লোকধর্ম ও লোকাচার
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
অন্যপাঠ
মূল্য :২০০.০০
প্রাক্-কথন
লোকসংস্কৃতি বিশ্বমানব-সংস্কৃতির প্রাচীনতম নিদর্শন। আদিম মানবসমাজের জীবনাচরণ, জাদুবিদ্যাচর্চা ও বিশ্বাস কালক্রমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়ে আসছে রূপান্তরের মাধ্যমে। একালে এই রূপান্তর দেশে-দেশে বিচিত্র ও ভিন্নমাত্রিক। তবে এর মধ্যে অন্তর্গত সূত্র-বন্ধনের একটি মিথস্ক্রিয়ার যোগ বংশগতিবিদ্যার মত খুঁজে পাওয়া যায়। এর ভেতর যেমন স্থানিক ঐক্য আছে তেমনই কালিক ঐক্যও। ড. শহীদুল্লাহ ও ড. আশুতোষ ভট্টাচার্যের মত লোকবিজ্ঞানীরা সেসব ঐকসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। একালের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে অগণন বিভাজন এবং বৈচিত্র্য সত্ত্বেও বৈশ্বিক লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত মেলবন্ধন মানবজাতির ঐকসূত্র প্রমাণ করে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য আন্তর্জাতিক এবং বিশ্বমানবের।
লোকবিজ্ঞানীদের এই বস্তুনিষ্ঠ ও তাত্ত্বিক সত্য বিশেষভাবে মনে হলো অশোকানন্দ রায়বর্ধনের 'ত্রিপুরার লোকধর্ম ও লোকাচার' বইটির পাণ্ডুলিপি পড়ে। তিনি পেশায় শিক্ষক কিন্তু নেশায় আজীবন শিক্ষার্থী ও পাঠক। অশোকানন্দের পাঠপরিধি সুগভীর ও সুবিস্তৃত। শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর পাঠজগত কেবল সাহিত্য নয়; দর্শন, সমাজতত্ত্ব এবং লোকজ বঙ্গের সংস্কৃতি। তবে সঙ্গীহীন রুদ্ধদ্বারে তিনি কেবল পাঠমনস্কই নন-- লোকসাহিত্যের নিবিষ্ট সংগ্রাহকও। লোকসাহিত্য ও শিল্পের প্রজননভূমি পল্লীগ্রামের সঙ্গে অশোকানন্দের রায়বর্ধনের আজন্ম সম্পৃক্ততা। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির সেই আঁতুরঘরে তাঁর জন্ম, বেড়ে-ওঠা, কর্মক্ষেত্র ও জীবনযাপন। সেইসূত্রে তিনি ভূমিপুত্র এবং সেই সংস্কৃতির ধারক। লোকসংস্কৃতিকে তিনি জীবনে কেবল ধারণই করেননি-- সপ্রাণে লালন-পালন এবং সংরক্ষণও করছেন।
এই লালন ও সংরক্ষণের পরিচয় নিহিত আছে তাঁর 'ত্রিপুরার লোকধর্ম ও লোকাচার' গ্রন্থে।
নয়টি সুলিখিত প্রবন্ধের সমন্বয়ে এই বইটি আকৃতিতে ছোটো, চেহারায় কৃশতনু কিন্তু অন্তর্গত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। বিষয়বস্তুতেও আছে বৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতা। বইটিতে এমনসব প্রসঙ্গের তিনি অবতারণা করেছেন যা সচরাচর দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। পানবিলাসের প্রসঙ্গ থেকে লোকবাদ্য ঢাক; খেজুর গাছের রসাহরণ থেকে পৌষ সংক্রান্তির পিঠা-উৎসব; মৃতের সৎকারের পর শ্রাদ্ধাদি, মঠপ্রতিষ্ঠা ও পূর্বপুরুষ-পূজার লোকাচার; লোকপুরাণের আলোকে প্রাচীন দুর্গাপূজা থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ঈদোৎসব-- এসব তাঁর প্রবন্ধের বিষয়-আশয়। তবে গ্রন্থের অধিকাংশ লেখাই ত্রিপুরাকেন্দ্রিক। কেবল দুটি প্রবন্ধ-- 'লোকসাধারণের শিল্পী বিশ্বকর্মা : মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের আলোকে' এবং 'প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে মৃত্যুসংক্রান্ত লোকাচার'-এর প্রেক্ষাপট সুবিস্তৃত। তবে লেখকের আলোচ্য বিষয়ে নিঃসন্দেহে নতুনত্বের চমক আছে। অচর্চিত ও অনালোচিত প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন বলে লেখক অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। আমাদের বিশ্বাস, তাঁর প্রবন্ধের প্রতিটি বিষয় গবেষণা ও অভিসন্দর্ভ রচনার যোগ্য।
প্রাবন্ধিক অশোকানন্দ রায়বর্ধন ভূমিসন্তান হিসেবে আপাদশির লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় নিমগ্ন। তাঁর রক্তমাংস, হাড়মজ্জা, মেধামনন ও শিরা-উপশিরায় লোকসংস্কৃতির ধারা প্রবহমান। তাই মনে হয়, অচর্চিত বা অল্প চর্চিত বিষয়-আশয় তাঁর চর্চার উপাদান। তাছাড়া অশোকানন্দের লেখায় আর একটি বিষয় সবিশেষ লক্ষনীয় যে, লোকসংস্কৃতির সঙ্গে আজীবন যুক্ত থেকে সেই অভিজ্ঞতার সারাৎসার তিনি যোগ করেছেন প্রায় প্রতিটি প্রবন্ধে। তাঁর ধর্মভিত্তিক প্রবন্ধেও মুক্তবুদ্ধি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকাশ লক্ষযোগ্য। সুখপাঠ্য এই বইটি লোকসংস্কৃতি-সাধকদের উৎসাহ যোগাবে বলে বিশ্বাস করি। লেখক ও অন্যপাঠ প্রকাশনার প্রকাশককে অভিবাদন।
মানবর্দ্ধন পাল
0 মন্তব্যসমূহ