতিমাটি দেখে আসছেন তাঁদের অনেকের মত যে, তাদের সেই সময় দেখা আকৃতি থেকে বর্তমান বিগ্রহের আকৃতি বেশ একটু বৃদ্ধি পেয়েছে । এই ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমত পূর্বে উল্লেখিত যুক্তিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ে । তবে দৈত্যেশ্বরীকে কেন্দ্র করে প্রত্নগবেষণা এখনো পর্যন্ত না হওয়ায় এই প্রতিমাটির গঠনগত বিশ্লেষণের কোনো তথ্য নেই । তার দৈর্ঘ, প্রস্থ, উচ্চতার পরিমাপ, ওজন ইত্যাদি কোনকালে গ্রহণ করা হয়নি । ফলে পুরনো কোনো রেকর্ড নেই । কেবলমাত্র ভক্তজনের আবেগবাহিত বর্ণনাকে উপজীব্য করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যতা থাকে না । আর এই লোকশ্রুতিকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান
বিষয়ক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় । পাথরের মতো জড়বস্তুর আকারের প্রসারণ ঘটে কিনা এই বিষয়টি একমাত্র পদার্থবিদ্যার ছাত্র গবেষকরা বলতে পারবেন ।
রাজন্য আমল ও তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে দীর্ঘদিন মন্দিরের উত্তরদিকের নাতিউচ্চ টিলাটিতে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । বর্তমানে এটি সাব্রুম দ্বাদশশ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় । তার সামনের পুকুরটি 'কালীপুকুর' নামে পরিচিত । শ্রদ্ধেয় তপন চক্রবর্তী মহোদয় আলাপচারিতায় জানিয়েছেন এই বিগ্রহ মাটির নীচে অনেকখানি প্রোথিত আছে । লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই বিগ্রহ পূর্বে আরো ছোটো ছিল । ধীরে ধীরে বিগ্রহের উচ্চতা বেড়ে বর্তমান আকার নিয়েছে ।
দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িত । একসময় রাস্তাঘাট দুর্গম থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে যেতেন পুজো দেওয়া কিংবা মানত রক্ষার জন্য । পরবর্তীসময়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তার মাধ্যমে যাতায়াত করতেন । কিন্তু যাঁরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল তাঁদের জন্য দৈত্যেশ্বরী মা একমাত্র আশ্রয়স্থল । শক্তিতীর্থভূমি । মা তো জগজ্জননী । ভক্তগণ এখানেই মায়ের চরণে ভক্তি নিবেদন করেন । এই মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিচিত্তে পুজো, মানত করেন । বিয়ের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে এবং বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে বিয়েবাড়ির সবাই এই মন্দিরে এসে প্রণাম করার রেওয়াজ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত । জাগ্রত দৈত্যেশ্বরী মাকে বালিকাবেশে গভীর রাতে মন্দিরচত্বরে পরিভ্রমন করতে দেখেছেন বলে দাবি করেন অনেক ভক্ত । এই মায়ের মন্দিরের খ্যাতি এতদূর বিস্তৃত যে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ্যের বাইরে ও বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে মায়ের দর্শন করতে আসেন ।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলাশাসক থাকাকালীন সময়ে মাণিকলাল গাঙ্গুলী মায়ের বাড়ির উন্নয়নের জন্য অর্থবরাদ্দ করেছিলেন । শোনা যায় তিনি মায়ের বিগ্রহের দুই নয়ন স্বর্ণ দিয়ে নির্মান করে দিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই মায়ের মন্দিরের বর্তমান মন্দির ও প্রাঙ্গনের সামনের দিকে অবস্থিত শিবমন্দিরটি ছাড়া লক্ষণযোগ্য তেমন কাজ হয়নি ।
কথাপরিশেষ
সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিভরে পূজা দিয়ে থাকেন । এই বিগ্রহকে কেন্দ্র করে ভক্তগণের মধ্যে বহু মিথ প্রচলিত আছে । যার মধ্যে অনেকগুলি প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন কালীমন্দিরকে কেন্দ্র করে প্রচলিত মিথের অনুরূপ । শুধুমাত্র স্থান-কাল-পাত্র পরিবর্তিত হয়ে গেছে । গবেষক দৃষ্টিতে এখনও এই মন্দিরের দেবীবিগ্রহ সম্বন্ধে তথ্যানুসন্ধান তেমন হয়নি । তাই প্রয়োজনের তাগিদে সঠিক সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে এই প্রবন্ধে শুধুমাত্র একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে মাত্র । গত তিন-চার দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে প্রয়াত কালিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত আশুতোষ নন্দী, প্রয়াত সুনীল চৌধুরী, প্রয়াত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিতাই বড়ুয়া মুকুন্দ চৌধুরী শিক্ষক রাখাল নাথ,যামিনীভূষণ চাকমা, গোপাল রায়চৌধুরী, গোপাল ব্যানার্জী, কৃষ্ণবন্ধু চাকমা এবং নাট্যকর্মী প্রণব মজুমদার লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, প্রবীর বসাক, বরিষ্ঠ নাগরিক শংকর ( অপু ) দে, প্রাবন্ধিক দীপক দাস, এক সময়ে মন্দির কমিটির কর্মকর্তা ঠাকুরদাস বনিক, তপন চক্রবর্তী এবং অন্যান্য পুরনো সাব্রুমবাসীর কাছ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রবন্ধের অবতারণা করা হয়েছে । মন্দিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্যের আকর বহু ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব ইতোমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন । যার ফলে সঠিক তথ্য সংগ্রহের ঘাটতি থেকে যেতে পারে ।
সাব্রুমে ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু নির্মানের পর মহকুমার বাইরে থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ দৈত্যেশ্বরী মন্দির দর্শনের জন্য আসেন । ফলে এই মন্দিরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে । এখানে এসে তাঁরা মন্দির চত্বরে বিশ্রাম করেন ও পুজো দেন । এই সুপ্রাচীন মন্দিরকে ভক্তমন্ডলী ও পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ্যে অতি সত্বরই সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া আবশ্যক ।
0 মন্তব্যসমূহ