নীলপাহাড়ের মায়াবী উপত্যকায় নির্বাসিত এক কবির আত্মবেদনা:হারাধন বৈরাগী


নীলপাহাড়ের মায়াবী উপত্যকায় নির্বাসিত এক কবির আত্মবেদনা:হারাধন বৈরাগী 


কবি পীযূষ রাউতের জন্ম ১০নভেম্বর ,১৯৪০ মেহেরপুর, শ্রীহট্ট, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ।শৈশব কেটেছে পূর্ববঙ্গে।তারপর দাঙ্গা দেশভাগ স্বাধীনতা স্বপ্নভঙ্গ কৈশোরেই দেশত্যাগ। কৈশোর কেটেছে বরাকের শিলচার, যৌবনের‌ও আংশিক কেটেছে শিলচার।পাঁচের দশকে শিক্ষায় অনগ্রস্বর ত্রিপুরায় স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে  সম্ভবত পড়তে আসেন ত্রিপুরার কৈলাশহরে ।কৈলাশহর‌ই বুঝি তাঁর বৃহস্পতি, এখানেই তিনি শুরু করেন ত্রিপুরার প্রথম কবিতা-কাগজ "জোনাকি"(১৯৬০)।আর এই জোনাকিকে কেন্দ্র করেই তৎসময়ে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ত্রিপুরার সাহিত্যে আলো জ্বলতে থাকে।পুব তাকাতে থাকে পশ্চিমের দিকে,পশ্চিম তাকাতে থাকে পুবের দিকে।কবি  বরাক উপত্যকা ও ত্রিপুরা,দু'জায়গাতেই বসবাস করে আসছেন।তাই এই দু'জায়গার‌ই জল হাওয়া প্রকৃতি মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে লিখে চলেছেন একের পর এক কবিতা।

প্রথম কবিতা লেখেন ১৯৫৭।তারপর ১৯৫৯ থেকে অদ্যাবধি লিখে চলেছেন।ছয়ের দশকের শুরু থেকে কবিতা লিখলেও এবং ছয়ের দশকের কবি হিসেবে চিহ্নিত  হলেও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "বিষণ্ন উদ্যানে বৈশাখ"প্রকাশিত হয় ১৯৯০ এ।বুঝা যায় যথেষ্ট পরিণত অবস্থায়‌ই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন কবি।তারপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে জন্মজুয়াড়ী,নষ্ট আশ্বিনের মেঘ,প্রিয় কন্ঠস্বরে উচ্চারিত পংক্তিমালা, শ্রেষ্ঠ কবিতা,অবসরের আগে ও পরে,মন্ত্রপূত রুমাল,স্যার,আপনার টেলিফোন,তোর্ষা সিরিজ,শ্রীচরণেষু বাবা,পীযূষ রাউতের কবিতা/স্বপনন্দীর ছবি,চিনি কম,হ্যালো চীফ মিনিস্টার,নির্বাচিত কবিতা----।একজন কবি নদী হয়ে যান যখন, ধারাবাহিক লেখা চলতে থাকে। বাঁকে বাঁকে ফুটিয়ে তুলেন নীলপদ্ম।এখন জানি না,এখন জানি না।আগে জানতাম,কবি পীযূষ রাউতের বুঝি এমন দিন ছিল না,যে দিনটি ছিল বন্ধ্যা, কবিতার জন্ম হয়নি! আমার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য জানিনা,স্কুলবেলা কবিকে ধর্মনগর কালিবাড়ির দীঘির পারে বন্ধুসহ প্রাতঃভ্রমণ করতে দেখতাম,কিন্তু কবির অজান্তেই ধর্মনগরের একটি পূজা-স্মরণিকায় কবির পাশাপাশি আমার একটি কবিতা স্থান পেলেও তাঁর সাথে কথা বলার সাহস পাইনি। কোনদিন আর কথা বলা হয়ে ওঠে নি। কিন্তু কবিকে নিয়ে এই প্রথম কিছু লিখতে হবে 'দৈনিক বজ্রকন্ঠে'র তরুণ সম্পাদক কবি রাজেশ দেবনাথ আমাকে বললে,কবির সাথে মুখোমুখি(১৮/০৯/২০২১) হ‌ওয়ার আমার সৌভাগ্য হয়ে যায়।আর কথা হ‌ওয়ার পর বুঝতে পারি,আগে কবির সাথে কথা না-হ‌ওয়া আমার কত বড় ভুল ছিল!

লিখতে গিয়ে কি লিখছি জানিনা।তবে তাঁর "নির্বাচিত কবিতা"পাঠ করে মনে হয়েছে,
কবি চোখের সামনে দেখেছেন দেশভাগ, স্বাধীনতা, উদ্বাস্তু স্রোত,ভাষা আন্দোলন, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ,বাংলাদেশের জন্ম,ফের উদ্বাস্তু স্রোত।বরাক ত্রিপুরা তথা উত্তরপূর্বে বাঙালি ও আদিবাসী জাতিসত্তার মধ্যে টানাপোড়েন,ক্ষোভ,দ্বন্দ্ব।নাগা কুকি বরক উগ্রপন্থী আন্দোলনের জন্ম।উদ্বাস্তুদের অনিশ্চিত জীবন যন্ত্রণা,ধাপে ধাপে উদ্বাস্তুস্রোত ও নীল পাহাড়ের বেসামাল অবস্থা।স্বাধীনতার রঙিন চশমায় বুঁদ হয়ে একদা যিনি দেখেছিলেন নিজের পূর্বপুরুষের সামন্ততান্ত্রিক ভিটেমাটি জুড়ে ফুটন্ত রঙিন সুখ, অবশেষে উদ্বাস্তু হয়ে জীবনের অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা থেকে ছিন্নমূল বিবাগীর মতো ঘুরেছেন বরাক ও ত্রিপুরার গা-ছমছম পাহাড়ে,গায়ে সাধারণ মধ্যবিত্তের আলখাল্লা জড়িয়ে।এই থেকে তাঁর দীর্ঘজীবন পরিসরে মধ্যবিত্ত পিতার অভাব অনটনের আর্তি যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি মধ্যবিত্ত মূল্য বোধের জেদ‌ও বারবার তাঁকে পেয়ে বসেছে।আর বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে,শত-দুঃখের মাঝেও তাঁর রোমান্টিক রহস্যময় কবি-মানস।শৈশব কাতরতা, দেশভাগের যন্ত্রণা, স্বাধীনতার বিকৃত আলোআঁধারি মুখ।যৌবন কাতরতা,বড়াইল পাহাড়ের নীল নির্জনতায় উদাসীন মেঘের রহস্যময় আনাগোনা, চা-বাগান ও মন্থর রেলগাড়ির গা-ছমছম ভুতুড়ে আওয়াজ।বড়াইল ও ত্রিপুরার সুনীল পাহাড়। ত্রিপুরার খোয়াইয়ে লাল কৃষ্ণচূড়ার উল্থানের স্বপ্ন সংকেত।কবির জীবনের সুদীর্ঘ পরিসরে সময়ের বেনোজলের  প্রায় সকল বুঁদবুঁদ‌ই উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়।উঠে এসেছে যেন এক বেদনাশ্রাবণের অস্রুধারা। 


একদিকে অবিভক্ত বরাক অপরদিকে ত্রিপুরা-দুই ভুবনেই তাঁর অবস্থানের জন্য,এই দু‌ই আবহের পরাগ সংযোগ করেই তাঁর কবিতার বাক নির্ধারিত হয়েছে।উত্তরপূর্বাঞ্চলের জাতি-জনজাতি সত্ত্বার সহাবস্থানগত উষ্ণতা ও তাপমাত্রার টানাপোড়েন স্বতন্ত্রভাবেই ধরা পড়েছে তাঁর মানস-চেতনার ফ্র্যামে।।বরাকের নদী, পাহাড়, মায়াবী উপত্যকা, দেশভাগের স্মৃতি,শৈশবের স্মৃতি তাকে বারবার ঘুরে ফিরে এসে রুদিরাক্ত করে তুলছে।মধ্যরাতে ঘুম ভাঙলেই যেন সোনার পাল্কি করে এসে চোখের সামনে অভিমানী চোখ তুলে সোনালী শৈশব।


ছয়ের দশক এমন একটা সময় যখন প্রান্তিক বাংলা কবিতায় ফর্ম ভাঙার এক প্রয়াস শুরু হয়।সময়চেতনা ও বস্তুবাদী প্রগতিভাবনা এই সময় কবিতায় স্থান লাভ করে।এই দিক দিয়ে তাঁর 'জোনাকি' প্রান্তিক কবিতায় নুতন চিন্তা ও চেতনার অগ্রদূত।ষাটের দশকের প্রথমপর্বে প্রান্তিক বাংলা কবিতায় শ্রম মেধা ও নিষ্ঠার সমন্বয়ে ব্যাক্তি অনুভবকেই ভাষা দান করা হয়।এই দিক দিয়ে তাঁর কবিতা আলোচনার ক্ষেত্রে অসম্ভব উৎসুক বাড়িয়ে তুলে।পূর্ববঙ্গে জন্মে যাঁরা দেশান্তরী হয়েছেন রাজনৈতিক সামাজিক ঘূর্ণাবর্তে পড়ে,তাদের লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে বাংলার নদীমাঠ ঘাট খাল বিল হাওর বিধৌত শৈশবের স্মৃতি।কবি কৃত্তিবাসে লিখতেন,দেশেও লিখেছেন।তৎকালীন সময়ে কৃত্তিবাসের কবিদের বাকরীতি, প্রকরণ,ছন্দ, বিশ্বাস, জীবনযাপন,যৌবন তখন উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় কবিদের‌ও প্রভাবিত করেছে।আর কবি পীযূষ রাউত‌ও তার ব্যাতিক্রম নন।নষ্টালজিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস  তার কবিতায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে।


ত্রিপুরা উত্তরপূর্বাঞ্চলের অংশ হলেও, শুরুতে ত্রিপুরা ও বরাকের বাংলাসাহিত্যের মধ্যে  স্বতন্ত্রতা নজরে পড়ে।এর কারণ হয়তো বরাক ও ত্রিপুরার ভৌগলিক পরিবেশের স্বতন্ত্রতা, উদ্বাস্তু স্রোতের অভিঘাতের স্বতন্ত্রতা। মানুষের সংস্কৃতিগত মিথস্ক্রিয়ার মাঝে গড়মিল।আবার উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাহিত্যেও বৃহত্তর বাংলা থেকে স্বতন্ত্রতার ছাপ স্পষ্ট। দিন দিন তা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে।আর ত্রিপুরা ও বরাকের সাহিত্যের মাঝে মেলবন্ধনের দধীচি হিসেবে যেন কাজ করে চলেছেন কবি পীযূষ রাউত---।


এবার দেখা যাক কবির কবিতা।কবি দেশভাগের বলি হয়েছেন।বলি হয়েছেন তাঁর হৃদয় বন্ধুরা‌ও। দেশভাগের বেনোজলে তারা হারিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার সোনা-হরিণ অধরা‌ই থেকে গেছে।গ্রামবাংলার মন্থর জীবনের ভালোবাসায় একদিন কবি যে জীবনের কল্পনা করেছিলেন।আজ তা উবে গেছে। দেশভাগের বিষবাষ্পে এই ভাবে কত স্বপ্নীল রমণীমোহন হারিয়ে গেছে।বহুধা মানে নিয়ে 'রমণীমোহনকে' কবিতাটি পাঠকের নিশি দরজায় এসে করাঘাত করে। ছিন্নমূল জীবনকেই দ্যুতিময় করে।কবি যখন বলেন,-
"আমি ঈশান,অগ্নি,নৈঋত ইত্যাদি কৌণিক দিকগুলি খুঁজে খুঁজে/আমার আবাল্য বন্ধু রমণীমোহন, ঠিকানা পেলুম না তোর।/বৈশাখের ঝড়ে আক্রান্ত নাবিক,মরুঝড়ে বোবা বেদুইন,আমি তোর/ ঠিকানা পেলুম না রমণীমোহন।/
তোর চরিত্র নিয়ে গল্প লিখে একদা বিখ্যাত হয়েছিলুম।/রমণীমোহন তোর নিরুদ্দেশ যাত্রার পর আমার আর গল্প লেখা হল না"(রমণীমোহনকে)।


কবিতায় শব্দের কচকচি নেই। জটিলতার আবর্তে আক্রান্ত নয় তাঁর কবিতা।শব্দকে টেনে টেনে বাড়িয়ে তুলেছেন সুরের নমনীয়তা।পাঠক,কবি না শুনে কবিতা শুনেই বলে দিতে পারে পীযূষ রাউতের কবিতা।ফলে তার কবিতা সতন্ত্রতায় ধরা দিয়েছে পাঠকের কাছে। সময়চেতনা, আদর্শবাদ ও বামপন্থীভাবাদর্শের ঘোরে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্য গর্জে উঠেছেন অনেকেই।কবিও নিজস্ব ভঙ্গিতে বুকের কথায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে গর্জে উঠেছেন,কর্ষণ করে তুলেছেন মানুষের জন্য মননজমি।কবি যখন বলেন,-
"ঘাসফড়িঙের আন্দোলিত ডানা/ভেঙে যায়/ভেঙে যাচ্ছে/ভেঙে যাবে বলে/একদিন/মধ্যরাত্রে শাসন করব/শহরের তামাম বড় বড় সড়ক।"(মধ্যরাত্রির ব্যাণ্ডবাদক) 


তিনি রোমান্টিক কবি।বেদনার মাঝেও  তাঁর রোমান্টিকতা হীরের নাকছাবির মতো জ্বলজ্বল করে।কল্পনামদিরায় ফুটে ওঠে কবির সময় যন্ত্রণার বিরুদ্ধে দ্রোহ।ফুটে উঠে কবির জলজপ্রেম।যখন তিনি বলেন,-"আমার প্রেম/ তোমার ভ্রমণ ছন্দের মত/'ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা'/আহা নদী যেন দূরান্তিক ব্রহ্মদেশ-ইরাবতী নদী।"
"আমার প্রেম শব্দভাঙার শব্দের মত/গড়িয়ে পড়ছে  কোলিয়ারি গহ্বরে;"
"আমার প্রেম/ ডায়নোসরের নির্জন ভয়ংকর পৃথিবীতে/নির্ভয়ে ঘুরছে ফিরছে"(আমার প্রেম)


স্বাধীনতা শব্দটা কৈশোরে তাঁকে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করেছিল। স্বাধীনতার মানে তাঁর কাছে অন্যরকম বিশেষ ঘ্রাণ নিয়ে এসেছিল। তিনি মনে করতেন ,স্বাধীনতা মানেই ভিন্ন এক আলোক সূর্য,যার স্পর্শে ফুটে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির এক মায়া পারিজাত ।যে আলোকে বিধৌত হলে,ভিখিরি পুরোণো কাপড় চাইলে,দরজার প্রিয় নীল পর্দাও অবলীলায় খুলে দান করা যায়।তাই কবি বলতে পারেন,-"আমাদের কল্লোলিত যুবক রক্তে গান হয়ে বেজে ওঠে জীবনের অন্য কোনো মানে।"(স্বাধীনতার গান)


সোনালীমাছ,সোনাদিন,শৈশব?স্বপ্নের পারাবত? ঘুনেধরা সময়ের বেনোজলে কবি অসম্ভব আহত।পথহারা কবি হিমেল ঘুমের দেশে যেন কোজাগরী রাত ।হিমের ভেতর অদৃশ্য শত্রুরা সোনালী দিনের শরীরের মাংস খুবলে খেতে আসে। সোনালী শৈশবের স্বপ্নে তিনি আঁতকে উঠেন। তিনি বলেন,-
"আমাকে তুমি সোনালী মাছের গল্প বলনা। সোনালী মাছ/সেই ক্রধী শিকারীরা কবে খুন করেছে।/এখন শূন্য জলের মধ্যে নিষ্ঠুর তিমি এবং হাঙরের/বিশাল চোয়াল!/
এই জলে বর্ণ নেই।গন্ধ নেই।স্বপ্ন নেই।"(সোনালি মাছের গল্প)


দেশভাগ,স্থানত্যাগ, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার টানাপোড়েন,ভয়,নিরাপত্তাহীনতা,ফের বাস্তুচ্যুচ হ‌ওয়ায় আশঙ্কা থেকে কবিতায় এক চিরকালিন প্রাণপ্রতিষ্টা যেনো।যখন কবি তাঁর মতো করে বলেন,পাঠককে নাড়িয়ে যায়।
"আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য/চিরকাল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকব। যেমন দেশের বাড়িতে /নৌকোর জন্য প্রতীক্ষমান মা ও আমি ও ছোট ভাই/ নদী তীরে/
উদ্দাম হাওয়ার মধ্যে/আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য/চিরকাল ঘনিষ্ঠ প্রেমের জন্য উন্মুখ ইচ্ছাগুলি/মিছিলের দাবীর মত সোচ্চার।"(আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য)
 

যখন এক ছিন্নমূল নুতন ভূখণ্ডে জৌলুসহীন যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের প্রদাহে আক্রান্ত হয়।নুতন পরিবেশে তার অবস্থানগত জিজ্ঞাসা যেন পাহাড় উপেক্ষা করে চলতে থাকে।কবি বলেন,-
"আমি কোথায়?/কোথায় আমি? আমার প্রশ্ন উদাসীন পর্বতমালায় প্রতিধ্বনি তুলল-/আমি কোথায়?/কোথায় আমি?/
আমার পায়ের নীচে বিষাক্ত এক কেঁচো/আমি চমকে উঠে বিষমভয়ে/লাফ দিয়েছি। এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসভর্তি বেলুনের মত শূন্যে উঠতে উঠতে/আমি একসময় সশব্দে ফেটে গেলে/আমার দেহ বহু নীচে পড়ছে তো পড়ছেই/পড়ছে তো পড়ছেই--!"(আমি কোথায়)


শিশু বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনিশ্চয়তা কবিকে হয়ত আলোছায়ার মতো কিঞ্চিত হলেও ছু‍ঁয়ে গেছে।কবির জীবনে দেশভাগ এনে দিয়েছে ছিন্নমূল জীবনের ক্ষয়িষ্ণু উচাটন।এই সব হারানোর খেলায় ছিন্নমূলের সংসারে  পুনরায় অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ছায়া ফেলে যুদ্ধের আবহে ।
"সৈকতের শিশু শরীরে হাত দিলেই/রক্তের মধ্যে শিহরণ অনুভূত হয়।/কল্যানপুর হাসপাতাল চত্বরে ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে/রামচন্দ্র নামে জনৈক দিনমজুর।/যুদ্ধ লাগতে পারে,যুদ্ধ লাগবে,এইরকম/ একটা উন্মাদ বাতাস ফিসফিস করছে/ দীর্ঘ কয়েকমাস।"(সৈকতের শরীর)


কবিতায় কথাবলার ভাষার টানটান উত্তেজনা তাঁর কবিতাকে নিজস্বতা দিয়েছে।তাঁর কবিতার মাঝে স্বপ্ন ও স্বপ্নহীনতার যেন এক চিরায়ত রহস্যময়তা খেলা করে,-"হাসিমুখে সমস্ত গ্রীষ্ম তিনি দাঁড়িয়েছিলেন/তাঁর নীল পোষাক। তাঁর বিশাল দুই হাতে।/আমাদের সকলের জন্য ভালবাসা।/তাঁকে বলা হত-এক সমুদ্রগামী জাহাজ আপনাকে বিদেশ/নিয়ে যাবে। আপনি যাবেন?/তিনি কোনো উত্তর দিতেন না।শুধু হাসতেন।"(তাঁর সম্পর্কে)


কবির চোখে দেশভাগ ভুল।স্থানত্যাগ আরেক ভুল,এখন পুনরায় স্থানান্তরিত হওয়ার চিন্তা ভুল থেকে ভুল।ভুল যেন এখন জিনেটিক কোডে প্রবাহিত।এ যেন ক্ষুধার্ত ঝোঁকের মতো লেপ্টে গেছে কবির আত্মার সাথে। তিনি  বলেন,-
"----ভুলের নাম মৃত্যু, মৃত্যুর নাম ভুল।কারণ/ভুলক্রমেই আমার জন্ম।ভুলক্রমেই আমার যৌবন‌ ও বার্ধক্য; অবশেষে মৃত্যু।এই দ্বিতীয় মৃত্যু দেহগত; অর্থাৎ নিতান্তই সাদামাটা।"
"এক অতি নিষ্ঠুর ক্ষুধার্ত ঝোঁকের মত আমার বুকের সঙ্গে এঁটে আছে ভুল।/কোনোমতেই তাকে আমি ছিন্ন করতে পারি না। কোনোমতেই না।"(ভুল- এক ক্ষুধার্ত জোঁক)


একদার নদীমাতৃক সন্তাপহীন বাঙালীর  ছিন্নমূল জীবন থেকে সাধ-আহ্লাদের মতো অনেক কিছু খু‌ইয়ে ফেললেও একটি অলঙ্কার যেন আজ‌ও রয়ে গেছে আত্মার সাথে। তিনি বলেন,-
"সাধের কথা/আহ্লাদের কথা বহু যোজন দূর।/"
"জেদ আছে নতি স্বীকার করানোর/যে আমার আজন্ম শত্রু,যার সঙ্গে প্রভুত্ব খাটানোর লড়াই/মুহুর্মুহু বাঁধে।"
"আমার সারা শরীরে দমকলের ঘন্টা বাজে----/আগুন,পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে/আমার পিতৃপুরুষের দলিল,/আমার আইডেন্টি কার্ড।"
"আমি গন্ধ চাই বেলি ফুলের,/আমি বর্ণ চাই গোলাপের। কিন্তু/হুড়মুড় শব্দে আসে ভগ্ন দূত;"
(বহু যোজন দূর)


বরাকের কোলে যাপন, পাহাড়ের নীরবতা,ধ্যানমগ্ন সৌন্দর্য কবিকে এক অনাবিল ভালবাসায় আত্মমগ্ন করে। তিনি যেন ধ্যানমগ্ন শিবের মতো পাহাড়ের সৌন্দর্য্যের কাছে কাবু হয়ে যান।সৌন্দর্য বিলাসী কবি অসম্ভব কল্পনামদিরায় আসক্ত হয়ে ধরা দেন পাঠকের কাছে।ধরা পড়ে বেদনার মাঝেও কবির এক অবাক করা শিল্পিত স্বভাব সুষমা। তিনি বলেন,-
"জ্যোৎস্না আর প্রেম নিয়ে ছল চাতুরী এ তোমার নয়।/দ্যাখো, এইখানে হাটের হল্লা নেই।নির্জনতা কী বিষম/শরীর এলিয়ে শুয়ে আছে।/
জ্যোৎস্না ও প্রেম এইখানে অনর্গল গড়ে তুলেছে/শিল্পের স্বভাব সুষমা।"(-কেউ বলবে না)


আবার আশ্চর্য বরাকের পরাক্রান্ত রূপ-অরূপ‌ও কবির দৃষ্টি এড়ায় না। তিনি বলেন,-"দাঁড়ের শব্দে উতলে উঠে বরাকের জল 'কে হে' পরাক্রান্ত শব্দে/ প্রতিধ্বনি তুলে সমূহ বৎসর এক/নিদারুণ ঝড় গেলঃবরাকের ব্রিজে অদূর শিলং কাঁদে,/বিচ্ছিন্ন ভূগোল জুড়ে শীতের শরীর, প্রতিবাদে/আমার স্বপ্নের থেকে/ঘনতর মৃত্যু নিয়ে ক্ষিপ্ত বরাক-দূরে--"(বরাক)


বরাকের প্রকৃতি, চাবাগান কবিকে হরিপ্রসাদ হাজামের নেশার মতো টানে। অসম্ভব একাত্মতা অনুভব করেন কবি। তিনি বলেন,-"বামহাতে চা-বাগানের অনুচ্চ টিলাভূমির অনন্ত সবুজ।পাখি পাখালির ভিড়।/ডানহাতে সর্পিল কুলি-লেন।মাটির ছোট ছোট ঘর।দেয়ালে/আদিবাসী চিত্রাঙ্কন আর মদমাতাল জ্যোৎস্নায় হরিপ্রসাদ হাজামের নেশাজড়ানো কন্ঠে মহম্মদ রফি।"(চাতলার মুখ)


কখনো একটি সংঘাত মুহূর্তের রগরগে ছবি ফুটে ওঠে।মনে হয় নুতন পরিবেশে পাহাড় আর সমতলের মাঝে যেন মুহূর্তে সংঘাত বেঁধে যাবে।এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উদ্বাস্তুদের জীবন মাঝেমধ্যেই সংঘাতের আশঙ্কায় থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটে না যেন। উদ্বাস্তু জীবনের অনিশ্চয়তা ফুটে ওঠে তাঁর রোমান্টিক চেতনায়।"রাস্তার দুই ধারে দুই পুরুষ/এক প্রবলতম সংঘাতের অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী/পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে র‌ইলো/কাল সাইরেন বাজলে তারা যে যার ঠিকানায়/ ফিরে যাবে।অথচ ঠিক ফিরে যাবে বলে কেউ‌ই আসেনি।/সর্বনাশের ভঙ্গিমায় রুখে দাঁড়িয়েছিল"(সংঘাতের অপেক্ষায় এবং তারপর)


কবি বুঝি অঙ্কন করেন ছিন্নমূল যুবকের চেহারা। দেশের স্মৃতি হয়তো তাকে তাড়িত করে।ফিরে যান নিজের মূলজের সন্ধানে। কিন্তু সহসা যেন হোঁচট খান ,কেউ যেন ভেতর থেকে প্রত্যাবর্তনের শূন্যতায় হাত দিয়ে  প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।তাঁর খেদ-উচ্চার,-
"সহাস্যমুখ জল আয়নায় ছায়া পড়ে/প্রবল ঢেউ-এ প্রতিবিম্ব টুকরো ছেঁড়া;/দেখুন চেহারা দেখুন,/নিম্নবিত্ত হিন্দু যুবা ঠায় দাঁড়িয়ে মধ্যপথে। প্রশ্নপত্র কঠিন বেজায়,শব্দ উঠবে কার জন্য প্রত্যাগমন?/অর্ধপথে/গোলাকৃতি নির্দেশিকায় থমকে আছে 'থামুন'।(থামুন)


এই নীল অববাহিকায় বৃষ্টি নেমে এলে কবির বুঝি শৈশবের কথা মনে পড়ে?
"এখন কোনোদিন সারাদিন বৃষ্টি হলে/আমার বুকের মধ্যে/আততায়ীর পদশব্দে জেগে ওঠে অমলিন স্মৃতিঃ কচুপাতার বুক চিরে/কমলা রঙের ফুল"(উপলক্ষ ছাড়াই)


বাঙালির জীবন রবীন্দ্রধ্যান ও অনুধ্যানের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।এর বাইরে যেন এক পাও যেতে রাজি নয় সে।আসলে মনে হয়,ছয়ের দশক এমন এক দশক যখন কবিদের রবীন্দ্রবলয় থেকে বেরিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা।এ যেন বাঙালী যুবকের বুকে  এক নুতন দিশারী ফেলুদার আবির্ভাবের মতো।আর তখন যুবক কবিদের তা বরণ করার উন্মাদনা পরিলক্ষিত।এই ফেলুদাই বুঝি হয়ে উঠে সেই সময়ের ত্রাতা। তিনি শুনতে পান,-"সে আসছে   তার/গোয়েন্দা শরীর/তার/সতর্ক হাত,মাপা পদক্ষেপ/স্পষ্ট হচ্ছে।"
"সে আসছে   তাকে/স্বাগত জানাব,/এসো, হে এসো হে/অবলীলায় খুন করো/আমার এই অযোগ্য শরীর।"(সে আসছে)


এ বুঝি আত্মধিক্কার?নুতন জায়গায় এক পরিমল পরিবেশে কবি এসেছেন, এখানকার মরশুমী জীবন দেখার মতো যেন বিশুদ্ধ নয় শরীর ও মন।কেননা দেশভাগ,আপন জনের ঘৃণায় যেন তাঁর শরীর ময়লাযুক্ত।নুতন পরিবেশে মানিয়ে নিতে গেলে যেন কবির প্রয়োজন এক প্যাকেট সার্ফ।তাই তিনি অবলীলায় বলতে পারেন স্বকীয় ভঙ্গিতে,-
"আমার শরীর ও বাগানের আবর্জনা দূর করে/চাই এক প্যাকেট সার্ফ।/যেখানে গিয়েছি/এনেছি শহর ও গ্রাম পুড়িয়ে ছাই, বেমানান প্রেমিকার থেকে ঘৃণা।/(চাই এক প্যাকেট সার্ফ)


মিটারগ্যাজ রেলগাড়ি উত্তরপূর্বাঞ্চলের দীর্ঘদিনের অলসতার প্রতীক সরূপ।যেন প্রতীকসরূপ বড়াইল পাহাড়ের অলসতার। আবার এ যেন ব্রিটিশ আভিজাত্যের প্রতীকও।যেমন কবি সামন্ততন্ত্রের শেষ প্রতিভূ। নির্জনতা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক ডজন যুদ্ধংদেহী সেপাহী যেন দুঃসময় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড় জীবনের অনিশ্চয়তা যেন স্পষ্ট করে তুলে,যেখানে অনিশ্চিত আবহে যৌবন‌ও যে দম দেওয়া পুতুলের মতো।রেল,পাহাড়, প্রকৃতি রোমান্টিক কবির জলতুলির টানে বাঙ্ময় হয়ে উঠে।কবি প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে যান। তিনি বলেন,-
"অহংকারী পাইথনের মতো নাতিদীর্ঘ অলস রেল/মাইগ্রেংডিসার ক্ষুদ্র স্টেশনে ইন করে।/আমার ডানচোখে কৌতূহলী বড়াইল।নীচে অলস ভূখণ্ড জুড়ে/বুনো উদ্ভিদ ও একপাল মহিষের পিঠে পাহাড়ি রোদ /আলগোছে শোয়/নির্জনতার মূর্ত ক্যানভাসে /আধডজন সশস্ত্র সেপাই যুদ্ধং দেহী দাঁড়িয়ে থাকে,------/পাথরে খোদাই বয়স্কমুখে দুঃসময় স্তব্দ হয়ে আছে। বৈরী ডিমাসা/আনাচকানাচ কোথাও কি অপেক্ষমান?
অন্যত্র সৌখিন যুবা। নিতান্তই লাইনম্যান।হাতে সবুজ ফ্ল্যাগ।/যেন আকাঙ্ক্ষাবিহীন যৌবন দম দেওয়া পুতুলের মতো ছাড়পত্র দ্যায়।/মিকির রমণীর পিঠে বাচ্চা ও টাটকা আনাজ।ভিড় করে তড়িঘড়ি উঠে/অদূরবর্তী মাইবাং স্টেশনে আজ সপ্তাহিক হাট"(সামনেই লামডিং)


ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের এক শেষ প্রতিভূ নুতন পরিবেশে প্রচণ্ড কৌতুহলী হয়ে পাহাড় জঙ্গল দেখছেন।এখানে তার কোন ঐশ্বর্য নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে এক একটা দৃশ্যপট যেন তাকে পাইয়ে দেয় তাঁর অতীত প্রভুত্বের আস্বাদ।আর ক্ষণকাল বোধশূন্যতায় এই প্রকৃতির রূপের কাছে হার মানেন।ভাবেন, প্রকৃতির এই রাজকীয় গুরুগম্ভীর রূপ ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না। তিনি বলে উঠেন,-"কাজিরাঙার রিজার্ভ ফরেস্টে পিঠের উপর কৌতূহলী যুবা,/রাজকীয় ভঙ্গিমায় হেঁটে যায় হাতি/খুব কাছেই তিতির হরিয়াল কিংবা অন্য কোনো পাখি উড়ে যায়/আচম্বিতে,কেউ কি এলো?/টেলিগ্রাফের তার শূন্যতায় অতঃপর ডিগবাজি খায়।/এইভাবেই তৈরি হয় প্রাকৃতিক দৃশ্যপট।/এই সব ছেড়েছুঁড়ে/আমি আর সমুদ্রে যাবনা,গৃহকোণে মানুষ‌ই হব না।/"(দৃশ্যপট)


টেলিফোন! টেলিফোন কি ছিন্নমূল কবির মাঝবয়সের অনিশ্চিত জীবনের প্রতিফলন।কখন কোন খবর আসে এমন একটা বিম্বিত সময়ের মুর্চ্ছনা?কবি যখন বলেন,-
"ঘুমে কিংবা জাগরণে/যখন তখন/বেজে ওঠে ভৌতিক টেলিফোন।/------------------টেলিফোন, এখন আমার যখন মধ্যবয়স,মুহর্মুহু বাজে----"(স্যার আপনার টেলিফোন)


বাংলার অন্যতম ঋতু গ্রীষ্ম।এই পাহাড়ে বৃষ্টি এলে কবির কাছে শৈশবের স্মৃতি উজ্জ্বল গহনাপড়া নারীর মতো আবির্ভূত হয়।কবি এই দৃশ্যে পাহাড়ের বন্দীজীবনে পাগল হয়ে ওঠেন। স্মৃতি কাতর হয়ে ফের উচাটন করতে থাকেন।
" আজ বৃষ্টি।/সারাদিন বৃষ্টি।তুলকালাম বৃষ্টি।/বৃষ্টির ভিতর সোনার উজ্জ্বল গহনা পরে/কে তুমি অধিকতর বৃষ্টির দিকে/সুনির্দিষ্ট পা--"
"তোমার ঘুঙুরের শব্দে,কঙ্কনের শব্দে/একজন বন্দী পাগল হয়ে যায়।"
যুবক গ্রীষ্ম এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে ঐ দিকে,/যেদিকে উন্মুখ শ্রাবণ"(আজ বৃষ্টি)


কবিতায় ধরা পড়ে স্বভাবজাত প্রকৃতির বর্ণনা।কোন পাহাড়ের সাধারণ গল্প‌ও কবির কাছে জীবনমুখী মনে হয়।কবির উৎসুকময় প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি থেকে তাঁর কবিতাকে আলাদা করা যায় না।তাঁর কবিতা এক জীবনবেদ মনে হয়।যখন তিনি বলেন,- 
"গারো হিলস থেকে/কোনো এক জংলি নদী-কী নাম,কী নাম-/নাম তো জানিনা।/ক্যাঙারু বাচ্চার মত লাফিয়ে লাফিয়ে/পাহাড় থেকে পাহাড়ে/টিলা থেকে সমতলে ছোটে।/তার বুকের ভেতর পাথর-পাথর হাজার পাথর।/আনাচে কানাচে/মাছেদের নিরুপদ্রব সংসার।মাছ?কী মাছ?"(ঘারো হিলসের গল্প শুনে)


যে স্বাধীনতা কবির কাছে ছিল জীবনের অন্য কোনো মানে।সেই স্বাধীনতার চিচিংফাঁকে পড়ে যাবেন একদিন, তিনি জানতেন না।তাই কবির মনে অসম্ভব ধীক্কার আসে। তিনি নিজেকে ধিক্কারে ধিক্কারে জর্জরিত করে তুলেন।যা পাঠককের চোখে স্বাধীনতার মুখ কেমন,তা স্পষ্ট করে তুলে। তিনি বলেন,-"ক্যাপসুলের মত গিলে খাও। বিরক্তি খাও ভালবাসা খাও/------------/চিচিংফাঁক কারেন্সি নোটের নতুন গন্ধে ফিরে পাবে/তাগড়া যৌবন।/হস্তান্তর কর সুখ ও অভাব। হস্তান্তর কর লোভ ও নির্লোভ। স্বাধীনতার ঘোড়া গুলিতে হত হলে/বিশ্বস্ত গোলাম-ঘাড় গুঁজে পড়ে থাক।"(খাও)


উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে দেখে কবির গর্ব হয়?তিনি বলেন,-
"উচ্ছৃঙ্খল জনতা/তোমাদের সমাধি ফলকে লেখা থাকবেঃ/শুক্লপক্ষে তাদের মৃত্যু তাদের যথার্থ বয়স/বড় কম ছিল,তারা জ্যোস্না বলতে আঁধার বুঝেছে/তাই বলে তারা ডাকাত ছিল না।"(সমাধি ফলকে লেখা থাকবে)


যদিবা ফুরসৎ মিলে কোনো উপলক্ষে ,কবি দিগন্ত আঁকা বরাকের প্রকৃতির সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। ঘুরেফিরে আসেন মনপবনের খাল বিল হাওরে।যখন তিনি বলেন,-"বহুদিন পর ক্যাসেট রেকর্ডারে/হেমন্ত মুখুজ্যে পুনশ্চ তুমি। তোমার সেইসব বিখ্যাত গানের অনুষঙ্গে/উত্তমকুমার তুমিও পুনশ্চ।/তোমাদের অবিস্মরণীয় মুখ আমাকে বহুকাল পর নিয়ে যায়/চাতলাভ্যালির উজ্জ্বলতায়।/জলসার পুল থেকে বড়জালেঙ্গা।বড়জালেঙ্গা থেকে/রোজকান্দি।অথবা উল্টোপথে ধোয়ারবন্দ থেকে হাইলাকান্দি।সর্বত্র সেই অবাকভ্রমণ।"(উপলক্ষ)


অথবা নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হ‌ওয়া কবির মর্মবেদনা পাঠকের হৃদয়ে হাহাকার তুলে।শৈশব ভ্রমণ,যৌবন ভ্রমণ স্থানকাল পাত্র একাকার হয়ে যায়।তিনি বলেন,-"ছোটজালেঙ্গার সেই সব বিরল রাত্রি/চা-বাগানের অদ্ভুদ মাতাল গন্ধে বুদ্ধদেব অরুণ মিত্রের/কবিতার অনুষঙ্গে নেশা ধরাতো/তরুণ-রক্তে আর,গা-ঝাড়া স্বাধীন ভাবনায়/ পঁয়ত্রিশ বছরে দীর্ঘ সময়/ডাকাতের মত কেড়ে নিয়েছে আমাদের বহু বহু মূল্যবান সম্পদ।/আকন্ঠ মদ গিলে বেহিসেবী সীতাংশু আজ /পাঁশুটে অ্য|লবাম।/ফ্লুরোসেন্ট জ্যোৎস্নার  বহাল স্বাস্থ্য/ আজো আছে।আছে চা-বাগানের মাতাল গন্ধ। সমস্যার/তন্তুজালে আছি আমরা অনেকেই।তবু/কোথাও যেন ফাঁকি,নিরন্তর ফাঁকি/কোথাও যেন শূন্যতার শব্দহীন সমুদ্র-প্রান্তর/কোথাও যেন মেঘলা বিষাদ সমস্ত যোগসূত্র ছিন্ন করে/বলে,এই সব জন্মান্তরে ছিল।"(ছোট জালেঙ্গা ১৯৫৮)।
অথবা-
"ছিল বটে ,বেশ কিছু অত্যুজ্জ্বল দিবস ও রাত্তির।ছিল বটে/ চাবাগানের সবুজে গন্ধে হৈ হৈ আড্ডা।সীতাংশুর বাড়িতে/সুধীন দত্ত অরুণ মিত্রের কাব্যপাঠ আর নিজ নিজ /সৃষ্টির অপূর্ব উল্লাস।ছিল বটে অঞ্জুদের বাড়িতে/স্বাধীনতার অপূর্ব আস্বাদ।/
সময় এক দুর্দান্ত তস্কর।---------/
আশেপাশে কিংবা দূরত্বে ইয়ার দোস্ত কেউ নেই।যে যার নিজস্ব/ নিয়মে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।সীতাংশু উত্তর চল্লিশেই মৃত।/অঞ্জুদের পরিত্যক্ত বাড়িতে গভীর জঙ্গল।এখনো কোনো কোনো দিন/হাইলাকান্দির পথে নিরাসক্ত চোখ যায় মুহূর্তের দেখা জঙ্গলের দিকে।


বয়স কবিকে বুঝি পাকিয়ে তুলেছে।
বুকের ভেতর অন্তহীন বালিময় দুঃখ।প্রবল দুঃখেও ভালো থাকার অভিনয় করতে জানেন।কবির আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে কোনদিন যে কোনোদিন তিনি বেদুইন সর্দারের মতো যাবতীয় যন্ত্রণার উপশমকল্পে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।কবিতার বুনন পাঠককে শিহরিত করে।
"বয়স যত‌ই হোক,অদ্ভুত কৌশলে লুকিয়ে রেখেছি/বুকের অসুখ, বেশকিছু কাঁচাপাকা চুল।/ভাদ্র-রোদে ‌ঝাঁঝাঁ করছে বালি।যতদূর দৃষ্টি যায়/শুধু বালি আর বালি।/বালি তো বন্ধ্যা নারী।তার গোপন দহন আছে/তির তির দুঃখ আছে মনে।/সজ্ঞানে অস্বীকার করি তাকে।/অভিনয় এক নিদারুণ শিল্প হয়ে/চৈতন্যে দিয়েছে অন্ধকার মেঘ।/
অচিরেই একদিন/বেদুইন সর্দারের পাথর-রুক্ষতা অবয়ব নিয়ে/মুখোমুখি হব প্রবল শত্রুর।"(বেদুইন সর্দারের রুক্ষতার অবয়ব নিয়ে)


শৈশবের সবুজ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে,আর ফিরে যান শৈশবের নীল সবুজ নদী-বাঁকে। কবি শৈশব কাতর হয়ে ওঠেন। শৈশবের নীলচিল সবুজ রেলগাড়ির মতো বেদনা নিয়ে আসে। তিনি বলেন,-"যেন স্বপ্নে কিংবা অর্ধজাগরণে/নীল চিল/সবুজ রেলগাড়ি,অস্পষ্ট ধোঁয়ার মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে/দূরান্তিক রেলব্রীজ, কুশিয়ারা নদী;নদী-জলে/ইলিশের দেহ থেকে রুপালি বিদ্যুৎ/জ্বলে ওঠে জেলেদের জালে।"(ফিরে যাওয়া)


যাপনের ধারাজলে বাহিত হয়ে শ্রীহট্টের বালক ভাসতে ভাসতে চলে আসেন ত্রিপুরায়। এখানেও যেন তাঁর শৈশবের সাথে সংযোগ ধরে থাকে মিটারগ্যাজ মন্তর এক রেলস্টেশন।আর এমন পরিবেশে এসেও জেগে ওঠে সংকেতময় এক গা-ছমছম করা অনিশ্চয়তা।
"জানুয়ারি পাঁচের বেলাশেষে/ডিজেলের পোড়া গন্ধে প্রায় বিপন্ন এই মধ্যবিত্ত কবির দিন যায় মধ্যপাহাড়ে,রেল ইস্টিশনের একান্ত সমীপে।/কবির দিন যায় বড়‌ই মন্থর।/
যেন হঠাৎই একসময় পাতাল ফুঁড়ে প্রাগৈতিহাসিক আঁধার;/গা-ছমছম ভুতুড়ে বৃক্ষের মত বিস্তৃত করবে অসংখ্য প্রশাখা।"(ত্রিপুরার মধ্যপাহাড়ে)


ছিন্নমূল-জীবনের শীতের বানে উপেক্ষিত হতে হতে একদিন কবির আর শেষ অবলম্বন টুকুও থাকে না।কবি বলেন,-
"একদিন দেখি  প্রসারিত হাত উপেক্ষার শীতে/সংকোচিত হতে হতে হাত নেই।/হ্যাঁ।হাত নেই। অবলম্বন চুরি হয়ে গেছে।"
"এক হ্রদ প্রিয় অন্ধকারে/অন্ধকার,তুমি আছ প্রিয়তর হয়ে।"(প্রিয় অন্ধকারে)


কবি শুরু থেকে শেষ অবধি নিজেকে অবলোকন করেন।এই শেষ বুড়ো বয়সে তাকে আর চেনা যায় না।কবি ফিরে যান আলোআঁধারি মাখা এক স্বপ্নের দরিয়ায়।ঘুরে ফিরে বারবার আক্রান্ত হন নস্টালজিক জ্বরে।রোমান্টিক চেতনার আঁধারে ভেসে ওঠে যেন তাঁর প্রতিভূ।হাহাকার ওঠে।
তিনি বলেন,-এক ধূসর স্বপ্নের ভিতর/শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি খামারবাড়ি।/পাশেই দিগন্ত ছুঁয়ে ধানজমি।চারাধানের জমিতে ঢেউ ঢেউ ছবি আঁকে মৌসুমী হাওয়া।/বাড়ির চতুর্দিকে প্রাচীন পরিখা।সবুজ গালিচার আস্তরণ পেরিয়ে/ জলসাঘরের মত বিশাল ঘর।/বুঝা গেল এই পরিত্যক্ত বাড়িতে/নবাব নেই, নিদেনপক্ষে কোনো জমিদার।/
বাঁশের নক্সা-আঁকা গ্রীল আড়াল করেছে গৃহাভ্যন্তর।/শুধু আলো-আঁধারের রহস্যময়তায় এক বুড়ো কৃষক চিত্রার্পিত/বসে আছে সুপরিসর দাওয়ায় একা।/--------------/বুড়ো তুমি জমিদারের অভিশপ্ত উত্তর-পুরুষ?"(একটি স্বপ্নচিত্র)
"তার ভুবন বিখ্যাত উচ্ছাস যা জলপ্রপাতকেও লজ্জা দিত/তার শিব্রামীয় কৌতুক যা মার্কিনী জোকসকেও/পরাভূত করত/তার সেই ঘর চমকানো অট্টহাস্য যা কুম্ভকর্ণের নিদ্রাকেও/পলকে ছিন্ন করত,সে/আজ বাকশক্তিহীন।-----"(আরো বেশি বোবা)
  

ভুল থেকে ভুলে ভুলে ভুলের জন্ম হয়।এ থেকে যেন আর নিস্তার নেই। কৃষ্ণচূড়ার রক্তলাল খোয়াইয়ের পথ,অবাক উল্থানের আশ্বাস দেখেছিলেন কবি।এই আশ্বাসও যেন ভুলে পর্যবসিত হয়।আর নিজেকে অবশেষে জন্মজুয়াড়ী ভিন্ন কিছু মনে হয় না। তিনি বলেন,-
"জন্মজুয়াড়ীর মত খেলে যাই সম্বৎসর আত্মঘাতী খেলা।/অথচ একদিন; বহুদিন আগে /কৃষ্ণচূড়ার রক্তলাল খোয়াইয়ের পথে ছিল অবাক উল্থান।"
"ভুল কল্পনায় দিন যায় দিনান্তের দিকে। আমি এই ৮২'র মধ্য পথে /পৌঁছে গিয়ে নির্ভুল জেনে গেছি-এক ভুল থেকে জন্ম নেয় একশ কোটি ভুল,"(জন্ম জুয়াড়ী)


কবির বেদনা,দেশভাগ যন্ত্রণা।কবিকে বারবার আহত করে,বহুরূপে। হাহাকার করে ওঠে তাঁর হিয়া!তিনি বলেন,-ম্লান স্বপ্নের ভিতর এ কোন কোজগরী রাত?বাদামী ঘোড়া/ দৌড়ে যায় অরণ্য পেরিয়ে অনন্তের দিকে।"(বেঁচে উঠি কোজাগরী রাতে) অথবা তিনি যখন বলেন,-দেশবিভাজনের ক'বছর আগে/কুশিয়ারার ঐপারে সবুজ ও হলুদের চিত্রাঙ্কনে সরিষার আদিগন্ত/প্রসারিত ক্ষেত একটি সাধাসিধে কিশোরকে উজাড় করে ঢেলে দিত/অকথিত সুখ ও বিস্ময়।/
হঠাৎ কোনো কোনোদিন দূরস্থিত কলিকাতা বন্দর থেকে মালবাহী জাহাজ/কুশিয়ারার শান্ত জলে অশান্ত কল্লোল তুলে/সেকালের বন্দর শহর শিলচরে যেত।/ঐ সময় মধ্যগাঙে উথালপাথাল ঢেউয়ের মধ্যে ভয়ঙ্কর ডুবডুব খেলায়/মেতে উঠত দু'একটি দুঃসাহসী জেলেদের ছিপছিপে নাও।/কদাচিৎ আজো কুশিয়ারার ঐ দুটো বর্ণময় ছবি কিশোর থেকে/মধ্যবয়স্ক হয়ে ওঠা পুরুষকে বলে,-কিগো মনে পড়ে-আমাদের কথা?"(একটি প্রাচীন চিত্র)
 

রোমান্টিক কবি প্রকৃতির মাঝে জীবনের অনিশ্চয়তার ভয়ালরূপের ছবি বুঝি অবলোকন করেন।আর অবলীলায় বলে ফেলেন তাঁর পংক্তি,-
"ঊনকোটি বেলকুমের দাবানল শহর ধর্মনগর থেকে/চোখে পড়ে না।--------------------------/
পশ্চিমের কৈলাশহর থেকে একসময় সারারাত চোখে পড়তো/সেই সে আগুন। হাজার মশালে সুসজ্জিত আদিবাসী/যোদ্ধাদের ক্রোধ কি-না বোঝা যেত না।/এখন, এখানে স্কুলবাড়ির ঘেরা চত্বরে সবুজ ঘাসের জমি/কালো হচ্ছে ক্রমে। আকাশের চেহারা রাগী না-কি বিষণ্ন/বোঝাই গেল না।উড়ে আসছে নিহত উদ্ভিদের দেহাবশেষ/ছাই-ভস্ম ইত্যাদি----"(ঊনকোটি বেলকুম থেকে)।


পাহাড়ে তিন দশক কেটে গেছে।কবি এখন পাহাড় ভ্রমণের বিজ্ঞাপন দেখে হতচকিত হন,এ তাঁর কাছে বাহ্য মনে হয়।কারণ পাহাড়ের অন্তরের প্রণয় জানতে জানতে তাঁর চুলে পাক ধরছে। প্রকৃতি প্রেমিক কবি যেন অভিমানী হয়ে ওঠেন।
"অরণ্যের প্রমত্ত প্রণয়/বহুকাল অবোধ্য ছিল।তিন তিনটে মূর্খ দশক /এমনি এমনি শেষ হয়ে গেল।/
চল্লিশোর্ধকালে ভেসে উঠেছে দ্বীপ/এতকাল অনিশ্চিত ছিল।/রেলগাড়ি ট্যুরিস্টকোচ,তুখোড় গাইড-এহো বাহ্য/তার কাছে যাব বলে/চুলে রঙ-তৈরী হচ্ছে বোধ।"(চল্লিশোর্ধকালে)
"তীর থেকে দূরে/সত্যি যাই?/সমুদ্র কি অন্তিম আশ্রয়?"(আশ্রয়)
অথবা
"যতক্ষণ চত্তিরের হাওয়া/মন্দ নয়,বরং খুব বেশি স্বাদু-বালাগঞ্জ হাওরের/ছলাৎছল ঢেউ ভেঙে নৌকো যায়/মাসিদের মামাদের বাড়ি।/অতঃপর চত্তিরের হাওয়া যখন বোশেখির ঝড়,/ভালো নয়,বরং মৃত্যু ভয় খুব-বালাগঞ্জ হাওরের/মহাকাল-মহাদেব ঢেউ আছড়ে পড়ে দেহে।/আশ্রয়,আশ্রয় কোথায়?সামনে যে ডাকাতের দ্বীপ!"((জলভ্রমণের স্মৃতি)


অবশেষে,নিজেকে গেছোব্যাঙ -ছাড়া কিছু ভাববার অবকাশ পান না। অবিলসিত জীবন শূন্যতায় নেমে আসে।
"ইস্কুলবেলায়/'তোমার জীবনের লক্ষ্য বিষয়ে পরীক্ষার খাতায় উত্তর-পত্রে লিখেছিলি-/আমি টার্জান হব।/হতে গিয়ে অবশেষে গেছো-ব্যাঙ হলি!"(গেছো ব্যাঙ)।
"----খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে/খোঁজামাত্র সার। তোমাকে পাওয়া গেল না/কোথাও,কোনো পৃথিবীতে।"(খোঁজ)


আর কবি সখেদে বলেন,-
"আমি‌ই আমার মনোহরণ স্বাধীনতা।হায় স্বাধীনতা!"(ম্যাঁয় আজাদ হুঁ)


অস্তিত্বশূন্য হয়ে বুঝি অস্তিত্বহীনের ঠাকুর ঘরের পেছনে অন্তিম শয্যায় শায়িত হয়ে হলেও অস্তিত্বের জানান দিতে চান?যে অস্তিত্বের আস্বাদ তিনি লাভ করেছিলেন ভিন্নরূপে শৈশবে,দেশের বাড়িতে।যা তাঁর বংশানুতে শায়িত এখনও।তাই কি তিনি বলেন,-
"ঐ লাল বাড়িটার পেছনে/আমি যৎসামান্য জমি কিনবো আমার ব্যক্তিগত /শ্মশানের জন্য, একমাত্র এটাই হবে আমার ব্যক্তিগত সম্পদ/তুমি আলোক,/আমার একমাত্র সন্তান,আমি দুঃখিত/তোমার জন্য, তোমার এই ৫ফুট১০ইঞ্চি দেহ বাদে,/ আমার বিধবা স্ত্রী এবং/তোমার এই পদবী বাদে আর কিছু দিয়ে যেতে অক্ষম----।"(ব্যক্তিগত শ্মশানের জন্য)।


কিন্তু কবি বুঝেন নিজের অস্তিত্ব আধারিত নিজের বঙ্গভাষায়, মাতৃভাষায়।তাঁর হার্ট বঙ্গভাষার হৃদপিন্ড। তিনি বলেন,-
"আমার গ্রীবা জুড়ে জন্মগত/এক চিলতে কালো দাগ।"
'আত্মহত্যা'এই অদ্ভুদ শব্দটা মনে মনে উচ্চারণ করলেই বুকের মধ্যে/অসম্ভব হিম পড়ে, মুহূর্তে‌ই/মুহূর্তের জন্য ঘড়ি, আমার নিজস্ব ঘড়িটা স্তব্দ হয়ে যায়,ঘড়ি মানে হার্ট,বঙ্গভাষার হৃদপিন্ড।"
"অস্তিত্বের মোহে বড় লোভ আমার-----"(আত্মহত্যা বিষয়ক)


ফের বুঝি জেগে উঠে শত্রুরা।।কবি বলেন,-
"------- ,বয়স যখন চল্লিস ছুঁ‌ই ছুঁ‌ই,/দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে দ্যায় টেবিল থেকে টুকরো কাগজ"
"----তারা আমাকে টেনে হেঁচড়ে,হিংস্র/ হিস্ হিস্ শব্দে নিয়ে যাবে বধ্যভূমিতে---"
"রূপসী নীলিমা, আমার অসম্ভব ইচ্ছে হয়, তোমাকে নিয়ে কোথাও না কোথাও পালিয়ে যাই।"


স্বাধীনতার মানে বুঝার আগেই এক অলৌকিক সত্ত্বা বুঝি ঢেকে দিল আকাশ, সন্ধ্যা নামল, ঘুমিয়ে গেল পৃথিবী।
কবি বলেন,-
"হরপ্পার ধ্বংসস্তূপের উপর/------------আকাশ- আবহে/তোমার বিশাল দেহ থেকে শতগুণ বিশাল দেহ/আঙুল তুলে শাসন করছে ভারতবর্ষ।/শাসন নাকি অপশাসন,নাকি অলৌকিক সুশাসন/অনুভবভেদ্য হবার আগেই/ ঝুপকরে সন্ধ্যা নামল/আকাশ-আবহে/তোমার সদ্য অদৃশ্য- অবয়ব ভুলে গেল ঘুমন্ত পৃথিবী।"(ভারতবর্ষ)


অন্ধকার-আচ্ছাদন করে কবির নির্বাসিত শিরা উপশিরা?
কবি বলেন,-
"যে পনেরোজন তরুণ হৈ-হুল্লোড় করতে করতে /মিনিবাসকে বোয়িং ভেবে অরণ্যভূমিতে/  পিকনিকে গিয়েছিল,তাদের মধ্যে দু'জন /গভীররাত্রে অচৈতন্যপ্রায় যখন বাড়ি ফিরল,তাদেরকে/চটজলদি সনাক্ত করা তাদের মা-বাবার‌ও সাধ্য ছিল না।"(পিকনিক)


কাণ্ডারিদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে আর বাকি থাকে না।তাই কি তিনি বলেন?
-"তোমার প্রয়োজনের কথা জানি গো জানি।/তুমি বাড়ি বানাবে ।আমাকে উনুনে ঠেলে দিয়ে/ ভাত রাঁধবে,হরেকরকমের খাবার।/তাই বলে তরুণ সন্তানকে খুন করবে কেন?/বরং বুড়ো আমাকে খুন কর।আমি হাসিমুখ দধীচি হব।"(ভারতবর্ষ)


তাঁর চেতনার শিকড়ে  হানা দেয় বারবার সেই সর্বভুক সোনাচিল, ঠোঁটের আঘাতে আঘাতে ফালাফালা করে তৃষিত বুক।এ থেকে যেন উত্তরণ নেই, অধঃপতন নেই।
"হঠাৎই তিনলাফ-/কে তুই?ক্যাঙ্গারু না ছেঁড়াখোড়া মেঘেঢাকা/ চাঁদ-অস্থির চাঁদ!/
আকস্মিক আমাকে দেখাবে বেয়াব্রু শরীর-চাঁদ তুই/নদী সাঁতরে, বহুদূরে বর্নি ব্রিজ থেকে গেঁয়ো গাড়ির সঙ্গে/সমানে পাল্লা দিয়ে,/এই দেশে আমার‌ই শহরে/অসময়ে আজ!"(বর্নি ব্রিজ থেকে চাঁদ)
কিংবা-
" অসচ্ছ হতে থাকা সেই বালক-বয়সে ফিরে যাবে নদী।"
"বালক বয়সে ছিল না অদৃশ্য অসুখ, ছিল না প্রোজেক্ট-বন্ধন, ছিল না/ডহর গভীরে রহস্যের ভয়াল জটলা।/
তবু ফিরে যাবে নদী।বালক বয়সের লোভ আকন্ঠ বিস্তৃত/কুরে খায় গিলে খায় ধ্বংস করে অর্থ ধর্ম রাজনীতির করোটি কঙ্কাল।"( ফিরে যাবে নদী)


কবি বুঝি অভিমানী হয়ে ওঠেন,অবস্থান করেন ধরাঅধরার বাইরে!
"দূরাগত মেঘ এসে বলল-/গুমোট গরমে বাতাস এসে বলল--/তোমাকে দেখতে এলুম।/বিস্ময়ঘোরে চমকে উঠে চক্ষু।বলে-/ক‌ই, তোমাদের তো চিনতে পারলুম না।"(মেঘ ও বাতাসকে)

কবি টের পান বুঝি?

"গুলির শব্দে/আগুনে উত্তাপ/ক্রন্দনে সন্তাপে অধীর হৃদয় থেকে-/পালিয়ে যাচ্ছে পাখি ও হরিণ।ওরা যাবে কোথায়?/আকাশ,আকাশ তো পাখিদের চূড়ান্ত আশ্রয় কখনো দেবে না।/কাঁটাতারের সীমান্তিক বেড়া আটকে দেবে‌ হরিণকে/
পরিবেশ দূষণ অনিবার্য জেনে/সপরিবারে বুড়ো-কৃষক যে রেলগাড়িতে উঠলো,কে জানে/কোন্ অন্তর্ঘাতের খপ্পরে পড়ে/সেই ট্রেণ সংবাদপত্রের শিরোনাম হবে!"((আশ্রয় কোথায়)

কবি বুঝেন একদিন সব কিছুই শেষ হবে,এই নশ্বর দেহের শেষ হলে কিংবা সমুদ্রের মতো জীবনের দর্শনে,যেখানে থাকবে সীমাহীন রেখাহীন আকাশের একক বিস্তার।আর বলেন,-

"সেদিন কিছুই থাকবে না।/--------------------/
শুধুই বন্দর জেটিতে শেষ জাহাজের প্রতীক্ষা।প্রতীক্ষায় থাকবে/অনড়-প্রণয় এই নশ্বর দেহ।"(শেষ জাহাজের প্রতীক্ষা)।

পরিশেষে বলব,কবিতা‌ই বুঝি কবির জিনেটিক কোড।বলে দেয় কখন কি অসুখ করেছিল তাঁর।কবির জীবনভর এতো কবিতা,এতো অসুখ!এ থেকে পরিত্রাণ নেই যেন তাঁর।তবু তাঁর বিশ্বাস,একদিন সকলের অসুখ‌ই বুঝি পৃথিবীকে করে তুলবে পারিজাত কানন।

------------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ