ব্যক্তি তৈমুর | সুভাষ রবিদাস
সাম্প্রতিক কালে তৈমুর খান একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। আঞ্চলিক কবিদের ধরে ধরে, তাদের কবিতা ও কর্মজীবন সম্পর্কে আলোচনা করছেন। এটি একটি মহত্তর ইতিহাস রচনার কাজ। শিব শিং সিঙ্গর হিন্দি কবিদের নিয়ে লেখেন উনবিংশ শতকে। সেটাই হিন্দি সাহিত্যের প্রথম অধ্যায়। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ আবিস্কৃত হলে তবেই লেখালেখি শুরু হয়, কিন্তু এখানে নাগরিক সমাজ সাহিত্য মূলতঃ প্রাধান্য পায়।
সৈয়দ খালেদ নৌমান মুর্শিদাবাদের কবিদের নিয়ে একটা তথ্য দিয়েছেন, বর্ধমান থেকে অসীমকৃষ্ণ দত্ত সারা বাংলার কবিদের সংকলিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তৈমুর খান এক একজন কবিব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন, এটা প্রশংসনীয়।
শিবশিং সিঙ্গর, 1877 সালে শিবশিং সরোজে
1003 জন কবির উল্লেখ ও বর্ননা দিলেও সন্ত রবিদাস, কবীরের উল্লেখ করেন নি। কিন্তু আরও আশ্চর্য কথা 1839 সালে ফ্রান্সের প্যারিসে বসে গয়সা দ্যাতোসি তার গ্রন্থে সন্ত রবিদাস সম্পর্কে লিখছেন পাঁচ পাতা, অথচ শিবশিং 1877 সালে তার গ্রন্থে উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে থাকা সাধক কবি সন্ত রবিদাস, কবীরের সম্পর্কে কিছুই জানে না ভাবতে অবাক লাগে। পরে গণপতি চন্দ্র গুপ্তা লেখেন 'হিন্দি সাহিত্যের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস।' তিনি মৈথিলী সরণ গুপ্তাকে নিয়ে লেখেন ছয় পাতা, অথচ সন্ত রবিদাসকে নিয়ে একটি বাক্যও বলেন না। জাতিবাদের সংস্কার থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেন নি। তিনি সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
জর্জ আব্রাহাম গিয়ারসন একজন ICS ছিলেন। সিভিল সারভ্যান্ট। 1933 সালে তিনি 953 জন কবির উল্লেখ করলেও সম্পূর্ণ উপাদান নিয়েছেন সিঙ্গরের গ্রন্থ থেকে। তার লেখনী থেকে বাদ চলে গেছে শ্রমণ কবিরা।
রাম চরণ শুক্লা 1929 সালে যে ইতিহাস লেখেন তাতে তুলসী দাসকে নিয়ে লেখেন ষোল পাতা। সন্ত রবিদাসকে নিয়ে লেখেন একপাতা। আরও স্পষ্ট যে রাম চরণ শুক্লা বর্ণাশ্রমী কবিদের জন্য আদর্শসূচক শব্দ "জী" ব্যবহার করেন। রামানন্দজী, তুলসীদাসজী, সুরদাসজী অপরদিকে সন্ত রবিদাস, কবীরদাসের শুধু নামটুকু উল্লেখ করেন, তাদের জন্য আদর্শ সূচক শব্দ যোগ করেন না। আরও বড় কথা শুক্লাজী শ্রমণ কবিদের সাম্প্রদায়িক বলে উল্লেখ করেন। বলেছেন, তারা ধর্মীয় ভাবধারা পোষিত। কিন্তু শুক্লাজী, তুলসী দাস দুবের রাম চরিত মানস, সুরদাস, বৈশ্বানর সাহিত্য এদেরগুলো সম্প্রদায়হীন হয় কি করে? এগুলো কোন কফি হাউসের আড্ডায় বসে লিখেছিল তারা? রামায়ণ মহাভারত সেগুলো কি অসাম্প্রদায়িক?
প্রসঙ্গানুসারে এসব কথা লিখতে বাধ্য হলাম।
এমন একটা ধারণা হয়ে গেছে যে একজন কবির সম্পর্কে লিখলে কেবল তার কাব্য নিয়েই আলোচনা করতে হবে। কবিরাও এই ধারণা পোষণ করে থাকে। কিন্তু আমার দৃষ্টিকোণ যে আলাদা হবে না, তা কেন!
একজন কবি সাহিত্যিকের প্রথম গুণই হল সে একজন মানুষ। দ্বিতীয় গুণ সে একটা সামাজিক জীব। বাকিগুলো পর পর জুড়ে দিলেই হবে।
তৈমুর খানকে আমি প্রথমবার দেখি ফরাক্কায়। শাহাযাদ হোসেন কবিতা পাক্ষিকের ব্যানারে একটি লিটল ম্যাগাজিন মেলা করেছিল। কবি প্রভাত চৌধুরী আমাদের তখন এক উৎসাহ দাতা। এন টি পি সি'র কর্মচারী নসীরাম দাস আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন বিশেষ ভাবে। বিশেষ কারণে।
সেই মেলা থেকে ফেরার পথে তৈমুর খানের সাথে আলাপ। একটা রিক্সা ভ্যানে বসে বাস স্ট্যান্ডে আসা। সেখান থেকে রঘুনাথগঞ্জ। তার পর কেটে গেছে বহুদিন। আমরা ফুলতলায় আবদুল্লাহ মোল্লার দোকানে বসতাম। আলোচনা হত কবিতা ও সাহিত্য নিয়ে। তৈমুর খানকে অনেক সময় বিব্রত হতে দেখেছি মৌলবাদী চিন্তাধারা নিয়ে। তিনি নামাযি নন, তাকে ধর্মীয় আচরণ মেনে চলা উচিত। এমন ভাবনা পরোক্ষভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছে অনেকেই। এতে তাকে আশাহত হতে দেখেছি বারবার। একটা সুন্দর সমাজে সৎ হওয়া আবশ্যক। অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করাকে অপরাধ ভাবলেই পৃথিবীটা সুন্দর হয়ে উঠবে। এখানে ধর্মীয় ভাবাবেগের কোনও প্রয়োজন নেই। ধর্ম যদি জীবনকে বিশুদ্ধ করে তুলতো, তবে ধর্মীয় উন্মাদনা ও উন্মাদ তৈরি হত না। তৈমুর খান অবশ্যই পারিবারিক ভাবে বিভিন্ন অখ্যান ও ধর্মযুক্ত কাব্য সাহিত্যের কথা পড়ে ও শুনে এসেছেন। এসব কাহিনী নতুন রূপে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই পর্ব থেকে বাদ পড়ে না কোন কবি। তৈমুর খান কবি। তেঘরি হাইস্কুলের শিক্ষক রূপে জয়েনিং। সন্ধ্যায় আড্ডা বসত। অসংখ্য ছোট কাগজের সম্পাদকের সাথে পরিচিত করিয়েছেন তিনি।
তখন তৈমুর খান এর খান দুই বই ছাপা হয়েছে। খা শূন্যতা আমাকে খা, আয়নার ভিতর তু যন্ত্রণা ; কবিতায় প্রেম বিরহ সমাজ ও শুন্যতা বিশেষ করে স্থান পেয়েছে। অভাব ও গ্রামীণ জীবন চিত্র জায়গা করে নিয়েছে পদ্য ও গদ্য দুইয়ে। তিনি গদ্য লেখেন খুব সুন্দর। ব্যাখ্যা সহকারে।
তৈমুর খান চাষের মাঠ থেকে উঠে আসা কবি। তার কবিতায় শব্দের বোঝা নেই। সরল ভাষায় প্রকাশিত সরল ভাবনা। শব্দ অলঙ্কার ছন্দ না জেনে কেউ কবি হতে পারে না। কিন্তু কবি যে সরল অন্তঃকরণে লিখে থাকেন জটিল জীবনের সরল কবিতা। তার কবিতায় প্রেম বিরহ দৈন্যদশা প্রকট হয়ে ওঠে। বারবার তিনি লেখেন সেসব কথা। এর মধ্যে যে গদ্যগুলো তিনি লিখেছেন কবিতা বিষয়ক। তার ভিতর কবিতার রস ঘেঁটে ঘেঁটে তিনি কবিতার মধ্যে খুঁজেছেন মেটাফোর, সুর্যালিজম ও অন্তর্দশন।
সভ্যতা যত বেশি উন্নত হয়, তাদের লেখার হরফ ততই কম হয়। চৌত্রিশ অক্ষরে সন্ত রবিদাস লিখেছেন তাঁর অমূল্য পদগুলি। চৌত্রিশ অক্ষর তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবনা যে ভাষায় "শিখ" (শিক্ষা) দিয়েছেন তিনি। একইভাবে যে কবির ভাবনা যত বেশি উন্নত হয়, তার কবিতার ভাষাও হয় ততটাই সরল। সরল ভাষাতেই তিনি লিখে যান গভীর দর্শনের কথা। তৈমুর খান এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন বৈকি।
মানুষ রূপে তিনি বেশ খানিকটা অভিমানী। এই অভিমান তার সমাজ পরিবেশ ও জীবনকে প্রভাবিত করে। তার সাথে আমি বহু স্থানে ঘোরাঘুরি করেছি। যেটা তার সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় তা হল সখ্যতা। অনেক কবিকে দেখেছি দেবতা হয়ে যেতে। ভেবে বসেছে যেন পৃথিবীটা তারই সৃষ্টি। তার পাশ দিয়ে হাঁটা বড় দায়। তৈমুর খান এদিক থেকে আলাদা। ধান ক্ষেত থেকে উঠে রাজ সিংহাসন পর্যন্ত পায়ে হেঁটে আসা ব্যক্তি বলেই তার সখ্যতায় কোনও জটিলতা নেই। অনন্ত ভালোবাসার মানুষ কবি গদ্যকার তৈমুর খান ভালো থাকুক, নিরন্তর লিখে চলুক। যেভাবে তিনি বিভিন্ন কবিদের নিয়ে লেখেন এভাবেই বিভিন্ন কবির ইতিহাস লেখক হয়ে উঠুক। আমাদের দৈন্য সমাজে কিছু কিছু দীনহীন সমাজপতি ও সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের নিচুস্তরের শিল্প সংস্কৃতিকে কোনও দিন মান্যতা দেয় না। কবিতার ক-জ্ঞান নেই অথচ তাকে নিয়ে হৈচৈ করে সন্মানিত করা উচ্চ শ্রেণীর সমাজ যেভাবে করে থাকে, সেইভাবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ও তথাকথিত নিম্ন বর্ণের কবি সাহিত্যিকদের অবজ্ঞা করা এই সমাজের চরম অমানবিক আচরণ তার উদাহরণ পল্লীকবি কেষ্টমুচি। দেওয়ান না হলে পল্লীকবি গুমানী কি মর্যাদা পেতেন! আমার ঠাকুর্দার বন্ধু ওয়াহাব বিশ্বাস কি পেয়েছেন?
তার কবি তৈমুর খান এর উপর আস্থা অনেক। তিনি কাব্যজিজ্ঞাসার পরিসর বিস্তারিত করুন।
সুভাষ রবিদাস
মিঞাপুর রঘুনাথগঞ্জ মুর্শিদাবাদ পিন নম্বর 742235 /মো (+91)7076801041.
কবি তৈমুর খাঁনের ‘ভালবাসা খুঁজতে খুঁজতে’
আব্দুর রহমান
তৈমুর অসুস্থ সময়ের আত্মদহনের কবি।বিকলাঙ্গ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘূণ পোকায় কাটা সংক্রমণ ক্ষতকে তির্যক বাণে বিদ্ধ করে জীবনের ভালবাসাকে খুঁজে পেতে প্রাণের নিউক্লিয়াস উপলব্ধির জন্য শব্দ বাণে কবিতাকে রসময় করে তুলেছেন। তাঁর কবিতা সমাজের ক্লিন্নতাকে প্রকাশ করলেও জীবন থেকে বিচ্যুত নয়, বরং জীবনের রূপ রস গন্ধ স্পর্শ রয়েছে, রয়েছে নির্মল আনন্দ। এ আনন্দ উঠে এসেছে ভালবাসার কথায়, ভালবাসার সন্ধানে। “Poetry is just the evidence of life. If your life is burning well, poetry is just ash”.
কবি জীবন পুড়িয়ে বার করেন নিটোল ভালবাসা। তাই বলতে পারেন, মিথ্যা নয় এখনও সে কথা, মিথ্যা নয় বলে ভীরুতা সমূহকে হত্যা করে প্রিয় দয়িতের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারেনঃ
“নিজের ভেতর থেকে নিজে বেরিয়ে এসে
আরও একবার বলিঃ ভালোবাসি!”(ব্যাকরণ)
‘ভালবাসা খুঁজতে খুঁজতে’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে ৪১টি কবিতা। প্রথম কবিতা ‘সাক্ষাৎকার’ ও শেষ কবিতা ‘জব্দ’। শব্দলেখা থেকে প্রকাশ পেয়েছে। প্রথম প্রকাশঃ ২০২১, কবিতাগুলি ২০১৭–২০২০ সালের মধ্যে রচিত। পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে প্রথম কবিতাটি তুলে দিচ্ছি:
সাক্ষাৎকার
আমার অসহ্য রাতে কারা দুয়ার খুলে ঢোকে?
ঘুম নেই অনন্ত বিস্ময় চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে
নিভৃত বেঁচে থাকাগুলি
যদিও কাল্পনিক মরু ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসে
যদিও তেজি ঘোড়ার পিঠে ছুটেছে কুমারী স্বপ্নগুলি
যদিও বিশ্বাস এসে আমার কপাল ছুঁয়ে গেছে
খোলা দরজায় তবুও বিচ্ছিন্ন আর্তনাদ
সব বিবরণ দিয়ে গেছে
যদিও বাতাস উড়িয়েছে মৃত ফুলের পরাগ
প্রজাপতির স্মৃতির ভ্রমে কেঁদেছে নিশিরাত
করুণার জল দাও তবে
আজ সব সাক্ষাৎকার হোক নীরবে নীরবে
***
রাত্রিবেলা মানুষের কাছে স্বস্তিকর, প্রশান্তির কিন্তু পরিশ্রান্ত মানুষেরও ঘুম নেই। এই ঘুম না আসার কারণ কোনো মানসিক নয় বরং অসহ্য রাতে দুয়ার খুলে যারা ঢোকে তারা জীবন যন্ত্রণার, অনধিকার অনুপ্রবেশকারী, মানব সমাজের অশান্তির কারণ।ফলে অনন্ত বিস্ময় চিহ্ন হয়ে যায় নিভৃত বেঁচে থাকা। এক অস্থির জীবনের অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ে কল্পনার সুখের মধ্যেও। ফুলের পরাগ প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠার অনিবার্য পরিণাম স্মৃতির ভ্রমে পরিণত হয়। মানবিক কবি ভালবাসা খুঁজতে যে অন্বেষণে কুমারী স্বপ্নের কথা বলেন তা যেন বিশ্বাসের স্থিতি পায় না। এর পরেও কবি প্রিয়জনের সাক্ষাৎকার চেয়েছেন নীরবে। নীরবতা মানুষ গভীরে স্থান পেলে সে বাস্তবিক করুণার জল পেয়ে স্থিরতা পেতে পারে।
‘সাক্ষাৎকার’ কবিতায় কতগুলি চিত্র খুব সহজে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ‘অসহ্য রাত’, ‘অনন্ত বিস্ময় চিহ্ন’, ‘কাল্পনিক মরু’, ‘তেজি ঘোড়া’, ‘কুমারী স্বপ্নগুলি’, ‘মৃত ফুলের পরাগ’, ‘প্রজাপতির স্মৃতির ভ্রমে’, ‘নিশি রাত’, ও ‘করুণার জল’। এক একটি শব্দ গুচ্ছ ভাবের বাহন, প্রকাশ রীতির নির্মাণ, বস্তুকে বিভিন্ন কোণ থেকে দেখা, মানসিক অবস্থার প্রতিফলন ও বিকৃতি, কনট্রাস্ট দেখানো হয়েছে। এই কবিতায় রয়েছে অভিব্যক্তিবাদ(expressionism),ও নির্মিতিবাদের সংশ্লেষণ। কবিকে কোন এক রীতিতে সীমাবদ্ধতায় সীমায়িত করা যায় না। এই কাব্যের অনেক কবিতার নির্মিতিতে দেখা যায় অনুরূপ বৈশিষ্ট্য। ‘কাল্পনিক’ কবিতায় কবি বাস্তবতাকে দেখানোর পরিবর্তে বাস্তবতার বিকৃতিকে বাঘ,ময়ূর ও মাছি হয়ে দেখাতে চেয়েছেন, এ সমাজে সাফল্য অধরা। ‘জালে আটকে থাকি কল্পনার দুরন্ত এক মাছি।’ বাঘের ব্যাঘ্রত্ব নেই, অথর্ব বাঘ। ময়ূরের নাচ ময়ূর হয়ে নাচতে অসমর্থ। কবির মন ঘিরে থাকে কল্পনার বৃত্তে সেখানে আটকে যান। যে দুর্দমনীয় সাহস ও বলে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সাফল্যের মুখোমুখি হওয়ার কথা তা তিনি পারছেন না।
‘শিকারি’ আশা, উদ্দীপনা ও প্রতিবাদের কবিতা।
‘জাগরণ থেকে আরও গূঢ় জাগরণে
মিশে যাক আমাদের অনন্ত প্রহর’
বাক্য ও ক্রিয়ার ব্যবহার শিখে শব্দের টংকারে কবি ধনুঃশরের উজ্জ্বলতায় জাগরণ চেয়েছেন।
‘পরকীয়া’ কবিতায় রিক্ত, শূন্যতার পাশে মাঠ জুড়ে স্বপ্নের লাশ, একটা হতাশা ও বিপন্নতা রয়েছে। কবি ভিজতে চেয়েছেন মনে মনে। যে মেঘ ঠিকানা হারিয়েছে সেই মেঘ আর যাই হোক প্রেমের আকাশে আনাগোনা করতে পারে মনে। তার অভিমানও হয়ে যায় নিঃস্ব। কবিতার মধ্যে দীর্ঘশ্বাস, না পাওয়ার বেদনাও রয়েছে। তাই বুঝি কবি বলেন,
“ আজ মেঘ ফিরে যাও
পৃথিবীতে কলঙ্কিত সব পরকীয়া”
‘দেশজ’ ও ‘সীমানা’ দেশ, কাল ও স্থানের হয়ে কবি দেশ কাল ও স্থানের সীমারেখায় চিন্তা চেতনায় আবদ্ধ নন। কোন ভালো কবি মানুষ সৃষ্ট সীমারেখা মানেন না। বিশেষ করে সীমানার শৃঙ্খলে মানুষকে বেঁধে মানুষ হিসেবে মানুষকে অপমানিত করে সেই সীমারেখার বিরুদ্ধে সাধারণত কবিরা সোচ্চার হন। কবি তৈমুর খান প্রশ্ন তুলেছেন:
“বোঝাতে পারিনা রাষ্ট্রকে
রাষ্ট্র কেন শুধু ধর্ম ব্যাপারী?”(‘দেশজ’)
‘দেশজ’ এই কাব্যের একটি নিটোল সুন্দর কবিতা। মানুষ তো দেশজ। সে তো দেশ রক্ষা করে। দেশের জন্য লড়াই করে। মৃত্যুকে পদানত করে দেশের স্বার্থে শত্রুর সামনে উন্নত শির তুলে হাতে হাত রেখে যুদ্ধ করে। তবু তার দেশ নেই কেন? কেন মানুষকে রাষ্ট্র দেশহীন করে তোলে? কবি গভীর চেতনায় প্রশ্ন তুলেছেন,
হৃদয়ে একটি মানুষ বাস করে
তার তবে কি পরিচয়?(‘দেশজ’)
কবি মানুষের মধ্যে ভেদ চান না। সীমারেখাও চান না। বিভেদ বৈষম্য বিভাজন তৈরির অন্যতম সোপান সীমানা বা বাঁধ দেওয়া। সীমানা তৈরি করে মাটি মৃত্যু ভাগ হয়ে যায়। এই বিভাজন আর যায় হোক,দেশ নয়। ফলে ‘দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সব মহিমার লাশ’ দেশের বিকল্প দেশ নয়। কবির জিজ্ঞাসা – “কোন সীমানায় রাখবে আমাকে?”(‘সীমানা’)
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিভাজনকে গুরুত্ব দেয়। বিশেষ ধর্ম আর এক ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইয়ের মধ্য দিয়ে হিংসা ও বিভাজন গুরুত্ব পেয়ে যায়। রাষ্ট্র সব মানুষের জন্য। সব শ্রেণীর মানুষের জন্য । সমান অধিকার অর্জন ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ দেশজ হয়ে ওঠে। অথচ রাষ্ট্র নাগরিকের মধ্যে ধর্মীয় পরিচিতি খুঁজে। কবির বেদনা ও আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে ‘সীমানা’ কবিতার এই চরণে–
“মাটি ভাগ করে নিয়ে
মৃত্যু ভাগ করে নিয়ে
বেঁচে আছে দেশ,
দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সব মহিমার লাশ।”
কবি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে চরম সত্যি কথা বলেছেন এ কবিতাতে:
“দেশ কি দেশের বিকল্প হতে পারে?
হৃদয় কি হৃদয়ের?”
আর যা হোক এর উত্তর অস্ত্যর্থক নয়, নঞর্থক।
‘শিল্পী’ কবিতায় বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, প্রিন্ট মেকার,মৃৎশিল্পী,নকশাকারী কবি ও নাট্যকার পিকাসোর নাম রয়েছে। “রাত জেগে পিকাসোর ঘরে বসে থাকি” পিকাসো ছিলেন কিউবিজম -এর সহপ্রতিষ্ঠাতা। কবিতায় রয়েছে কিউবিজমের ছায়া। পৃথক পৃথক ছবি বা বস্তু নয়। গুরুত্ব পায় সমগ্রতা। ক্ষয়ক্ষতি,তুলির আঁচড়, কল্পনা আছে ,হাসির ঝিলিক আছে; সব মিলে কবি খুঁজতে খুঁজতে চলে যান নিরিবিলিতে ,—সেখানে ব্যঞ্জনার রাতে সভ্যতার করুণ কুমারী কল্পনা ছেড়ে বাস্তব হয়ে সময়ের ঝরনায় গা ভাসায় নদী। কবিতাটি প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ভাবে কল্পনায় সুন্দর সৃষ্টি।
কাব্যের শিরোনাম ‘ভালবাসা খুঁজতে খুঁজতে’। কবি বিভিন্ন কবিতায় অন্বেষণ করেছেন মানবিকতার সম্পর্ক, যে সম্পর্ক মানুষকে চেনাবে ভালবাসার চেতনা। বাস্তবতা নিয়ে রয়েছে সংশয়,ভয়। কখন কে কীভাবে জব্দ এসে জব্দ করবে বলা কঠিন। এমন সময়ের মুখোমুখি মানুষ যে কথা বলাটাও জব্দ রেখায় পড়ে যায। কবির লেখায়:
“সাইকেল চালিয়ে বারোক্রোশ যেতে যেতে
রাস্তার ধারে কারো কাছে জল চাইতে পারব না
কারো বাগানে পোষা ময়ূরের নাচ দেখার জন্য দাঁড়াতে পারব না
রাস্তার ধারে কলা গাছ নুয়ে থাকলে
বলতে পারব না সরিয়ে নিন
হাওয়া কোন দিক থেকে উঠবে
কোন দিক দিয়ে বয়ে যাবে
আমরা কেউ জানিনা”
এই ধরণের ভয়ার্ত পরিবেশে কবি ভালবাসা খুঁজতে কাব্য পরিক্রমায় শূন্যতা অনুভব হওয়া স্বাভাবিক। শূন্যতার অন্তর্লীন প্রবাহে ভয়ও থাকে না কিন্তু কবি শূন্যতার লীন পর্যায়ে যাননি।ফলে ভয়, আশঙ্কা, বিব্রত ভাব অনেক কবিতায় দেখা যায়। ‘বিস্ময়চিহ্ন’ কবিতায় কবি মৃত্যুর কাছে জীবনের চাবি চাইতে এসে লজ্জিত। এই মৃত্যু সব কিছু ত্যাগ করে চলে যাওয়া নয়; একটা যন্ত্রণা। না পাওয়ার অব্যক্ত অভিলাষ। যে প্রেম একদিন অস্পষ্ট ছায়াময় ইঙ্গিত মাত্র ছিল সে প্রেম আজ কবির কাছে প্রচ্ছদ। সেই টান যেন তাদের ‘পরস্পর বিস্ময়চিহ্নের মতো মনে হয়।’ ‘ছিদ্র’ এই কাব্যের একটি বিশেষ কবিতা–যা কবির মনন ও চেতনাঋদ্ধ। চারদিকে গরল ভয় আধিপত্য ধর্মশালার ধর্মদাসত্ব ,রাজনৈতিক আতঙ্কের মধ্যে কবি খুঁজতে চেয়েছেন ‘আমি’ নামের অস্তিত্বকে। এই অস্তিত্বের মর্মমূলে রয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা কিন্তু সমাজে এত ছিদ্র,যে ছিদ্র গুলি বড় হতে থাকে আর আমরা চরিত্র নষ্ট করার জন্য বেরিয়ে পড়ি। এখন আমরা কলঙ্কের সঙ্গে খেলা করি। এ খেলার সঙ্গীর কোন অভাব নেই ‘আমাদের আকাঙ্ক্ষারাও ক্রমশই বেশ্যা হতে থাকে।’কবি সময়কে অঙ্কন করেছেন সময়ের চিত্রকল্পে। কবির কন্ঠে ধ্বনিত –
“আমাদের ভোর নেই”
এরকম পরিস্থিতির মধ্যেও ‘কী করে বোঝাই তোমাকে’ কবিতায় দেখা যায় প্রেমের প্রত্যাশা।
“হৃদয়ে রেখেছি তোমার হৃদয়ের কাছে
বোধের প্রদীপ জ্বেলে আলো হোক ঘর
আলোফুলে আরতি হবে প্রেমের সংসার।
এর পরে কবি দৃঢ় প্রত্যয় বলেছেন, “সম্পর্ক মরে না কখনো নীরবতাও তা জানে।”
সমাজের এই অন্ধকার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পথ খোঁজার জন্য কবি মানুষের ভালবাসাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে এর জন্য একটা ‘রাস্তা চাই’। ‘রাস্তা চাই’ কবিতায় কবি বলেছেন,
“ সময় খারাপ। সবাই অন্ধকারের দিকে
চলে যাচ্ছে একে একে”
মানবিকতার মৃত্যু আজ আর কাউকে ব্যথিত করে না। রাজনৈতিক শকুনেরা এসে খাচ্ছে লাশ। আর সাধারণ মানুষের কোন রাস্তা নেই।
“অস্ত্রশস্ত্রে গরম হচ্ছে হাওয়া
রাস্তা হারিয়ে ভুল রাস্তায় পাহারা দিচ্ছে অন্ধ দেবতারা”
এই শঙ্কাতুর বিপন্ন সময় থেকে বেরোনোর জন্য সত্যিই আজ একটা রাস্তা চাই।
***
আব্দুর রহমান
ভগবানগোলা, মুর্শিদাবাদ
মোবাইল নং 8250788035
ক|বি|তা
ড.তৈমুর খান
গৌর গোপাল পাল
ভালো লেখেন বললে সেটা
কম বলা হয় মানি!
তৈমুর খান বোঝেন যেটা
আমরা ক'জন জানি!!
গদ্য-পদ্য দুই লেখাতেই
সমান হস্ত তার!
প্রাজ্ঞ তিনি আমার মতেই
বলবো কি তা আর!!
সমীহ করি আমিও তারে
ভালোই জানেন তিনি!
পাকা হাতের লেখার ভারে
ভালোই কাটেন তিনি!!
মাছ আমরা অল্প জলের
তাইতো লাফায় বড়!
তৈমুরদা মোর জীবনের
অনেকখানি দড়!!
প্রিয় তৈমুরকে
মুহা: আকমাল হোসেন
এখানে তুর্কি লহরে শব্দ-ঘোড়ার নাল বেজে ওঠে
সমরখন্ড থেকে সিন্ধু উপকূল কবিতার বাগান।
যুদ্ধ শেখা তৈমুর
ডান পায়ে বল্লম খাওয়া তৈমুর
অভাবের তিরবিদ্ধ তৈমুর!
দগ্ধ ভোরের জাফরি জানালায় মুখ রেখে
বিষাদের কবিতার শেষে
একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ
বৃষ্টিতরু অরণ্যের ফুসফুস হয়ে ওঠে।
যেখানে জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা
সাহিল জুড়ে তরঙ্গ লীলায় দেখি মাধুর্যের বসতি।
তবু, স্তব্ধতার ভিতর এক নিরুত্তর হাসি
কোথায় পা রাখি!
আয়নার ভিতর তু যন্ত্রনার দগদগে ঘা
খা শূন্য আমাকে খা!
তবু, জ্বর তাবুর নিচে বসন্তের ডাকঘর
ডাক আসে, তৈমুরের ঘোড়ার ক্ষুর শোনা যায়
শুধু জয় নিয়ে ফিরছে বাংলা কবিতার।
ছোট সুজাপুর মালদা-৭৩২২০৬ পশ্চিমবঙ্গ
কথা -৯৭৩৪৯৩৪৪৯৭
তৈমুর খান
পরাণ মাঝি
সেই শিশুটিকে চিনি আমি ; ছোটো বেলায় পাখিদের সাথে গান করে বেড়াতো ফুল গাছের নীচে। গাছে ফুল না ফুটলে কাঁদতো; ঝিঁঝি আর প্রজাতি দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো আকাশ পানে । ধানের ক্ষেতে যেতে যেতে আলপথে ঘাসফুল দেখে কবিতা বলতো ঝরঝর করে।
বৃষ্টি এলে বজ্রপাতের মতো উঠোনে গিয়ে করতো ছোটাছুটি। শীতের রাতে টিনের চালে টুপটাপ শিশির পতনের শব্দ শুনতো উদাস হয়ে।
এখন সে শব্দ সাজিয়ে মানুষ আাঁকে
প্রেম লেখে
সু- ব্রতের সুর সাধে
ধর্ম আর রাজনীতি থেকে সে থাকে অনেক দূর
নাম তার শব্দ সাধক তৈমুর
কর্ম-ই তার বর্ম ; বেসুরে পাতেন-ই না কান
সে কবিকেও আমি জানি; পদবি তার খান
কপিরাইট -- পরাণ মাঝি / 141220240035
Poran Majhi
Kolkata --99,Mob --9007753772, WhatsApp -- 6289304574
শ্রদ্ধেয় কবি, গদ্যকার তৈমুর খানের জন্যে
অমিতাভ সরকার
কবির সঙ্গে কথা হয়। সামনে দেখেছি মোটে একবার, তবে গল্প শুনেছি অনেক- জীবনের বাঁক্ অভিঘাতে ভরা সত্যের চির অন্বেষণের গল্প।
ওঁর সব কবিতাই যে পড়া হয়- তা কিন্তু নয়, কিছু পড়ি, তাতেই আবিষ্ঠ হয়ে অক্ষরের দীঘিপুকুরে ডুব দিই (তবে বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে পারি না), লাভ করি মনের নিবিড় শান্তি, সেই সাথে মুক্তির খোলা আকাশে চোখ মেলে তাকাই, দেখি সময়ের মেঘেদের সাথে কিভাবে শব্দের জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, কিভাবে সভ্যতা কাপে এক বিস্ময়ের জ্বরে, আবার কখনো হারিয়ে যাই কবির ভাঁড়ারের চাবি খুঁজতে (বলাবাহুল্য চেষ্টা করি, তবে পাই না। খুঁজে পেতে আমার এখনো অনেক দেরি আছে।)
আবার সেখান অনেক কষ্টে ফিরে আসা। লিখতে গেলে কষ্ট করতে হয়, কষ্ট পেতে হয়। তাই আবারও অন্তরের দু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি কবি-আত্মার 'আত্ম সংগ্রহ', 'আত্মক্ষরণ', 'আত্মস্বর'-এর জীবন বর্ণমালার প্রতিটি ছত্রে। বুঝতে পারি না কোথায় পা রাখি। যেখানেই পা রাখতে যাই, দেখি সেটাই সমুদ্র হয়ে গেছে।
কবি সাধনা করে চলেন। অতি সাধারণ, আটপৌরে জীবনে আরেকটু বেশি কষ্ট লাভের সাধনা।
আমি বিস্মিত হই।
'প্রাচীন পৃথিবীর রহস্য-আলোয় জল খেতে এসে দেখি সব ঝরনায় আমারই ঈশ্বর হেসে ওঠে...'
অমিতাভ সরকার,
ইন্দ্র স্কয়ার, ফ্ল্যাট ৩ এইচ, ৫ কে বি বসু রোড, বারাসাত, কলকাতা-৭০০১২৪, ফোন-৯৪৩২২৮৩১৭৪, ৯৮৭৫৫৮৭১৭১
--------------------------------------------------
কবি তৈমুর খান : এক ধূলিমলিন যাপনের প্রজ্ঞাময় উত্তরণ || অনিমেষ মণ্ডল
শূন্যতার এক গভীরতর বোধ অনেক ছোটবেলা থেকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নব্বইয়ের অন্যতম কবি তৈমুর খানকে।সেখান থেকে তিনি কোনদিন বেরিয়ে আসতে পারেননি। হয়ত চানওনি।কারণ কৃত্রিমতার দাসত্ব করা তাঁর মতো স্বাধীনচেতা সাহিত্যিকের পক্ষে কখনোই সম্ভব ছিল না।তাই যে পথ যন্ত্রণার সেই গভীরতম পথের তিনি চিরপথিক।অনেক অপমান, তিরস্কার, লাঞ্ছনা সহ্য করেও তিনি এক দীর্ঘ চরাচর জুড়ে হেঁটে যান।আর পথের প্রান্তে খুঁজে পান আলোর দিশা।সেই আলো মুক্তির,গৌরবের,মানব হৈতষণার।
এক সংযত জীবনবোধ নিয়ে তিনি অকাতরে বাংলা সাহিত্যের সেবা করে গেলেন।হয়ত দিনমজুরের ছেলে হিসেবে এ তার গভীরতম স্পর্ধা।কিন্তু সেই স্পর্ধাই হয়ে উঠল এক দুঃসাহসিক অভিযান।নব্বইয়ের একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করাতে বাধ্য করলেন বাংলা সাহিত্যের তাবড় ব্যক্তিত্ববর্গকে।এ জয় মানবতার জয়,গ্রাম বাংলার বুকে চিরজাগরুক হীন দীন মনুষ্যত্বের জয়, যে মনুষ্যত্ব প্রতিদিন পথেঘাটে অপমানিত হতে থাকে।তৈমুর যেন তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করলেন।মানবতার প্রতি আজীবনের বিশ্বাসবোধ থেকে মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন জয়ধ্বজা।যেখানে দেখেছেন সভ্যতার ইতিহাসে মালিন্যের করাল ছায়া সেইখানে মানবতার জয়গান গাইতে ধরেছেন শব্দের মতো শাণিত অস্ত্র যা যে কোনো ভন্ডামির বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।কবি তৈমুর খান সেই আলোর পথের যাত্রী।ভন্ডামির সমস্ত মুখোশ খুলে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ওঠেন প্রজ্ঞাময় এক যাপনের দিকে যা একদিকে যেমন সরল,ঋজু অপরদিকে তেমনি ভয়ঙ্কর।
সে বহুদিন আগের কথা।সম্ভবত ১৯৮৮-৮৯ হবে।সেই সময় রামপুরহাট থেকে একটি পত্রিকা নিয়মিত বেরুত যার নাম বিকল্প।সেই বিকল্প পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বাহারুল ইসলাম।রামপুরহাটের সানঘাটা পাড়ায় সম্ভবত বাহারুলদার একটা দোকান ছিল।সেখানেই তৈমুর দার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ।আমি তখন ক্লাস নাইন ।সেদিন বিকল্প পত্রিকার সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন "যেদিন তৈমুরের মতো কবিতা লিখতে পারবে সেদিন তোমার কবিতা ছাপা হবে"।বলার অপেক্ষা রাখে না সেদিনের সেই কবি যশোপ্রার্থী এই আমি কয়েকটি কাঁচা কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছিলাম বিকল্পের দপ্তরে।এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে তৈমুরদার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ঐ বিকল্প পত্রিকাতেই এবং পরবর্তীকালে দুই বাংলার অগ্রগণ্য প্রায় সব পত্রিকায়।সেই সময় থেকেই তৈমুরদা আমার কাছে একটা দিকচিহ্ন ।পরবর্তীতে আমি নিজে অনেক ভাঙন আর উত্থানের মধ্য দিয়ে গেলেও প্রথম কৈশোরের সেই মাইলফলক আমি আর ভুলতে পারিনি কোনদিন।অবচেতনেই তা হয়ত খানিকটা জায়গা করে নিয়েছে আমার মনে।
একদিন এক বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে গোচারণ করতেন বলে হয়ত খুব কাছে থেকে দেখেছেন জীবনকে।মানব অস্তিত্বের যে কত বাঁক থাকে তা এই কবির পরিচয় না জানলে বোঝা যায় না।বাবা দিনমজুর।অনেকগুলো ভাইবোন।তাই পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তাকেও করতে হয়েছে দিনমজুরের কাজ।এর জন্য কোনও দৈন্যতা নেই তাঁর মনে বরং সেখান থেকে সংগ্রহ করেছেন উত্তাপ।মানবিকতার উদ্ভাসনের দিকে এক দীর্ঘ যাত্রাপথের সূচনালগ্নেই অঙ্কুরিত হতে শুরু করে তাঁর শিল্পসত্তা।এক চিরন্তন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেন এক গভীর অথচ করুণ পরিণতির আলো।
দুবেলাই ঘাস কাটি মজুরের ছেলে
কাঠখড়ের উষ্ণতায় রাত্রি করি পার
তবুও পার্টির লোক আমার দরজায়
না বাপু, কামাই হ'লে আমিই উপোস
কী খাই কী খাই সারাদিন .....
মিছিলের লাল ধুলো, ঘুরবে আকাশ
আর একটু দাঁড়াও কার্ল মার্কস
কয়েক শতাব্দী আরো কেটে নিই ঘাস।
এই রকম সব সুগভীর তত্ত্ব কবি তৈমুরের কবিতাকে ছাপিয়ে জনারণ্যে মিশে যায়।তখন সেটি আর তার কবিতা থাকে না একটা প্রবাদের মতো ঘুরতে থাকে মানুষের মুখে মুখে।হাওয়ার ঘূর্ণি হয়ে ভেসে বেড়ায় আর জীবনের মানে খোঁজে।এইখানে কবি তৈমুরের উত্তীর্ণতা।
তাঁর কবিতার শব্দেরা নিঃশব্দে ফুটে থাকে রাতের জেগে থাকা তৃণের শীর্ষে।শিশিরে শিশিরে ধুয়ে যেতে যেতে তারা দেখতে পায় নক্ষত্রের মায়ালোক।তখন অবলীলায় ভুলে যায় একজীবনের সব যন্ত্রণার কথা,সমস্ত অপমানের কথা।ভুলতে পারে বলে উত্তীর্ণ হয় নিরাসক্ত বোধির কেন্দ্রে।তখন কবি ফিরে পায় বিশ্বাস।এক স্বপ্নের জগত ফুটে ওঠে তাঁর চেতনায়।গভীর নীরবতার ভিতর দিয়ে অনিঃশেষ নীলিমায় সে খুঁজে পায় এক অনির্ণেয় গন্তব্য।এই অনির্ণেয় গন্তব্যই তো আবহমানের কবিতা।
নিজেকে তিনি বারবার নির্বাসিত করেছেন নির্জনতায়।দূরে দিনাতিপাতের অশ্রু ঝরে পড়েছে সবার অলক্ষ্যে।এই স্বার্থপর সভ্যতার করাল অট্টহাস তাকে একেবারে ভেঙেচুরে দিয়েছে।কিন্তু তিনি তো আর দশজনের মত সাধারণ নন তাই নিজেকে নিঃস্ব করতে করতে সেই দুঃসহ ক্ষয় আর দহনের ভিতর থেকে খুঁজে নিয়েছেন জীবনের ভাষা।সারাজীবন ধরে একটাই সত্য খুঁজে ফেরেন কবি তৈমুর খান সেই সত্য অপরাজিত জীবনের, অকৃত্রিম ভালোবাসার, প্রেমময় মানবতার।
হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান তৈমুর ছোট থেকেই দারিদ্রতার সম্মুখীন হলেও সারস্বত সাধনা থেকে কোনওদিন বিচ্যুত হননি।এ-ও কি একপ্রকার সংগ্রাম নয়!১৯৮৪ সালে কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ দিয়ে যে কবিজীবনের সূত্রপাত তা পরবর্তীতে এক নিজস্ব গন্তব্যের দিকে উচ্চতায় দৃঢ় হয়ে আছে।রামপুরহাট কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে সাম্মানিক সহ বি এ উত্তীর্ণ হয়ে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ও সেখান থেকেই ২০০১এ প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ।এই সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রাপথ একদিন দিন মজুর জিকির খানের ছেলেকে দিয়েছিল অন্য এক কক্ষপথের পরিচয়।তাই পথ যত উচ্চতাতেই আরোহণ করুক না কেন বহুদূরে জনান্তিকে ফেলে আসা আবাল্যের গ্রাম আর তার মানবযাত্রার সকরুণ পদচিহ্ন কবি কোনদিন ভুলতে পারেননি।
দূরের কাছের বন্ধু এসেছে সবাই।
আমি কারও কেউ নই সঙ্কোচে জানাই।
সবাইয়ের তাড়া আছে।তাড়া থাকা ভালো।
আমার কোনও তাড়া নেই।তারা নিভে গেল।
কত কান্না ঝরল চোখে।ছুটল কত নদী।
নদীকে বন্দনা করি আজও নিরবধি।
দুঃসময় ছুঁয়ে যায় অন্ধ পাখির গানে ।
সেই স্বরলিপিতেই পাই জীবনের মানে ।
একেবারে নিজস্ব স্বরলিপি লিখতে চেয়েছেন কবি তৈমুর।সেই স্বরলিপি জীবনের,আকাশের ,নদীর, তারার,আর ব্যর্থ মানুষের ।কারণ তাদের সঙ্গেই তো কবির আত্মীয়তা।আর আছে দূরের বন্ধু, কাছের বন্ধু সবাই।কবির কোনও তাড়া নেই।সবার সঙ্গে উদযাপনের এইতো প্রকৃষ্ট সময়।কর্মে ও কথায় যা অর্জন করেছে আত্মীয়তা।এ কোনও সৌখিন মজদুরি নয়।প্রতিটি কথায় তার ফুটে উঠছে বিশ্বাস।যে বিশ্বাস ফিরে পেলে মানুষ গান গাইতে পারে। চিরদিনের গান।নীরবতার ভিতর দিয়ে অনেকটা পথ পেরোনোর পর যে নীরবতার অন্য এক মানে খুঁজে পায়, তৈমুর সেই নীরবতার কবি,তৈমুর সেই মুখরতার কবি।
এই কবির আর এক অস্ত্র হলো ভালোবাসা।ভালোবেসে তিনি বিপন্নতাকে জয় করতে চান।মানবতার ধ্বজা উচ্চে তুলে রাখেন বলে মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে পারেন না।মানবতার অপমান তাঁকে অস্থির করে তোলে।সেই অবস্থায় তিনি খুঁজতে থাকেন মায়ের স্নেহের কোমলস্পর্শ,প্রিয়ার বিনিদ্র উৎকণ্ঠা।এসবের জন্য কবি ভিক্ষুক হতেও রাজি।কারণ তিনি জানেন প্রেম আর ভালোবাসাই সমস্ত বিদ্বেষ দূরে সরিয়ে মানবমহিমার উদযাপন করতে পারে।একমাত্র মানুষের পরিচয় নিয়ে তিনি বেঁচে থাকতে চান বলে মানবতা বিপন্ন হলে যারপরনাই ব্যথিত ও বিরক্ত বোধ করেন।ধর্ম ও সম্প্রদায় থেকে তার কাছে মানুষের পরিচয় অনেক অনেক বড়।সেই পরিচয় যে বা যারাই ক্ষুণ্ণ করে তিনি তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন স্বাভাবিকভাবেই।
রাষ্ট্র যদিও অরণ্য, অহরহ গর্জন শুনি
কখনও শিকার হই,কখনও খেচর হয়ে উড়ি
বিপন্নতা আসে আর মুখোশ পরে হাসে
আতঙ্ক খুঁটে খুঁটে রোজ নিরিবিলি খোঁজ করি
তার কবিতা ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে।বর্তমান ভারতবর্ষের ভীরু ও দুর্বল মানুষের যাপনচিত্র তুলে ধরে।সময়কে ধ্বনিত করে প্রবলভাবেই।তার কবিতা যতটা না শিল্পসচেতন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় সচেতন।এবং আমার মনে হয় তার মতো কবিতাবোদ্ধা এটা সচেতন ভাবেই করেন।সময়ের ভ্রূকুটিকে ধরতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেও পিছপা হন না।কারণ তাঁর দায় মানবতার কাছে।যেখানে মানবতার অপমান সেখানে তিনিও অপমানিত বোধ করেন।ঘৃণা করেন অশুভ শক্তিকে।তাই তিনি যতখানি না কবি তার চেয়ে অনেক বেশি একজন হৃদয়বান মানুষ।
নক্ষত্রমণ্ডল হাসিতেছে
রাত্রির নশ্বরেরা যাতায়াত করিতেছে
বাতাস তাহার বাতাসীকে ডাকিতেছে
সভ্যতা অসভ্যতাকে দেহ সমর্পণ করিতেছে
ধর্ম উলঙ্গ হইয়া অধর্মের ঘর করিতেছে
অধর্ম যখন ধর্মের টুঁটি চেপে ধরে তখন অসহায়তার বিবর্ণতায় ছটফট করতে থাকে তৈমুরের কবিসত্তা।কিন্তু তার লড়াই কোনও অসহায়ের আস্ফালন নয়।আবার সম্মুখ সমরে শাণিত অস্ত্রের ঝনঝনানিও নয়।কারণ রক্তপাত তিনি কোনোভাবেই চান না।তাই ভিতরে ভিতরে এক রক্তক্ষরণ ঘটে চলে ফল্গুর মতো।তার কাব্যে বা সাহিত্যে যে বেদনার ঘনঘটা আছে তা কোনও উদযাপনের বিষয় নয় অথবা কোনো উদযাপন থেকেও তা জারিত হচ্ছে না। বরং তা কবিকে দীক্ষিত করেছে।যে হতাশা আছে তা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়নি বরং উত্তীর্ণ করেছে।ব্যর্থতার যে গ্লানি তার সারাজীবন জুড়ে আছে তা কখনও কবি তৈমুরকে অভিশপ্ত করেনি বরং তা তাকে চিনিয়ে দিয়েছে মুক্তির উদ্বেল আকাশ।তাই তার লেখনীর ধারা নিরন্তর পাঠকের সঙ্গে এক গভীর যোগসূত্র স্থাপন করে চলেছে আজও।
জন্ম ২৮শে জানুয়ারি, ১৯৬৭, বীরভূম জেলার পানিসাইল গ্রামে।পিতা জিকির খান ও মায়ের নাম নওরাতুন বিবি।বর্তমানে স্থায়ী বসবাস রামপুরহাট শহরে।১৯৮৪-তে কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশ দিয়ে একদিন যে যাত্রাপথের সূচনা হয়েছিল তা আজ নিরন্তর সাধনের ভিতর দিয়ে দুই বাংলার মাটিকে স্পর্শ করেছে স্বমহিমায়।একদিন যে জীবিকার তাগিদে মুম্বাইয়ে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে চলে যায় গ্রামের আর পাঁচ জন যুবকের সাথে, পরবর্তীতে সেই নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে অংশকালীন অধ্যাপনার কাজ করেন।বর্তমানে একটি উচ্চবিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করে চলেছেন।এছাড়াও নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন বাংলা সাহিত্যের আর দুই সমান্তরাল ধারা গদ্য ও পদ্যের সৃষ্টিশীলতায়।সাহিত্যের এমন কোনো অঙ্গন নেই যেখানে তৈমুর খানের স্পর্শ নেই!তিনি কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ,মুক্তগদ্য,দীর্ঘকবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি।কত কত তরুণের প্রথম অথবা তৎপরবর্তী কাব্যগ্রন্থের উপর নিঃস্বার্থভাবে আলো ফেলেছেন তার কোনও হিসেব নেই।এসব তিনি করেছেন কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে।এই সমস্ত কারণে তাকে বাংলাসাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ গবেষকও বলা যেতে পারে।
সুদীর্ঘ এক কবিজীবনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে এ যাবৎ কবি তৈমুর খানের তেইশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো: কোথায় পা রাখি (১৯৯৪),বৃষ্টিতরু (১৯৯৯),খা শূন্য আমাকে খা(২০০৩ ) ,আয়নার ভিতর তু যন্ত্রণা (২০০৪),বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১),নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা(২০১৭), স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি (২০১৮), উন্মাদ বিকেলের জংশন (২০১৮), নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি (২০১৮), আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা (২০১৯),সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে (২০২২), সর্বনাশের ডায়েরি (২০২৪) প্রভৃতি।
এছাড়াও পদ্য ও গদ্যে সমান সাবলীল এই কবির আটটি গদ্যগ্রন্থ, একটি উপন্যাস ও একটি ছোটগল্প সংকলন আছে।তাঁর উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থগুলি হলো: কবির ভাঁড়ারের চাবি(২০০৬,২০১৮), আত্মসংগ্রহ(২০০৯,২০২২),মুক্তির দশক নব্বইয়ের কবি ও কবিতা (২০০৯,২০২১),আত্মক্ষরণ(২০১৬),কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা (২০২০),এই কবিতা জীবন (২০২৩) ইত্যাদি।একমাত্র উপন্যাস জারজ(২০১৯) ও একটি ছোটগল্প সংকলন জীবনের অংশ (২০১৯)।
তাঁর সাহিত্য ভাষাও অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময় ও যুক্তিনিষ্ঠ।তার গতি এত সাবলীল যে যেকোনো নিবিষ্ট পাঠকের তাতে কোনো অসুবিধে হবে না।নানা সময়ে ঘটে থাকা কবিতার বিমূর্ত বাঁকগুলি তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপট কীভাবে বদলে গেছে তাকে লিপিবদ্ধ করেছেন সুচারুভাবে।নিজে নব্বইয়ের কবি হয়ে নব্বই দশককে লিপিবদ্ধ করে রাখলেন গবেষকের পরিশ্রমে।কবিতার বাঁক ও রহস্যকে তিনি তুলে ধরেছেন রূপগত ও ভাবগত দিক থেকে।প্রতিটি শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের ভিতর যে এক প্রজ্ঞাময় মগ্নতার ক্ষেত্রভূমি রচিত হয় তিনি তাকে সবিশেষ চেনেন।কোনও স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অপরিচিত যেকোনো কবিস্বরের এমন গভীরতর খনন প্রয়াস বাংলা সাহিত্যে খুব বিরল।
সাহিত্য সাধক ও মানবতাবাদী কবি তৈমুর খান
নবকুমার মাইতি
'সহিত' কথাটি থেকে সাহিত্য শব্দের উদ্ভব। সাহিত্য জীবনের দর্শন, সমাজের দর্পন, সত্যের উদ্ভাবন। সাহিত্য মানব ইতিহাস রচনা করে, নীরবধি কালকে লেখনীর কালো অক্ষরে বেঁধে রাখে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-অপ্রেম, যুদ্ধ-শান্তি, ইতিহাস-দর্শন সবকিছু নিয়ে সাহিত্যের সুবিস্তৃত অঙ্গন। বিরামহীন পথচলা
চলমান সাহিত্যের ধারায় আমরা এগিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। বিশেষতঃ কাব্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, প্রাক-আধুনিক যুগ, আধুনিক যুগ পেরিয়ে বর্তমানে আমরা অবস্থান করেছি উত্তর আধুনিক (Post Modern) বা অনুনাস্তিকতার যুগে।
বর্তমান এই যুগমানসের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় বেশ কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে। সাহিত্যের সেই সুবিশাল অঙ্গনে অবিশ্রাম পথ চলা মানুষ বীরভূমের কবি ও প্রাবন্ধিক ড. তৈমুর খান। বর্তমান এই সময়ধারায় তন্নিষ্ঠ সাধকের প্রজ্ঞা নিয়ে যিনি আমাদের সাহিত্যের রসকৃষ্ণা মিটিয়ে চলেছেন সময় থেকে সময়ান্তরে, সমকাল থেকে ভাবীকালের পথ ধরে।
তৈমুর ধান সারাজীবনভর অজস্র কাবা কবিতা লিখেছেন, কাব্য সরস্বতীর সাধনায় নিমগ্ন থেকে শতসহস্র পাঠকের দরবারে তার অমূল্য সৃষ্টি ও সাধনার অর্থা তুলে ধরেছেন। আমি তাঁর অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ ও কবিতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণে না গিয়ে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম, মানবতা, ভালবাসা ও জীবনবোধের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরতে চাইছি আমার এই ক্ষুদ্র লেখনীর মাধ্যমে। বাকী কর্মের ভার থাকল পণ্ডিত তথা সাহিত্য রসবেত্তা ব্যক্তিগণের উপর।
বীরভূম জেলার খ্যাতিমান কবি তৈমুর খান সারাজীবন ধরে বহু কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। বৃত্তের ভেতরে জল, জ্যোৎঞ্জায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, উন্মাদ বিকেলের জংশন, স্বদ্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি, নির্ঘুমের ব্রহ্মধ্বনি, কাহার অদৃশ্য হাতে, ইচ্ছারা সব সহমরণে যায়, আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা প্রভৃতি। কবির কাব্যিক দর্শন পর্যালোচনা করে আমরা একটা দুঃখের দরিয়া বা মহাসমুদ্রের হদিশ পাই। তাঁর জীবন জুড়ে বিষণ্নতা, দুঃখ কষ্ট নিদারুণ লাঞ্ছনা বঞ্চনার বেদনাবিধুর আলপথ ধরে তিনি হেঁটে চলেছেন তাঁর গন্তব্যের অভিমুখে, যেন এক মগ্ন ভগীরথ, জগৎ ও জীবনের কল্যাণবার্তা নিয়ে। কবিতা নিয়ে আমাদের দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. এ.পি.জে. আব্দুল কালাম বলেছেন, "Poetry comes from the highest happyness or the dipest sorrow." অনুরূপভাবে তৈমুর খানের একটি কবিতার কয়েকটি চরণ পড়লে তা বোঝা যায় কবির অন্তর তখন দুঃখের যন্ত্রনায় কাতর ছিল, নাকি আনন্দের ধারায় প্লাবিত ছিল। যেমন 'বকের মতন' কবিতায়-
"একটি নদীর কাছে নিজের বিষণ্ণ জল
বয়ে যেতে দেখি-
জল কোন জলে ধোবে নিজের দেহ?
চারপাশে বিষণ্ণ আস্তাবল
ঘোড়াগুলি জাবর কাটে বিষন্ন ছায়ায়।"
কবি তৈমুর খান একজন সুভদ্র, নিরীহ, নির্জন কবি। তিনি আপাতত আশাবাদী হয়েও নৈরাশাবাদী। ধোঁয়া ওঠা জীবনের কথা বলেছেন ভেতরে দাহ চলেছে, চোখ জ্বলছে, দম বন্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও করি টমাস গ্রে-র মতে কবিতা হল "Poetry is thoughts that breath and words that burn."
তৈমুর খানের 'উল্টোদিকের হাওয়ায়' কবিতাটির ভেতর দেখা যায়-
"আমাদের সংসারকে বলা হয় পাঠশালা
আমাদের সমাজকে বলা যায় মহাবিদ্যালয়
আমাদের রাষ্ট্রকে বলা যায় বিশ্ববিদ্যানিকেতন
কিন্তু আমরা কোথাও মনযোগী পাঠক নই
বছরের পর বছর ফেল করা ছাত্র।"
এখন মানুষদের পশু বললে ক্ষতি নেই এ এক অকপট সত্য কথা। কবি তাঁর দারিদ্র্যের কথা বলতে এখন আর লজ্জা পান না।
অনেক অনুরাগী পাঠকের মতে কবি তৈমুর খানের বহু কবিতা বড্ড বেশী কঠিন, যা অনায়াসলব্ধ নয়। যদিও আমি আমার অভিজ্ঞতার দর্শন নিয়ে বলব, একালের ফেসবুক সর্বস্ব যে সমস্ত কবি ও কবিতা সমাজে হট্টগোল ফেলে দিয়েছে, নানারকম কাঠিন্য, ভাব-কুটাভাস, দম্ভ, অতি পাণ্ডিত্য, চাতুর্য সে সবের থেকে ঢের ভালোও সহজ সুন্দর সাবলীল উপমা উৎপ্রেক্ষা সহযোগে দার্শনিক চিন্তা সমৃদ্ধ কবিতা তিনি পাঠককুল তথা জনমানসে উপহার দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, দুরূহতা আধুনিক যুগমানসেরই প্রতিবিম্ব। প্রখ্যাত ইংরেজ কবি ও সমালোচক স্পেন্ডার এই দুরূহতার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বহির্জগৎ যতই আধ্যাত্মিক সম্ভাবনা হারিয়ে নিষ্ফলা মরুর রূপ ধারণ করছে কবিও ততই তার থেকে নিজেকে আলাদা করে দিয়ে এক অন্তর্লীন ধ্যানরাজ্য সৃষ্টি করেছেন। "The must of that excessive outwordness of a spirituality barren external world in the excessive inwardness of poets who prefer losing themselves within themselves to losing themsilves outside themselves in external reality."
বহির্জগতের চেতনা অন্তরের পটে ফোটাবার জন্য বা বহির্জগত থেকে পলায়ন করবার জন্য যে কারণেই হোক না কেন তিনি অন্তদৃষ্টির আশ্রয় নেন। কোন কোন ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে পাঠকের কাছে তা দুর্বোধ্য ঠেকে। তাই এমিল জোলা-র দৃষ্টির চেয়ে ব্যাঁবোর দৃষ্টি দুর্বোধ্যতর।
অবশ্যা সব সময় যে আধুনিক কবিতা হৃদয় দিয়ে বোঝা যায় বা সাধারণ মেধা দিয়ে বোঝা যাবে তা অবশ্য নয়, সেখানে দরকার বুদ্ধি, দরকার উচ্চ মনন ও ধী শক্তি। আধুনিক কবিতা, মানে বই-এর ছেঁড়া পাতাটি নয়, যা অতি সহজে হজম করা যাবে, তার জন্য আরও এক উন্নততর চেতনার প্রয়োজন। বিনির্মান সম্মত প্রসারিত আলোকবর্তিকার প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য। ইংরেজ কবি সেক্সপিয়ার বলেছেন-
"The poet's eye, in a fine frenzy rolling.
Doth glance from heaven to earth.
from earth to heaven."
William Shakeshpeare
আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসাবে শ্রেষ্ঠ গ্রীক সমালোচক লঙিনাসের লেখায় (Longinus-300 A.D.) বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব পাওয়া যায়। তাঁর সারাজীবনের সমালোচনাধর্মী সাহিত্য সাধনার নির্মল নির্যাস এই 'অন দ্য সাবলাইম' (On the Sublime) গ্রন্থে বলেছেন যথার্থ সাহিত্যের চূড়ান্ত বক্তব্য হল 'সাবলিমিটি', সাহিত্যের (কাব্য, নাটক, মহাকাব্য) মহত্বের শেষ কথা। আমাদের প্রিয় কবি তৈমুর খান সেই কথাই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর কাব্য-কবিতার পরতে পরতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ 'জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা' নামটির মধ্যেই রয়েছে রূপকথার রোমান্টিকতা। এই কাব্যের প্রথম কবিতা 'আশ্রয় প্রার্থনা'। এই আশ্রয় ভালোবাসার। কবি প্রশ্ন করেন 'সৌভাগ্যের ঘরে আর? সৌভাগ্য এবং সৌভাগ্যের ঘরে থাকা মানুষেরা একটি প্রশ্নচিহ্ন ও একটি না পাওয়া উত্তরের ভিতর একাত্ম হয়।
"দরজা খোলে না কেউ, সিংহ গর্জন করে
আগুন চোখ
ধারণার রমণীরা এসে উঁকি মারে
আহা কী বাতায়ন।
সমস্ত সরোবর জুড়ে ইন্দিবর চাঁদের শোভায়
আহা, লীলা মাৎস্য তরঙ্গে তরঙ্গে লাফায়।"
- (আশ্রয় প্রার্থনা)
মানবতাবাদী কবি তৈমুর খানের জীবনে কেবলমাত্র মহামেডাম সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার জন্য তাঁকে ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্য জীবন উভয়ক্ষেত্রে সীমাহীন অত্যাচার ও অবিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হয়েছেন দেহে মনে। তবু তিনি অবিশ্রাম পথ চলা পথিক। তাঁর মনে বিশ্বাস ছিল, উপলব্ধি ছিল। উজ্জ্বল মানবতা ও সহিষ্ণুতার কবি, বিশ্বের অন্যতম অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমোঘ কারা বাণী-
"হায় রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়
তবু তৈমুর খান শত বাধা-বিঘ্ন প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সত্যি কথা বলতে ও লিখতে ছাড়েননি। এই একটি গুণের জন্য তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দ্বিগুন বেড়ে গেছে। যেখানেই তিনি সংকটাপন্ন হয়েছেন, সেখানেই তাঁর লেখনী (সৃষ্টি-সৃজন) দ্যুতিমান হিরকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আজকের সাহিত্যের জগতে মেকীর রাজত্বে ফাঁকি সর্বস্বতার দিনে তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পথের পথিক, অতুলনীয় অনুপম।
কবি ও প্রাবন্ধিক তৈমুর খানের লেখা যত গ্রন্থ পড়েছি সেখানে বেশীরভাগ আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ লেখা, সস্তা বাহবা বা হাততালি কুড়াবার মতো লেখা প্রায় নেই। যদিও সাহিত্য তথা সংস্কৃতি জগতে দৃষ্টিকোণ বলে একটা কথা রয়েছে। তৎসঙ্গে সময় ও প্রেক্ষিৎ বিচারের প্রয়োজন রয়েছে। স্বয়ং নোবেল লরিয়েট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সব লেখা যথার্থমানের হয়ে ওঠেনি, সময়ান্তরে তিনিও বাঁক বদল করেছেন। সেক্ষেত্রে অনেকে আবার বড্ড আনাড়ী। কি সাধারণ পাঠক, কি পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব, সবার ক্ষেত্রে একই। বিদগ্ধ সাহিত্যের রসবোধ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই স্বমহিমায় উজ্জ্বল লব্ধ প্রতিষ্ঠ বহু কবি সাহিত্যিকদের কপালে সমকালে শ্রদ্ধা, ভালবাসা তো দূরস্ত, সীমাহীন বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, উপেক্ষার স্বীকার হতে হয়। সেক্ষেত্রে তৈমুর খান বোধ হয় অন্যতম একজন কলম সৈনিক। যদিও তিনি মরমে ব্যথিত হলেও লড়াই মঞ্চ থেকে সরে আসেননি। বরং দ্বিগুণ শক্তিমত্তা, উদ্যম ও ধী শক্তি নিয়ে সাহিত্যের অশ্বারোহী সেনানী হিসাবে নিরন্তর পথ চলেছেন, যা আমাদের মতো বহু অনুজপ্রতিম এবং অগ্রজপ্রতিম কবি-সাহিত্যিকের লেখনীর খোরাক, সাধনার বিষয়বস্তু। এ প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত কথা বলেছেন, বিশ্বখ্যাত ইংরেজ কবি ও যুগন্ধর সমালোচক টি. এস. এলিয়ট, সমকালে যারা সাহিত্য পথে অবহেলিত কালান্তরে তারাই কালজয়ী স্রষ্টা তথা কবি-সাহিত্যিক হিসাবে প্রতিভাত হন। বিতর্কিত কবি বিনয় মজুমদার প্রায় পনের হাজার কবিতার লেখক, স্বার্থহীন ভাষায় এরকম ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন তাঁর যৌবনকালের লেখা কাব্য সাহিত্য নিয়ে। তিনি বলেছিলেন "আমার কবিতা আজ না পড়ুক একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে পড়ানো হবে।" বাস্তব ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল পরবর্তী জীবনে। কবি তৈমুর খান মূলত আধুনিক কবি, আবার সময়ান্তরে উত্তর আধুনিক কবিতাও লিখেছেন বিস্তর। সাংকেতিক কবিতা তিনি ভালোবাসতেন। যদিও বহুবিখ্যাত আধুনিক কবি পরিসরে বড় কবিতা লিখে কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, বিনয় মজুমদার, মল্লিকা সেনগুপ্ত, সুবোধ সরকার প্রমুখ। কবি তৈমুর খানও কখনও কখনও বড় কবিতা লিখেছেন, পাঠকের দরবারে যা রক্সাহী হয়ে উঠেছে। সেরকম একটি কবিতা 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় প্রকাশিত:
"ধর্মনগর পেরিয়ে যাচ্ছি
পিয়াস ছিল বলছি না তা
চুল ওড়াচ্ছে যদিও হাওয়া
বাউল হয়ে বলছি কথা
আঁচড়কাটা শরীর জুড়ে কী মুদ্রণ?
কেউ জানে না, আমিও ছিলাম ভিক্ষাজীবি
বাঁচতে বাঁচতে না বাঁচাতেই
অতর্কিতে পৌঁছে যাচ্ছি নষ্ট একটি পৃথিবী
চোখের সামনে যা দেখে খুব অহ্লোদিত
কলসী দড়ি ভাঙা খাটে গুছিয়ে জীবন
কুয়োর ধারে সূর্য কুড়োই বোজ একাকী
এমন করে দিন গেল সব সময় বিহীন।"
- (যুগপুরুষ)
কাব্য সাহিত্য রচনার পাশাপাশি প্রবন্ধ সাহিত্যেরও একজন রসবেত্তা মানুষ তৈমুর খান। গভীর বিশ্লেষণ, অনুপুঙ্খ তথ্য ও তত্ত্বের সন্নিবেশে সচেতন বিন্যাস রীতি (Sequence) সহযোগে তাঁর লেখা প্রত্যেকটি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ হীরকদ্যুতিতে উজ্জ্বল। বরং তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাঁর কাব্য সাহিত্যের বলিষ্ঠতার তুলনায় প্রবন্ধ সাহিত্যের গরীমা অনেক বেশী। যেমন মেদিনীপুর জেলার অন্যতম খ্যাতিমান কবি ও প্রাবন্ধিক তথা কাব্য বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক বীতশোক ভট্টাচাৰ্য্য সংখ্যার বিচারে খুব কম সংখ্যক কাব্য-কবিতা লিখেছেন, কিন্তু গরীমায় তা উজ্জ্বল, তার চেয়েও বড় বিষয় তিনি যতখানি কবি তার চেয়ে অনেক বড় পরিচয় তাঁর কবিতা বিষয়ক সমীক্ষক হিসাবে। তাঁর লেখা গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলি বহু মেধাবী পাঠকের অন্তরের খোরাক, যা সময় থেকে সময়ান্তরে, কাব্য প্রেমী মানুষের অন্তরকে আন্দোলিত করে চলেছে, ঠিক সেইভাবে একালের কবি তৈমুর খানের গবেষণামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থগুলি কবির ভাঁড়ারের চাবি, আতাসংগ্রহ, আত্মক্ষরণ, নব্বই দশকের কবি ও কবিতা প্রভৃতি খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত লেখা।
এই পর্যায়ের আরও কয়েকজন খ্যাতকীতি কবি-সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে বুদ্ধদেব বসু, তপোধীর ভট্টাচার্য্য, নভেন্দু সেন, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খঘোষ, ড. অশোক কুমার মিশ্র, ড. পবিত্র সরকার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমর সেন, ড. অজিত ত্রিবেদী প্রমুখ।
তৈমুর বাবুর জীবন ব্যাপী সাহিত্য সাধনার মূল্যায়ণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার ভালোবাসার কথা সকলের সামনে তুলে ধরাই একান্ত ইচ্ছে। টি.এস. এলিয়টের সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়েই আমার কথা শেষ করি-
"The critic must not corus and he must not make judgement of worse and better. He must simply elicited, the reader will form the judgement for himself."
আমি তৈমুর খানের সাহিত্য পথের অতি সামান্য একজন পথিক, তাঁর প্রতি, তাঁর সৃষ্টি-সৃজন কর্মের সুবিস্তৃত অঙ্গনের প্রতি আমার ভালোলাগা ও ভালোবাসার কথাগুলিই তুলে ধরলাম মাত্র, বাকী হিসেবের ভার বইল নীরবধি কালের উপর এবং সহৃদয় আস্বাদনপ্রিয় সমস্ত পাঠক-পাঠিকার উপর।
তৈমুর দা' শতায়ু হোেন, তাঁর অবিশ্রাম পথ চলা ও সৃষ্টির সুরধুনী প্রবাহিত হোক দেশ-কাল ছাড়িয়ে মহাকালের পথে অনন্ত আলোকবর্তিকা সহযোগে।
কবি তৈমুর খানের সাহিত্য আত্মজৈবনিক উপাখ্যান // আবদুস সালাম
“A loose Sally of the mind an irregular undigested price not a regular and orderly performance”–SSAMUEL JOHNSON
যন্ত্রণা মুখরিত বেদনার বাঁশিতে নিত্য যার সুর উঠে তিনি এই সময়ের কবিতার জগতে বিশিষ্ট নাম তৈমুর খান। শূন্যতার গভীরে গিয়ে বোধের যিনি উপাসক তিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ । মানব জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাছে এসে উপলব্ধি করেছেন বাস্তবতা কি জিনিস । অভাবময় নিরীহ দিনে চেতনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া এক কবিকে আমরা দেখতে পাই। তার পুরো জীবনটাই দুপুর। এখানে নেই কোন সকাল, সন্ধ্যা ,রাত । চেতনার গভীরে ঢুকে চলমান সমাজ নিয়ে উপলব্ধির কাব্য ব্যঞ্জনায় তিনি মুখর । বারবার কলমে ডগায় তুলে এনেছেন আত্মজাগরণের মোহ ।কবির কাছে আবেগহীন জীবন চর্চার বাস্তবতা তাকে মনন চর্চায় অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। তার কবিতার প্রাঞ্জল ভাষা পাঠক মহলে সাড়া ফেলেছে । জীবন ও চেতনা তার কাব্যের মূল উপজীব্য। শিকড়কে যেমন মাটি থেকে আলাদা করা যায় না তেমনি বাস্তবকে কাব্য থেকে আলাদা করা যায় না। ছন্নছাড়া উপলব্ধির যাপিত অনুভবে তার সৃষ্টি এগিয়ে চলেছে । জীবনের কাছাকাছি অকপট চিত্রনাট্য তৈরির যে মুন্সিয়ানা কবি দেখেছেন তা অতুলনীয় । কাব্য ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে সমাজের অবিকল দৃশ্যপট । বাস্তবের ঊষর মাটির প্রেমিক তিনি।
প্রথম জীবনের কোন কবিতায় লিখলেন - “ভালবাসতে পারব বলেই এসেছি তোর কাছে
নদীর ঢেউয়ে নৌকা ভাসছে,নদী জলে মাছ
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকিস ফুল ফোটানো গাছ–”
অভাবের তাড়নায় জর্জরিত এক সাহিত্য সেবকের নিরলস ভাবনা আর সাহিত্যের প্রতি অমোঘ টানই হলো তার স্পর্ধা । বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তুলে এনেছেন সাহিত্যের আঙিনায়। কোন রকম রাখঢাক না করেই ।
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই জন্ম নিয়েছে কবিতা ।কবিতার যাত্রাপথে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে। বহু বাধা বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ধারা। কখনো কোনো বাধা তার অন্তররায় হয়ে দাঁড়ায় নি।রুদ্ধ করে দিতে পারেনি তার গতিপথ। বরং নতুন চলার গতিপথ সমৃদ্ধ হয়েছে নানা রকম অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে। কবিতার গেরস্থলীতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন চমক ও অভিজ্ঞতা । ।(চর্যা বিনিশ্চয়ই) বাংলা ভাষার প্রথম লেখা কাব্যগ্রন্থ। বাংলায়। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার কে উদ্দেশ্য করে লেখা বৈষ্ণব কাব্য, পদাবলী ,মঙ্গলকাব্য ,অনুবাদক কাব্য ইত্যাদি । হাজার বছরের নিরবিচ্ছিন্ন সাধনা বাংলা সাহিত্যের কে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলায় জাতীয় জীবন চিরকাল একই খাতে প্রবাহিত ছিল না । যুগে যুগে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিত্ব পরিবর্তিত হয়েছে । তাই বাংলা সাহিত্যেও বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। প্
LEONARD CHOEN :-”POETRY IS JUST THE EVIDENCE OF LIFE. IF YOUR LIFE IS BURNING WELL___POETRY IS JUST THE ASH”.
জীবন পুড়লে কবিতা হয় কবিতা জীবনের ছাই স্বরূপ।।
আত্ম দহন ব্যক্তির মধ্যে ক্রিয়াশীল । কবিতা সেই দহনকেই গ্রথিত করতে জানে।
ছাত্র জীবন তার খুব বেশি সুখকর নয় । পড়া চলাকালীন সময়ে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা তার উড়ানের ডানা ছেঁটে দিয়েছে । মননের ক্রিয়াশীল উপলব্ধি রক্তাক্ত হয়েছে বারবার। তথাকথিত ছোট কাজ করে মেটাতে হয়েছে মনের স্বাদ। একজন কলেজ পড়ুয়া অভাবের তাড়নায় জর্জরিত। হৃদয় ক্ষত বিক্ষত যে হয়নি তা নয়। HAVE আর HAVE NOTএর পার্থক্য যে কি হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করেছেন। তাই তার কবিমন উচাটন হয়েছে। আত্ম দহন ব্যক্তির মধ্যে ক্রিয়াশীল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবিতা সেই দহনের সাথে বসবাস করে ।অধ্যয়ন চলার ফাঁকে ফাঁকে তিনি যে অনেক তথাকথিত নিম্ন ধরনের কাজ যেমন দিনমজুর রাজমিস্ত্রির জোগাড়ির কাজ করতে হয়েছে । একজন শিক্ষিত বালক অভাবে তাড়নায় হয়েছে জর্জরিত, ক্ষতবিক্ষত । ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল হৃদয় বলেই তো তিনি লিখতে পারলেন—দুবেলা ঘাস কাটি মজুরের ছেলে
কাঠ খড়ের উষ্ণতায় রাত্রি করি পার
তবুও পার্টির লোক আমার দরজায়
না বাবু কামাই হলে আমি উপোস
কি খাই কি খাই সারাদিন। মিছিলের লাল ধুলো, ঘুরবে আকাশ
আর একটু দাড়াও কার্ল মার্কস
কয়েক শতাব্দী আরো কেটে নিয়ে ঘাস —--
প্রান্ত জনের হৃদয় মথিত উচ্চারণকে তিনি কাব্যিক রূপ দিতে পারেন অনায়াসে । কোনরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব মনে না রেখে অকপটে সেসব উচ্চারণ করে গেছেন । তার আত্মস্মর গ্রন্থে লিখেছেন ছোটবেলার কথা । সমাজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা ছলচাতুরিকে আশ্রয় না করেই উপহার দিয়েছেন।এই সব কথা আমাদের নিজেদের কথা ।এসব তো নিত্যদিনের কথা।প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্তিগত কথা লিখেছেন । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ের কথা তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছেন। সাধারণত আমাদের ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত কথা জনসমক্ষে আনতে লজ্জা বোধ করি। তিনি যে আমাদের মাটির মানুষ। আমাদের আত্মীয়ের আত্মীয়। এই কাহিনী যে আমাদের সমাজের দর্পণ।
প্রতিদিনের সাধারণ সংসার যাপন এবং তার সাথে ঘটে যাওয়া আত্ম যন্ত্রণা ও পীড়ন তাকে শূন্যতার নির্বেদ যাত্রায় তার কবিতার মূল উপজীব্য। নানা বাঁক নানা ভাঙন ঘটে গেছে কবির জীবনে। তিনি সাহিত্যের দরবারে একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তিনি ধার্মিক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাননি কোন দিন। কেননা তিনি মনে করেন মানুষ যদি মানুষ না হতে পারে, মানুষের পাশে না দাঁড়াতে পারে তবে মানুষ আর পশুর ভিতর পার্থক্য কি থাকলো। তিনি মানবিক মূল্যবোধ কে অগ্রাধিকার দেন। সেই বিশ্বাসের কথা তিনি এভাবে ব্যক্ত করেন ___
“ স্মৃতির চোখে জল শুকিয়ে গেছে
রঙিন হাতের স্পর্শে উৎসুক সকাল আর নেই
শুধু একা অনন্ত হাসে বৈরাগ্যের আলোয়”
“দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ম্লান মানুষের দীর্ঘশ্বাস
অবেলায় হারিয়ে ফেলবে ভবিষ্যৎ”
আলো আঁধারির বিষয় মিলে বর্ণ ধর্মীয় দীর্ণ হয়ে পড়ে মানবিক মূল্যবোধ ।
দূরের মানুষ কবিতায় দেখি
“আর কোথায় বা যেতে পারি?
স্বপ্নদীপ আজ নিভে গেলে
অন্ধকারে মুখ ঢাকে যাদবপুর ও”
দীর্ঘশ্বাসে ভিজে যাচ্ছে মাটি
মাটিকে প্রণাম জানাবার কি প্রয়োজন
ভাবতে ভাবতে আমরা ছাই হতে থাকি–_
যে কোনো দিন ভেঙে পড়বে
আমাদের পৃথিবী
ধ্বংসের কাছে নিজেরই ছায়া দেখি
জীবনের বাঁকে বাঁকে জমা হয়ে আছে দাগ। আত্মার পীড়ন জর্জরিত অকপটে প্রান্ত ভাষা কে অবলীলায় কবিতার শরীর ব্যক্তিগত গদ্যে গেঁথে দিতে পারেন। এটিই সাহিত্যিক তৈমুর খানের বিশেষত্ব।
তার কাব্যিক ভাষা কখনই শহরের ভাষায় হারিয়ে যায়নি। অকপটে তার কাব্যিক ভাষা পাঠকমহলে আলোড়ন তোলে। এ যেন আমার ভাষা, আমাদের ভাষা। এই পাঠক মহলের আলোড়ন বিশেষত শহুরে বাবুদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তার জন্ম পরিচয় নিয়েও অনেক কথা থাকে শুনতে হয়। তিনি না কি মুসলমান কবি।কবি সাহিত্যিকদের আবার জাত হয় না কি? সহজ ভাষায় তার কাব্যর রীতির অনাবিল ছন্দ একজন কবিকে নিয়ে গেছে অনন্যতার শিখরে ।
অতি সহজ সরল ভাষা ব্যবহার করে যে পাঠক মনে ঢেউ তুলতে সক্ষম তা তার সকল কবিতা , গদ্য পাঠকদের মনে দোলা দেয়।কবিতা পড়তে পড়তে আমরা হারিয়ে যায় ।আমাদের জীবন বোধের তলায় জীবনাচারের অসহ্য টানাপড়েন চলে তার কাব্যরীতির মূল বিষয় । যন্ত্রণা দগ্ধ অনুভূতির আঁচে পুড়ে আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা।, সমাজের অমানবিক যাপনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন বারংবার । অমানবিক চলমানতার বিরুদ্ধে তার কলম গর্জে উঠেছে । সময়ের পিড়ন কবিসত্ত্বাকে জর্জরিত করে ।
তাই তিনি লিখেছেন
হাত দিয়ে ওর হাত ধরি
মনকে কিছুতেই ধরতে পারি না
আমার দিন ফুরিয়ে যায়
—
র
রোজ আমি বিনয়ের কাছে যায়
রোজ নত মস্তকে করুণার উচ্চারণ শিখি
—
তীব্র কলমের খোঁচায় উঠে আসে ধিক্কার। প্রচন্ড কষ্ট এসে মনকে মোচড় দেয়।এ নিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজ তার প্রতি নিক্ষেপ করেছেন প্রশ্নবাণ । জর্জরিত হয়েছে হৃদয়ের অন্ত স্থল। ক্লান্তি হীন উচ্ছাস নীরব অভিমান মিলে মিশে একাকার। কখনো তাকে শুনতে হয় এ দেশ তোমার দেশ নয় ,চলে যাও হয় এবার বাংলায় নয় পাকিস্তানে । ঘৃণা পূর্ণ ইঙ্গিত শুনতে হয়েছে বার। সমাজের ভয় কবি কে দমিয়ে রাখতে পারেনি কোনদিন।সোনার মঙ্গলকাব্য কবিতায় দেখি
সময় বদলের সাথে সাথে যে আমরা বদলে যাচ্ছি । সবকিছু হয়ে উঠছে মায়াময়।
তাই তিনি লেখেন কত যুগ পার হচ্ছে সোনার হরিণ হচ্ছে মায়া আমরাও বদলে যাচ্ছি লোহাই তেতলে ফুল্লোড়াও পাল্টে হচ্ছে ফেলো ফেলানিতে তীর ধনুকগুলো এখন বন্দুক পিস্তল অরণ্য নগর রাষ্ট্রসমূহ শিকার ভূমি এই সভ্যতার সন্তান-সন্ততি মিলে আমরা সব মরীচিকা খাই তৈমুক খান মূলত আত্মজাগরণের কবি প্রতি লেখায় তার উঠে আসে অবক্ষয়জনিত সমাজের প্রতিচ্ছবি তাই তিনি ছুঁড়ে দিয়েছেন একরাশ ঘৃণা তাই তিনি বলেন সমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাই জর্জরিত বিষন্ন হাহাকার কবির মনকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে । যন্ত্রণা বিধুষীত উচ্চারণ তার কাব্যের মূল উপজীব্য। অমূলক কথার ভারে তার সৃষ্টি ভারাক্রান্ত নয়
রিকশা কবিতাটি এমন এক
“A guilty conscience needs to confess.
A work of art is a confession.”
খুব মার্জিত শব্দবোধের চিত্রকল্প নির্মাণ তার সহজাত।
তাঁর কালচেতনায় ইতিহাস-বর্তমান-ভবিষ্যৎ মিশে যাচ্ছে গতিশীলতার মধ্য দিয়ে । তার লেখনী অন্যতর এক বোধকে সংক্রমিত করে ।
স্বতন্ত্রতা তার আঙ্গিকের অভিনবত্ব। আট পৌরে সংসারে ঘানি টানতে টানতে সমগ্র আখ্যান জুড়ে ঘটে চলে নির্মাণ – বিনির্মাণ। চরিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে লেখক নির্মাণ থেকে বিনির্মাণ আবার বিনির্মাণ থেকে নির্মাণের পথে যাত্রা করেন। নির্মাণ বিনির্মাণের মধ্যে যে গতিময়তার প্রবাহ তাকেই তিনি ধরেছেন, ছেড়েছেন আবার নিজের খেয়ালে ভেঙে চলেছেন ।
মধ্যবর্তীকালীন সময়ের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়েছেন সব চরিত্রগুলিকে। তাই তিনি শুধুমাত্র একজন কবিই নন– তিনি একজন তত্ত্বনির্মাতা গদ্য কার। তাঁর সারাজীবনের সন্ধান সত্য কে উপলব্ধি করা । এখানে তিনি একজন ভারতীয় । তাঁর নিজের ভাষাতেই (-” …সারা পৃথিবীর মধ্যে আমাদের এই বাংলার উপর দিয়েই বয়ে যায় রহস্যময় এক সামুদ্রিক বাতাস তার নাম মৌসুমী বায়ু । অথচ আমাদের উপন্যাসে সে-বিবরণ লেখা হল না – কোন খাত দিয়ে কী বাতাসে আমাদের গাছপালা দোলে। আর,এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল আর এই সমুদ্রকে অন্বিত করে যে-মানুষ সে তার নিজের বাঁচার কাহিনী নিয়ে আমাদের উপন্যাসে এল না। আমরা উপন্যাসে কাহিনী খুঁজেছিলাম, কাহিনীর সেই মায়ামৃগ আত্মপরিচয় থেকে আমাদের আরো দূরে দূরে সরিয়ে এনেছে। বাংলার গল্প- উপন্যাসের আধুনিকতা তাই এখনো তাত্ত্বিক তর্কের বিষয়।
ব্যাক্তিগত গদ্য যেমন পাঠকের মনের দুয়ারে আঘাত হানে তেমনি কবিতা সমন্বিত নিবন্ধ গুলো
, তাঁর লেখা ও ভাবনার এক বিশাল জগতের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আগামী সময় এই সমুদ্র থেকে পাঠকেরা নতুন অমৃত খুঁজে পাবেই। একজন সামান্য পাঠক হিসেবে তৈমুর খানের রচনার সামনে নতজানু হয়েই আগামী সময়ের লেখকদের কাছে আশাবাদী হয়ে রইলাম। অন্তত দ্বন্দ্ব হোক তাঁর ভাবনার সঙ্গে। আর সেই দ্বন্দ্বটি হওয়ার জন্যে তৈমুর খান কে পড়তে হবে আমাদের।
___&__&__&__
আবদুস সালাম
প্রয়াস শ্রীকান্তবাটি মাদারল্যান্ড
রঘুনাথগঞ্জ ,মুর্শিদাবাদ৭৪২২২৫
৯৭৩৪৩৩২৬৫৬
------------------
মুখোমুখি
মুখোমুখি
কবি তৈমুর খান ও কবি গোবিন্দ ধর
(১)আপনার পরিচিতি দিন?
🗣️ নাম: তৈমুর খান, পিতা ও মাতার নাম : জিকির খান ও নওরাতুন বিবি।
জন্ম: ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭।
জন্মস্থান : বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে।
শিক্ষা: শিক্ষার সূচনা গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর দাদপুর বাতাসপুর জুনিয়র হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। মাধ্যমিক পর্যন্ত আয়াস হাইস্কুলে( ১৯৮৩)। উচ্চমাধ্যমিক(১৯৮৫) এবং বাংলা সাহিত্যে অনার্স(১৯৮৯) রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ে। মাস্টার ডিগ্রী(১৯৯২) এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পিএইচডি(২০০১) পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বি-এড ট্রেনিং(১৯৯৪) মালদহ গভর্নমেন্ট ট্রেনিং কলেজে।
কর্মজীবন: ১৯৯৮ সালে নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে অংশকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগদান। ২০০৪ এর জানুয়ারি থেকে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্থায়ী সহ-শিক্ষক পদে নিয়োগ। বর্তমানে হাজী জুবেদ আলী বিদ্যাপীঠে কর্মরত।
(২)ছোটবেলার বেড়া ওঠা ও তৎকালীন গ্রাম্য কলকাতা কেমন ছিলো?
🗣️আমি কলকাতা থেকে ২২০ কিমি দূরে থাকি বীরভূম জেলার প্রান্তিকগ্রাম পানিসাইলে। রাঙামাটির দেশ বলতে যা বোঝায় আমার গ্রামটি তাই। পুরো বীরভূম জেলা জুড়েই বাউল গান, কবিগান, সত্যপীরের গান, মনসার গান, কীর্তন গান, ভাদুর গান এবং ফকিরি গানের প্রচলন রয়েছে। সেসব গানের আসরে নিয়ম করে উপস্থিত হওয়া জরুরি ছিল। গ্রাম বলতে যা বোঝায় একেবারেই তাই। বাঁশঝাড়, জোনাক-জ্বলা রাত্রি, রাস্তাঘাটে কাদায় ভর্তি বর্ষাকাল, গরুর পাল নিয়ে রাখালের মাঠ পরিক্রমা,হাল-বলদ নিয়ে কৃষকের কৃষিকাজ, মাটির বাড়ি খড়ের চাল বাঁশের খুঁটি, আটচালায় সপ্তাহে দু’দিন গ্রামের হাট, নবান্ন উৎসব, পহেলা বৈশাখের মিষ্টিমুখ, গরুর গাড়িতে চেপে বরযাত্রী ও নতুন বউয়ের আগমন ইত্যাদি এসব নিয়েই আমার গ্রাম। এই পরিবেশেই বড় হওয়া। পাঠশালায় গিয়ে মেঝেতে মাদুর পেতে বসা। স্লেটে অঙ্ককষা, জামার ফুটো পকেটে পেন্সিল ভরে রাখলে হারিয়ে যাওয়া তার জন্য কান্না ইত্যাদি এইসব। তবে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর স্থানীয় এম-এল-এ শশাঙ্কশেখর মণ্ডল-এর ফরওয়ার্ড ব্লক নামক রাজনৈতিক দলের মিছিলে যোগদান করে মাঝে মাঝে কলকাতার এক্সপ্ল্যানেড ময়দান যাতায়াত করা চলতে থাকে। ৮০-৯০ এর দশকে তখন কলকাতা এত জমজমাট ছিল না। রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকত। ফেরি ঘাটে লোকজনও কম।
(৩)আপনার পারিবারিক জীবনবৃত্তান্ত চাই।
🗣️ পারিবারিক জীবন বলতে আমরা ছিলাম চার ভাই, তিন বোন আর মা-বাবা। পরিবারের মোট ৯ জন সদস্য। বাবা ছিলেন একাকী রোজগার করার মানুষ। সমবায় ব্যাংকের পিয়ন হিসেবে আশির দশকে মাত্র ৫০ টাকা বেতন পেলেন। তাতে সংসার চলত না। তাই ক্ষেতে-খামারে পরের জমিতেও বাবাকে জনমুনিষের কাজ করতে হতো। একবেলা অথবা আধাপেটা খেয়ে আমাদের বড় হতে হয়। আমি ছাড়া বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা আর তেমন কেউ লেখাপড়ায় অগ্রসর হতে পারেনি। লেখাপড়া করতে করতেই রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করতে মুম্বাই যেতে হয়েছে। প্রায় চারবার মুম্বাই শহরে গেছি। সেখানে মোট বহনের শ্রমিকের কাজও করেছি। সেই টাকা রোজগার করে এনে লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছি। ছোট ছোট ভাই-বোনেরা মাঠে-ঘাটে কাজ করে ক্ষুন্নিবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছে। আমাকেও করতে হয়েছে সেই কাজ। মাঠে মাঠে গরু চরানো থেকে ঝরেপড়া ধান কুড়ানো এবং ইঁদুরের গর্ত থেকে মাটি খুঁড়ে ধান সংগ্রহও করতে হয়েছে। এমনকি কলেজে পড়াকালীনও ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে হয়েছে। পরবর্তীকালে লেখাপড়া শেষ হলে টিউশনি করাই একমাত্র জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৪ সালের চাকুরিতে যোগদানের পর আমাকে চলে যেতে হয় মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গিপুরে। ২০০৫ সালে বীরভূম জেলার নলহাটি ব্লকের অন্তর্গত বসন্ত গ্রামে ১২ই এপ্রিল সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হই। তারপরের কয়েক বছরের মধ্যেই ভাই-বোনদেরও সব বিয়ে হয়ে যায়। আসে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা। ২০১২ সাল নাগাদ আমি চাকুরিস্থল পরিবর্তন করে চলে আসি বীরভূম জেলার আমার সদর শহর রামপুরহাটে। আমার সঙ্গে আমার পিতা-মাতাও। এখন সেখানেই আছি। ২০২৩ সালে মে মাসে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মারা যায় ছোট ভাই রুকুন খান এবং এই বছরই ২৫ শে ডিসেম্বর মারা যান আমার বাবা। বর্তমানে মা-ও অসুস্থ। আমার দুই ছেলেমেয়ে। মেয়ে বড় নাম তিয়াসি খান বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কলেজে পড়ছে। ছেলে শ্রেয়ান খান এ-বছরই মাধ্যমিক।
(৪)লেখালেখিতে হাতেখড়ির ইতিহাস বলুন প্লীজ?
🗣️লেখালেখির হাতেখড়ি মূলত বাড়ির পরিবেশ থেকেই। গরিব মানুষের একটা বাড়ি, কিন্তু তা একটু ভিন্ন রকমের। বাবা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস ছিল বাবার। বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য রামায়ণ, মহাভারত,আলিফ-লায়লা, হাতেমতাই, জঙ্গেখয়বর, বিষাদসিন্ধু ইত্যাদি বইগুলি সুর করে পড়তেন। সেইসব বইয়ের গল্প এবং ধ্বনি ঝংকার আমার মনের মধ্যে ক্রিয়া করত। কল্পনার রাজ্যে মুক্তি পেতাম। যুদ্ধের ঝনঝনাৎকার আবেগকে নাড়িয়ে দিত। একটা বিস্ময়কর অনুভূতির জগৎ তখন থেকেই খুলে যায়। পয়ারের মাধুর্য ঐকতান মনের মধ্যে লেফট-রাইট করতে থাকত। কিন্তু তখন লিখতে চাইলেও ভাষা পেতাম না। চরম দারিদ্র্যের কষাঘাত, বস্ত্রহীন-খাদ্যহীন জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই যেতে হতো আমাদের। তখনই কিছু গুনগুন এলোমেলো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মনের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটাত। সেসবই লেখার মধ্যে আশ্রয় চাইত। এই ধরুন স্কুল যাচ্ছি আলপথে হেঁটে হেঁটে। ক্ষেতের দুই পাশে সরিষা ফুল ফুটেছে। তখনই লিখতে ইচ্ছে করত—
“সরষে ফুল সরষে ফুল
তোর সুগন্ধে হই আকুল।
রোজ পথে হচ্ছে দেখা
তাইতো ভুলি মনের ব্যথা।
হলুদ রাঙা পাপড়ি নেড়ে
কেমন করে দোলাস মাথা?
আমার এখন অনেক খিদে
কে শুনবে বল আমার কথা?”
পঞ্চম শ্রেণিতে আমাদের দ্রুতপঠনে ছিল বিদ্রোহী নজরুল বইটি। সেই সময় ওই বইটি বারবার পড়তাম। নজরুলের ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান’ পাঠ করতে করতেই কবিতা লেখার সূচনা। কিন্তু তখনকার কবিতা ওই ব্যক্তিচেতনায় অভাব-অভিযোগের ভিতরেই সীমাবদ্ধ। পরবর্তীকালে হাতে এসেছিল সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র। সব মিলিয়েই কবিতা রচনা আমার কাছে একটি আশ্রয় বা আড়াল হয়ে উঠেছিল। সেখানে বাঁচার এবং নিজের স্বপ্নকে লালিত করার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলাম।
৫)বই প্রকাশের অনুভূতি বলুন।
🗣️বই প্রকাশের আনন্দের অনুভূতি বিয়ে করে বাসর ঘরে যাওয়ার থেকেও বেশি কিংবা ভিন্ন রকমের। প্রথম বই যখন প্রকাশিত হয় তখন সেই বইটি বুকে নিয়ে সারারাত ঘুমাই। বারবার নাকের কাছে এনে বইয়ের ঘ্রাণ নিতে থাকি। বইয়ের মলাটে হাতের স্পর্শ করে সুখ পাই। নিজের লেখা পংক্তিগুলি চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের সন্তানের মতো। সমরেশ বসুর জীবনীতে পড়েছিলাম, তাঁর প্রথম বই বেরোলে তিনি গায়ের জামা খুলে জড়িয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং ঘরে এনেছিলেন। সুতরাং এই আনন্দের সঙ্গে অন্যানন্দের তুলনা হয় না।
(৬)কবে থেকে মনে হলো আপনি একজন কবি?
🗣️ আমি ছোট থেকেই নাকি নিজের মনেই নানা রকম কথাবার্তা বলতে থাকতাম। আমার কাছে কোনো শ্রোতা থাকত না,বা কাউকে উদ্দেশ্য করেও কিছু বলতাম না। শুধু নিজে নিজেই এক রকমের অভিনয় বা তর্ক-বিতর্ক চলত। বাড়ির লোকেরা বা বন্ধু-বান্ধবেরা অনেক সময়ই তা লক্ষ করত। এটাকে সবাই পাগলামি হিসেবেই দেখত। এই কি ছিল কবির লক্ষণ? কিন্তু নিজেকে কখনো কবি বলে মনে হয়নি। ১৯৮৪ সালে প্রথম কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা প্রকাশিত হলেও, কিংবা তার দু'বছর পরেও লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলেও নিজেকে কবি বলে মনে হয়নি। ২০০২ এ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও কিংবা ২০০৩ এ শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও নিজেকে কবি বলে মনে হয়নি। আজ পর্যন্ত নিজেকে কবি বলে দাবি করি না। মনে হচ্ছে ভালো লেখাটি এখনো লিখতে পারিনি।
(৭)আপনার লেখালেখির জীবনের সাথে কুটুমবাড়ি মিলনপল্লীর অবদান আছে কতটুকু?
🗣️আমার লেখালেখি জীবনের সঙ্গে কুটুমবাড়ি মিলনপল্লির অবদান আছে যথেষ্টই। তখন আশির দশকে কলেজের ছাত্র। ‘বিকল্প’ পত্রিকার সম্পাদক বললেন ‘দৌড়’ পত্রিকায় লেখা পাঠাতে এমনকি তিনি ঠিকানাও দিলেন। ওই তখন থেকেই লেখা পাঠানো শুরু হলো। তখন মধুমঙ্গল বিশ্বাস কাজের সূত্রে শান্তিনিকেতন আসতেন। সেখানেই তিনি একদিন ডেকে পাঠালেন। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই তখন প্রথম কলকাতা দুর্গানগরে দৌড়ের মাসিক সাহিত্য সভায় উপস্থিত হতাম। প্রায় শূন্য পকেটেই আমাকে যেতে হতো কলকাতায়, কিন্তু ফেরার সময় তিনি টিকিট কেটে দিতেন অথবা খরচ দিতেন। দৌড়ের সাহিত্য আড্ডায় পরিচয় হয় বিখ্যাত কয়েকজন সাহিত্যিক-কবির সঙ্গে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: সুবীর মণ্ডল, সঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, তীর্থঙ্কর মৈত্র, চিত্তরঞ্জন হীরা, বিদ্যুৎ প্রামাণিক, সনৎ কুণ্ডু, প্রশান্ত হালদার, রাজীব ঘোষ প্রমুখ আরো অনেকের। মধুমঙ্গল বিশ্বাস দাদার আন্তরিক ব্যবহার এবং কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। একদিন গিয়ে দেখি, মধুমঙ্গল দাদা সদ্য বিয়ে করেছেন। ঘরে নতুন দীপিকা বৌদি। ভাড়ার রুম মাত্র একটাই। একটাই চৌকি পাতা। সে সময় একটা বিছানাতেই আমরা তিনজনে ঘুমিয়ে ছিলাম। সাহিত্য অনুষ্ঠানে গিয়ে কখনো কখনো দু-তিন দিন আমাকে থেকে যেতে হতো। মধুদার ভালোবাসা ও প্রশ্রয়ে আমার এই কলকাতায় আগমন। তেমনি ‘দৌড়’ পত্রিকায় একপ্রকার জোর করেই আমাকে দিয়ে গদ্য লেখান। পুস্তক সমালোচনা লেখান। ‘হৃদয়পুর’ দীর্ঘ কবিতার কাগজে আমাকে দীর্ঘ কবিতা এবং দীর্ঘ কবিতা বিষয়ক গদ্যও লেখান। শুধু এখানেই ক্ষান্ত হননি, আমার প্রথম কাব্য ‘কোথায় পা রাখি’(১৯৯৪) প্রকাশ করেন। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন দু একবার হোস্টেল খরচও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আরও দুটি কাব্য ‘বৃষ্টিতরু’(১৯৯৯) এবং দীর্ঘ কবিতার কাব্য ‘প্রত্নচরিত’(২০১১) প্রকাশ করেন। এই ‘প্রত্নচরিত’ কাব্যটিই ২০১৫ সালে ‘দৌড়’ সাহিত্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়। ২০২৩ সালে এসেও আমাকে নিয়েই ‘দৌড়’-এর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেন। সুতরাং আমার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশে প্রায় ৪০ বছর ধরেই ‘দৌড়’ লালন পালন করে চলেছে। কখনো সেখানে আন্তরিকতার অভাব দেখিনি।
(৮)একজন কবিকে কবি হয়ে উঠতে আদৌ কারো সহযোগিতা দরকার হয়?
🗣️অবশ্যই হয়। আমার এক কবি বন্ধু বলতেন, সুন্দরী বউকে ঘরে বন্দী করে রাখাটাই সৌন্দর্যের সংরক্ষণ নয়। তেমনি প্রতিভাকে নিজের মধ্যে রেখে দেওয়াটাই প্রতিভার কদর নয়। উভয় ক্ষেত্রেই প্রকাশ দরকার। আর এই প্রকাশটা হয় অন্যের দ্বারা। একজন কবি-সাহিত্যিককে তুলে ধরতে পারেন প্রকাশকগণ। আর তার ফলেই তিনি পৌঁছে যেতে পারেন বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে।
(৯)আপনার কবি জীবনের সাথে লিটল ম্যাগাজিন কতটুকু ভূমিকা রেখেছে?
🗣️আমি মূলত লিটিল ম্যাগাজিনেরই লেখক। তবে বাণিজ্যিক কাগজগুলি মাঝে মাঝেই আমার লেখা চেয়ে নিয়েছে মূলত লেখার গুণ বিচার করেই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকাশিত লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতে আমি প্রচুর কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছি। এখনো লিখছি। এতই লিখেছি যে তার সংখ্যা গণনা করা রীতিমতো মুশকিল।
(১০)সকল টানাপোড়েন শেষে আপনি এখন মূলস্রোতের একজন লেখক। আদৌ তাতে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন ভূমিকা রেখেছিলো?
🗣️লিটিল ম্যাগাজিনের ভূমিকা ছিল বলেই আমার লেখার উৎকর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্যিক কাগজগুলোর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে লিটিল ম্যাগাজিনের লেখকদের প্রতি। সেখান থেকেই তারা মান বিচার করে লেখক নির্বাচন করেন। সাহিত্যের সূতিকাগার হচ্ছে লিটিল ম্যাগাজিন। একজন লেখক সেখান থেকেই লালিত পালিত হয়ে বিশাল মহীরুহে পরিণত হন। আমার ক্ষেত্রেও তা হয়েছে।
(১১)আপনি যদি লিখতে আসতেন না তো কি করতেন?
🗣️লিখতে না এলে হয়তো আর পাঁচজন মানুষের মতোই সংসার করতাম আরো গভীরভাবে। বৈষয়িক বিষয় সম্পত্তি হয়তো অনেক বৃদ্ধি পেত। সাহিত্যসৃজনের যে একটা আলাদা আনন্দ আছে সেই আনন্দের আস্বাদ পেতাম না।
(১২)কখন মনে হলো আপনি লেখালেখিতে অনিবার্য?
🗣️কলেজে পড়াকালীন যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তখন দেখেছিলাম আমাদের পাড়ায় বিয়ের পণ দিতে পারেনি বলে একটা মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও বর আর বিয়ে করতে আসেনি। বরের জন্য সেজেগুজে সারারাত অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু শেষে হতাশ হয়ে পড়েছিল। সমাজের চোখে মেয়েটি হয়েছিল লগ্নভ্রষ্টা। তাকে নিয়েই একটি ছোটগল্প লিখেছিলাম ‘স্বপ্নভাঙা রাতের আলো’ নামে। গল্পটির শেষ পরিণতিতে লিখেছিলাম, মেয়েটি বিদ্রোহিনী হয়ে সমাজের মুখাপেক্ষী না থেকে তাদের বাড়ির চাকরকেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। গল্পটি পড়ে চারিদিকেই হৈচৈ পড়ে যায়। আমাকে তখন একদল লোক মার-মার কাট-কাট করতে থাকে তো আর একদল লোক বাহবা দিতে থাকে। সমাজ এবং সামাজিক প্রথাকে উচিত শিক্ষা দিতে হলে লেখাটিই আমার কাছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
(১৩)মফস্সল থেকে একজন আবহমান বাংলা সাহিত্যে অনিবার্য হয়ে ওঠতে কতটুকু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে?
🗣️কাঠখড় পোড়ানোর কথা যদি বলেন তাহলে আমি তো লেখার ক্ষেত্রে সেরকম কিছুই পুঁজি বিনিয়োগ করিনি। দু-একটা ক্ষেত্রে কিছু বই সামান্য টাকা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই টাকাও ফেরত পেয়েছি প্রকাশকের সততায়। এ বছরও কয়েকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকগণ চেয়ে নিয়েছেন। কয়েকটি পুরস্কারের ক্ষেত্রেও(যে পুরস্কারের অর্থমূল্য নগদ ১০,০০০ ও ৫০০০) যা আমাকে প্রদান করেছেন, সেইসব কর্তৃপক্ষদের আমি ঠিকমতো চিনতামই না।
(১৪) আমাদের বাংলা সাহিত্যে একজন লেখক আসলেই কি জীবদ্দশায় প্রকৃত মূল্যায়ণ পান?
🗣️ কখনোই না। জীবনানন্দ দাশ পাননি। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবদ্দশায় প্রকৃত মূল্যায়ন হয় না। মৃত্যুর ১০০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
(১৫)লেখক স্বত্ব পাওয়া কতটুকু জরুরি একজন লেখকের জন্য?
🗣️ লেখক স্বত্ব পাওয়া অবশ্যই জরুরি। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন সেই সৃষ্টির মর্যাদা রক্ষার্থে স্বত্বও দরকার। লেখকের জীবদ্দশা কাটলেও তাঁর উত্তরাধিকারীর জন্য তাঁর অধিকার থাকার প্রয়োজন রয়েছে।
(১৬)আপনার কবিতাভাষা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। প্রত্যেক লেখক বা কবিকে নিজের স্বর স্পষ্ট করতে কতদিন লেখালেখি করা প্রয়োজন?
🗣️ নিজস্ব স্বর তৈরি তো প্রথম থেকেই হয়ে যায় যদি কবি সচেতন থাকেন। জীবনানন্দ দাশ ‘ঝরাপালক’ লিখে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কবিতার মধ্যে নজরুল ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বেশি মিশেছেন। তাই পরবর্তী কাব্যগুলিতেই তাঁর স্বকীয়তা ফুটে ওঠে। সুতরাং স্বকীয়তার জন্য নির্দিষ্ট সময় নয়, দরকার সচেতনতা।
(১৭)কতদিন চর্চার পর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ করা প্রয়োজন লেখতে আসা একজন তরুণকে এ বিষয়ে কিভাবে গাইড করা দরকার?
🗣️ আমি মনে করি একজন তরুণ কবিকে প্রথমত লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতে লিখে তাঁর পাঠক তৈরি করা দরকার। পাঠক তাঁকে চিনুক, জানুক। তারপর পাঠকেরাই অনুভব করবে তাঁর কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহ করার। আজকাল অনেক প্রকাশক তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থ বিনা পয়সায় প্রকাশ করছেন। যদি লেখার গুণমান সেরকম হয় তাহলে তাঁকে আর ভাবতে হবে না।
(১৮)ইদানীং দেখছি সম্মাননা প্রদান করতেও লেখক থেকে আয়োজক সংস্থা ও ব্যক্তিরা টাকা চেয়ে নিচ্ছেন। এটা আদৌ বাংলা সাহিত্যের মঙ্গল? লেখকের উপকার হয় এরকম?
🗣️ বাংলা সাহিত্য এই কারণেই দূষিত হয়ে চলেছে। এখানে সততার বড়ই অভাব। পুরস্কার দিতে হলেও কর্তৃপক্ষ টাকা নিয়ে পুরস্কার দিচ্ছেন। সম্মাননা প্রদান করছেন তাও ওই টাকার বিনিময়েই। এটা শুধু লোক দেখানো কিছুটা প্রচার পাওয়ার জন্যই করা হয়। এতে মঙ্গল কিছুই হয় না। প্রকৃত আনন্দ থেকে যেমন বঞ্চিত হন, তেমনি এভাবে সাহিত্যিক বা লেখক হওয়াও যায় না। নিজের সঙ্গে ছলনা করা হয়। তার থেকে বরং সম্মাননা না পাওয়াটাই বড় সম্মানের ব্যাপার।
(১৯)লিটল ম্যাগাজিনও তো লেখকের নিকট থেকে নির্লজ্জের মতো টাকা চাইছেন।এতে লেখকের আদৌ উপকার হচ্ছে?
🗣️ লিটল ম্যাগাজিন যাঁরা করেন তাঁরা সবাই সৎ ও নিরপেক্ষ বা যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি নন। লিটিল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে অনেকেই ব্যবসার ফাঁদ পাতছেন। সাহিত্যের মান ও উৎকর্ষ সম্পর্কে এঁদের কোনো ধারণাই নেই। স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্য আজকাল আবর্জনার স্তূপ হয়ে উঠছে। অযোগ্য লেখক এবং অযোগ্য সম্পাদকে ভরে গেছে সাহিত্যের অঙ্গন।
(২০)বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি আমাদের মননকে কতটুকু মার্জিত রুচির চিন্তাশীল বিচক্ষণ করে তোলে?
🗣️ সাহিত্য-সংস্কৃতি অবশ্যই মানুষকে রুচিশীল মার্জিত করে তোলে, কেননা তিনি সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা তাঁর চিন্তা ও চেতনায়। তিনি যেমন যুক্তিবাদী, মানবিক বোধসম্পন্ন, তেমনি সংবেদনশীল দার্শনিক ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। তাঁর মধ্যে যেমন ধর্মান্ধতা থাকে না, তেমনি দেশহিতৈষী মানবহিতৈষী কার্যক্রমের বহু পথের সন্ধান থাকে। শিল্পকে মাধুর্যমণ্ডিত করে তোলার মতোই জীবনকেও মাধুর্যময় করে তোলার স্বপ্ন থাকে। সুতরাং তাঁর উদারতা ও কার্যপ্রণালী, দেশপ্রেম ও জ্ঞান ভাণ্ডার দেশবাসীর কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠে।
(২১)আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলিত হোক। আর তা হোক স্রোত প্রকাশনা থেকে। এ বিষয়ে আপনার একটি চিন্তাভাবনা বলুন।
🗣️শ্রেষ্ঠ কবিতা একাধিক হতে পারে। স্বনির্বাচিত কবিতাও হতে পারে। স্রোত প্রকাশনী চাইলে করতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রকাশনীকেই কবিতা নির্বাচনের দায়িত্ব নিতে হবে।
(২২)স্রোত প্রকাশনা সম্পর্কে আপনার একটু লেখা অনুভব চাই।
🗣️ স্রোত প্রকাশনার নানা উদ্যোগ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কার্যসম্পাদন আমার কাছে অবশ্যই ভালো লাগার বিষয়। ইতিমধ্যে আমার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন: ‘স্তব্ধতার ভেতরে এক নিরুত্তর হাসি’(২০১৮) এবং ‘কাহার অদৃশ্য হাতে’(২০২৩)। দুটি কাব্যগ্রন্থটির প্রোডাক্ট খুব আকর্ষণীয়। মলাট বাঁধাই ও ছাপানো ঝকঝকে। কাজের মধ্যে নিষ্ঠা ও শ্রমের দেখা পেয়েছি। প্রকাশকের সততায়ও মুগ্ধ হয়েছি। আশা করি স্রোত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
আপনাকে শুভেচ্ছা সময় দেওয়ার জন্য।
🗣️আমারও নমস্কার জানবেন।
তৈমুর খান এর কবিতা
একটি জীবন, বহুরাস্তা
🌸
রাস্তা ঘুরে ঘুরে গেছে
অবসাদ ঢেকে দিচ্ছে বনজ্যোৎস্নায়
আমরা তবুও ক্লান্ত পরামর্শহীন
কোথায় চলেছি?
ঐতিহ্যের বহু দোকানে এখনও জ্বলছে আলো
বিজ্ঞাপন নেই
ভেতরে ভেতরে মানবিক স্বর, হয়তো কাঁপুনি
পুরোনো রীতিনীতি ডাকছে আমাদের
শীতের কাঁথা সেলাই করছে কেউ
কেউ যাচ্ছে জলের কাছে
কারও বুকে শুকনো নদী, শুয়ে আছে ঢেউ
পাশ ফিরছি
রাস্তা কত দূর?
একটি জীবন, বহু রাস্তা, অভিমান তবুও চুপচাপ
রাত কাটছে প্রহর গুনে, কমলালেবুর বন পেরিয়ে
যুবতী ঝরনার পাশে যদিও সকাল
আর সকালের আপেল বাগান
দ্বন্দ্বপীড়িত সবাই, কিছুটা দাম্ভিকও
নিরুচ্চারে সবাই গেয়ে চলেছি নিষিদ্ধ গান
কতদূর হেঁটে যাচ্ছ তুমি
🌸
এখনও তো চেরা দাগ বুকে
যে রক্তে সিঁদুর এঁকে দিয়েছি সিঁথিতে
এখনও রাত জেগে বসে আছি
আমার স্মৃতির বারান্দাতে
কতদূর হেঁটে যাচ্ছ তুমি
আরও দূর চলে যাবে
যার কোনও ইতিহাস হবে নাকো লেখা
যেখানে সবাই মৃত, ঝরে পড়ে পাতা
নিঃস্ব করতলে আলো ফোটে নাকো আর
হলুদ বিকেলের চা আসে
কেঁপে ওঠে হাত
যদিও কোকিল ডাকে, বুঝি নাকো ভাষা
হরিণ-হরিণী সব গভীর বনের দিকে যায়
ফিকে চাঁদ কোলে নিয়ে রাত্রির আকাশ
আমাকে কত তার গল্প শোনায়
গল্পের কাছে বসে থাকি, নিঃশব্দে রাত পার হয়
আর্তপ্রশ্ন
🌸
উজ্জ্বল অক্ষম লোভাতুর
এইখানে হীন আস্ফালন রেখে যায়
সিংহাসন নির্মাণ করে
শাসন করে
সম্রাট হয়
আমরা তাকেই সমীহ করতে শিখি
সমস্ত ভ্রমের আয়োজনে
শ্লোগানে শ্লোগানে
মুখর করি তার রাজধানী
অস্তিত্ব ডুবে যেতে থাকে
আমরা কি অমেরুদণ্ডী প্রাণী!
নিরুদ্দেশ
🌸
বাঁচার তাগিদ ছিল, অনেক তাগিদ থাকে
দূরের ধূসর বক ফিরে আসে বাড়ি
কথা ছিল, অনেক কথা থাকে
আততি লুকায় ফাগুন মাস অলির গুঞ্জনে
সারাদিন শূন্যের ফুটবল খেলি অন্যের বাগানে
মাঝে মাঝে বিরতি রচনা
এপাড়া ওপাড়া ঘুরে জীবনকে কোথাও পাওয়া যাবে না
সত্য
🌸
সত্য কিছুই নয়
দেখাও, না-দেখাও
বলাও, না-বলাও
মেঘ করে আছে, বৃষ্টি নামছে
মাঠে মাঠে উল্লাস চরছে
কে উল্লাস?
উল্লাস কেউ নয়
শুধু একটা মরমি পাখি বসেছে তার পিঠে
দোল খাচ্ছে
সত্য আসলে সত্যই
কিছুটা না-দেখা, কিছুটা ধারণা
0 মন্তব্যসমূহ